লিরার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে গিয়ে রিজার্ভশূন্য তুরস্ক

বণিক বার্তা ডেস্ক

প্রেসিডেন্ট এরদোগানের চাপে সুদহার কমিয়ে রেখেছে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছবি: এপি

গত মাসেই তুরস্কের রিজার্ভ নেমে আসে দশমিক ৬৩ বিলিয়ন (৮৬৩ কোটি) ডলারের সমপরিমাণে। ২০০২ সালের পর দেশটির রিজার্ভে এমন দুরবস্থা আর কখনো দেখা যায়নি। লিরার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে গিয়ে গত বছর ব্যাপক হারে রিজার্ভ মুদ্রা বিক্রি করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এর পরও ঠেকানো যায়নি মুদ্রাটির ক্রমাগত অবমূল্যায়ন ব্যাপক মূল্যস্ফীতি। দেশটিতে গত বছর সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশেরও বেশিতে। অন্যদিকে একই সময়ে ডলারের বিপরীতে লিরার অবমূল্যায়নের হার দাঁড়িয়েছে ৪৪ শতাংশে।

লিরার ক্রমাগত অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতির কারণে তুরস্কে জীবনযাত্রার ব্যয় এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। ব্যয় নিয়মিতভাবেই বাড়ছে। দেশটির সরকারি পরিসংখ্যান দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে ভোক্তা মূল্যসূচক বেড়ে দাঁড়িয়েছে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৬ দশমিক শতাংশ বেশিতে। দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন দলের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০১৮ সালের শুরুতেও তুরস্কের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৬৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। বর্তমানে তা নেমে এসেছে বিলিয়নেরও নিচে। মুহূর্তে তুরস্কের রাজনীতিতে বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে দেশটির রিজার্ভ সংকট, ক্রমাগত মূল্যস্ফীতি লিরার অবমূল্যায়ন এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা। দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য প্রধানত এরদোগানের ভ্রান্ত নীতিকেই দায়ী করছেন তার সমালোচকরা।

দুই দশক ধরে প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট হিসেবে তুরস্কের ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়েছেন এরদোগান। তার সময়ে ব্যাপক উন্নয়ন অর্থনৈতিক অগ্রগতির দেখা পেয়েছে দেশটি। সামনের বছর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনেও তার দল বড় ধরনের জয় পাওয়ার প্রত্যাশা করছে। যদিও তুরস্কের জীবনযাত্রার ব্যয় সার্বিক অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি মুহূর্তে বড় ধরনের সংশয় তৈরি করেছে।

লিরার মান কমতে থাকায় তুরস্কে এখন আমদানীকৃত পণ্য, জ্বালানি তেল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার দেশটির বাসিন্দারা খাবারসহ মৌলিক চাহিদা পূরণকারী দ্রব্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। সঞ্চয় রক্ষার্থে অনেকেই এখন বিদেশী মুদ্রা সংগ্রহ স্বর্ণ কেনা বাড়িয়েছে বলে স্থানীয় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে।

গত বছরের পুরো সময় ধরেই লিরা ক্রমাগত হারে অবমূল্যায়িত হয়েছে। এর পেছনে প্রধানত দায়ী করা হচ্ছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণের সুদহার কমিয়ে রাখাকে। বিশেষ করে গত বছরের শেষ দিকে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব টার্কি ব্যাপক হারে সুদহার কমানো সংক্রান্ত একগুচ্ছ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করলে মুদ্রাটির পতন অবাধ হয়ে ওঠে।

মূলত প্রেসিডেন্ট এরদোগানের চাপেই কয়েক দফায় ঋণের সুদহার কমিয়ে রাখছে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বলা হচ্ছে, মূলত কভিডে বিপর্যস্ত তুর্কিদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে সহায়ক পরিস্থিতি তৈরি করতেই সুদহার বাড়ানোর পক্ষে মত দিচ্ছেন না এরদোগান।

যদিও তা এখন পর্যন্ত দেশটির ভোক্তা বা সার্বিক অর্থনীতির জন্য খুব একটা সুখপ্রদ ফলাফল নিয়ে আসতে পারেনি। সর্বশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বরে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব টার্কি সুদহার শতাংশ কমিয়ে দেয়ার পর থেকেই অবাধে মান পড়তে থাকে তুর্কি লিরার। বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতির পারদ।

বর্তমান পরিস্থিতিতেও মূল্যস্ফীতিকে মোকাবেলা করতে গিয়ে কোনোভাবেই সুদহার বাড়ানোর পক্ষপাতী নন এরদোগান। তার ভাষায়, বর্ধিত সুদহার হলো যাবতীয় নষ্টের গোড়া সর্বশেষ গত সোমবারও এক বক্তব্যে সুদহার কমিয়ে রাখার সিদ্ধান্তে অটল থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেছেন, অভিজাতরাই শুধু বর্ধিত সুদহারের সুবিধাভোগী। অনুপার্জিত সুদ আয় থেকে তারা ব্যাপক মুনাফা করে থাকে।

তবে যেকোনো মূল্যে তুরস্কে মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে আনার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন এরদোগান। তার ভাষ্য হলো, যে কারণেই হোক না কেন, জনগণকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে বলে আমরা দুঃখিত। যত দ্রুত সম্ভব মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে এক অংকে আনতে আমরা বদ্ধপরিকর।

কিন্তু সুদহার কমিয়ে রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা নিয়ে সন্দিহান অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বর্ধিত সুদহার অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রবৃদ্ধিকে শ্লথ করে দিলেও তা মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় অনেকটাই কার্যকর। চাহিদা কমানোর পাশাপাশি সঞ্চয়ের প্রবণতা তৈরির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি মুদ্রার অবমূল্যায়ন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখে বাড়তি সুদহার। যদিও কোনো অবস্থাতেই সুদহার বাড়াতে রাজি নন এরদোগান।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন