শিল্প ও বাণিজ্যের ভিত্তি বঙ্গবন্ধুরই রচনা

ইনাম আহমেদ চৌধুরী

মুজিব বর্ষের সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পর আমরা যখন প্রশ্নাতীতভাবেই বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ দূরদর্শী নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়কে ধাবমান, দেশটি যখন নিম্ন আয়ের দেশ (এলডিসি) থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার দোরগোড়ায়, তখন এটা অনুধাবন করা খুবই দুষ্কর যে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তীকালে বাংলাদেশ কী অবস্থায় ছিল।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। প্রায় প্রত্যেক পরিবারেই স্বজন হারানো বা দুর্গতির বেদনা, দেশত্যাগীদের পুনর্বাসন, পঙ্গু অর্থনৈতিক অবস্থা, কলকারখানায় উৎপাদন স্থগিত, যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিন্নভিন্ন, দৈনন্দিন সাধারণ জীবন বিপর্যস্ত। রাষ্ট্রের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল শূন্যের কোটায়। দেশ পৃথক হয়ে গেলেও কেন্দ্রীয় সম্পদ বাটোয়ারার কোনো সম্ভাবনা নেই। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রপরিচালনার হাল ধরলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে তার জীবদ্দশায় একটি নবগঠিত জাতি রাষ্ট্রকে কী করে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন সহস্র বাধাবিপত্তি প্রতিবন্ধকতা জয় করে, তা এক আশ্চর্য সুন্দর উদ্দীপক অগ্রযাত্রার কাহিনী। আমার পরম সৌভাগ্য, বন্ধুর পথে দেশকে পরিচালনা করে এগিয়ে নেয়ার সে মহান নেতৃত্বকে কাছ থেকে দেখার বিরল সুযোগ পেয়েছিলাম।

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান ছেড়ে লন্ডন এবং লন্ডন থেকে ব্রিটিশ সরকারের একটি বিমানে দিল্লি হয়ে ঢাকা এলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে বহির্বিশ্বে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডেলিগেশনের পাঁচ সদস্যের একজন হিসেবে আমি তখন দিল্লি ছিলাম এবং বঙ্গবন্ধুকে দিল্লিতে পদার্পণের ঐতিহাসিক অভ্যর্থনা দেখার অবিশ্বাস্য সুযোগ পেলাম। তার পর পরই বিশেষ ব্যবস্থায় আমিসহ ডেলিগেশনের তিনজন সেদিনই ঢাকা প্রত্যাবর্তন করি এবং ঢাকা বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জনতার একজন হয়ে সেই ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন অবলোকন করার সৌভাগ্য হয়।

বঙ্গবন্ধুর প্রধান সমস্যাগুলোর পুরোভাগে ছিল রাষ্ট্রকাঠামো এবং সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো সচল করা। তিনি পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মানসে প্রথমেই রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন এবং একটি ছোট মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সব কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত হলো স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রথম পার্লামেন্ট। পুনর্গঠিত হলো সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্ট। সবার আগে আইন-শৃঙ্খলা যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দৃঢ় হাতে বঙ্গবন্ধু তুলে নিলেন। আমার মতে, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামো নির্ধারণ শিল্প-বাণিজ্য পুনর্জীবিতকরণ। মোদ্দা কথা, শান্তি নিরাপত্তায় বেঁচে থাকা এবং জীবিকার ব্যবস্থা করা।

আমাদের সংবিধানের চারটি মূল স্তম্ভের একটি ছিল সমাজতন্ত্র। যদিও বাহাত্তরে সংবিধান রচিত হয়নি, তবুও এটা যে অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাবে, সে ধারণা ছিল। বস্তুতপক্ষে, বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাগমনের আগেই তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সরকারি কর্মকর্তাদের এবং মন্ত্রীদের সর্বোচ্চ বেতন সাময়িকভাবে মাসিক এক হাজার টাকা নির্ধারণ করে বেসরকারি শিল্প-বাণিজ্য জাতীয়করণের ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু প্রত্যাগমনের পরে অবশ্য মাসিক বেতন যৌক্তিকভাবে পুনর্নির্ধারণ করা হয়।

গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে পাকিস্তানিদের মালিকানার এবং পরিত্যক্ত সব শিল্প বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট সংস্থার উচ্চতম পদের অধিকারী বাঙালিকে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। জাতীয়করণ করা যখন হলো তখন অবশ্য বাঙালিসহ সবার ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বৃহৎ শিল্প এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের আওতায় আসে। কিন্তু সমস্যা হয়েছিল সেগুলো দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার জন্য উপযুক্ত কর্মশক্তি ছিল না। তাতে উৎপাদন তেজারতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মালিকানা নির্বিশেষে সব প্রাইভেট ব্যাংক ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে জাতীয়করণ করে ক্ষুদ্রতর সংস্থাগুলোকে একীভূত করে কয়েকটি স্বতন্ত্র সরকার-নিয়ন্ত্রিত সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। বঙ্গবন্ধু ইন্স্যুরেন্সের সঙ্গে কিছুটা জড়িত ছিলেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের পারিবারিক বন্ধু ইউসুফ হারুনের আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে সম্ভবত জনসংযোগ উপদেষ্টা হিসেবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। আমাদের মুক্তিসংগ্রামে করাচির বিখ্যাত হারুন পরিবারের সহানুভূতি সমর্থন ছিল। বঙ্গবন্ধু কোনো এক সালের মার্চ ইন্স্যুরেন্সে যোগ দেন। আমরা তাই যথার্থভাবেই মার্চকে বীমা দিবস হিসেবে পালন শুরু করেছি। অর্থনীতিকে সুসংহত করে পরিকল্পিত অগ্রযাত্রা বঙ্গবন্ধুর অগ্রাধিকারভিত্তিক চিন্তা ছিল এবং অধ্যাপক নূরুল ইসলামকে মন্ত্রী পদমর্যাদায় ডেপুটি চেয়ারম্যান (প্রধানমন্ত্রী ছিলেন চেয়ারম্যান) নিয়োগ দিয়ে একটি শক্তিশালী প্ল্যানিং কমিশন গঠন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারও একটি প্ল্যানিং কমিশন গঠন করেছিল, যার চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী এবং সদস্যরা ছিলেন . খান সারওয়ার মুর্শিদ, . মুশাররাফ হোসেন, . আনিসুজ্জামান . স্বদেশ রঞ্জন বোস। এর মধ্যে কেউ কেউ নবগঠিত প্ল্যানিং কমিশনেও যোগদান করেন।

১৯৭২ সালের জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আমাদের যে প্রথম ডেলিগেশন দিল্লি যায়, তার একজন ছিলেন অধ্যাপক মুশাররাফ হোসেন। ওই সফরে তিনি মধ্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা মুখ্যতর আলোচনা করেন। আমি যেহেতু শিল্প বাণিজ্য বিভাগের যুগ্ম সচিব ছিলাম, ওই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা এবং অত্যাবশ্যক জরুরি কাগজপত্র সরবরাহ নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমার ওপর ন্যস্ত ছিল। বাস্তব অবস্থা এবং মেয়াদি পরিকল্পনার সঙ্গে কিছুটা দ্বন্দ্ব তখন দেখা দিয়েছিল।

আমাদের তখন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কেনার মতো বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। বঙ্গবন্ধু তখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বার্টার এগ্রিমেন্ট করে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের অনুমোদন দিলেন। আমার মনে আছে, স্বাধীনতার প্রথম দু-তিন বছরে আমরা মুখ্যত পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে পণ্য বিনিময় নিয়ে আলোচনা এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে আমি নয়-দশটি পণ্য বিনিময় চুক্তি সম্পাদন করি, যা তখন হয়ে দাঁড়াল আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের মূলধারা। আমদানির জন্য আমাদের প্রায় সবকিছুরই প্রয়োজন ছিল আর রফতানিসামগ্রী ছিল খুবই সীমিতপাট পাটজাত দ্রব্য, তামাক, চামড়া, চামড়াজাত কুটির শিল্পজাত দ্রব্য, চা, এমনকি দিয়াশলাই, ঝাড়ুও। কখনোবা আমাদের বলতে হতো ভবিষ্যতে নির্ধারিত সময়সীমায় রফতানি পণ্য প্রেরিতব্য। তবে এগুলোর জন্য প্রয়োজন ছিল বিরাট আন্তর্জাতিক গুডউইল অ্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিং বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ফলপ্রসূ স্বস্তিদায়ক পররাষ্ট্রনীতি তা সম্ভব করে তুলেছিল।

১৯৭২ সালেই বঙ্গবন্ধু ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নে রাষ্ট্রীয় সফর করেন এবং তা আমাদের জন্য যথাযথ বাণিজ্য অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদন সম্ভব করে তোলে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ না করে পারস্পরিক সমতা সার্বভৌমত্বের ওপর শ্রদ্ধাশীল থেকে সহযোগিতা দৃঢ়তর করতে সোভিয়েত নেতারা আশ্বাস দেন। ঘোড়াশাল থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট, চট্টগ্রামে জেনারেল ইলেকট্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্ট, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন রেডিও ট্রান্সমিটার, তেল গ্যাস অনুসন্ধানে সোভিয়েত অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা হয়। সব আলোচনা এবং চুক্তি-সমঝোতায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বার্থ শুধু সংরক্ষণ নয়, বরং প্রাপ্তির দিকে কড়া নজর রাখতেন।

ভারত সফরেও বঙ্গবন্ধুকে উষ্ণ অভ্যর্থনা দেয়া হয় এবং অর্থনৈতিক অন্যবিধ সহযোগিতায় পারস্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণের ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়। বাংলাদেশের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর আত্মসম্মানবোধ খুবই প্রখর ছিল এবং তিনি চাইতেন তা যেন সব সময়ই সমুন্নত রাখা হয়। বিষয়ে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, যা ভারতের একজন প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম তিন বছর ঢাকায় ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার একটি প্রকাশিত বই লিবারেশন অ্যান্ড বিয়োন্ড- উল্লেখ করেছেন। লেখক জেএন দীক্ষিতের কথায়, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরপর ভারত বাংলাদেশকে চালু অবস্থায় দুটি ফকার ফ্রেন্ডশিপ বিমান এবং দুটি সমুদ্রগামী জাহাজ অনুদান দিতে চেয়েছিল। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মসম্মানবোধ এতই প্রবল ছিল যে তিনি এগুলোকে অনুদান হিসেবে নিতে চাননি। বরং প্রয়োজনের ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়ে কেনার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সূচনায়ই শেখ মুজিব (বঙ্গবন্ধু) গঙ্গার সুষম পানি বণ্টন ছিটমহল হস্তান্তরের প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তিনি ভারতের দখলকৃত পাকিস্তানি সমরাস্ত্র এবং গোলাবারুদ বাংলাদেশকে ফেরত দেয়ার অনুরোধ জানান। বলেন, এগুলো বাংলাদেশেরই প্রাপ্য।

বঙ্গবন্ধু কখনো চাইতেন না যে বাংলাদেশ কোনো দেশের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হোক। দীক্ষিত লিখেছেন, শেখ মুজিব ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চাইতেন। তবে তিনি - চাইতেন যে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারিগরি সম্পর্ক গড়ে উঠুক; যাতে বাংলাদেশকে ভারতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হতে না হয়। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বতন্ত্র সত্তা সর্ববিধ স্বার্থ তার বিবেচনায় সর্বাগ্রে স্থান পেত।

১৯৭২ সালের মে মাসে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) তৃতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ তখনো জাতিসংঘের সদস্য হয়নি এবং চিলি তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানায়নি। তবে বাণিজ্য সম্প্রসারণ অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিকরণের জন্য আঙ্কটাডের সদস্যপদ লাভের প্রচেষ্টার বিশেষ প্রয়োজন ছিল। সেই বিবেচনা করে অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু তদানীন্তন বাণিজ্যমন্ত্রী এমআর সিদ্দিকী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আমি এবং টিসিবির প্রধান মোহাম্মদ মহসিন (পরে পররাষ্ট্র সচিব) সমন্বয়ে একটি ডেলিগেশন চিলিতে প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন। শেষ মুহূর্তেও চিলির স্বীকৃতি না আসায় বাণিজ্যমন্ত্রী আর চিলিতে গেলেন না। আমার নেতৃত্বেই ছোট ডেলিগেশনটি সান্তিয়াগো গেল।

সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দেকে লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠি। প্রেসিডেন্ট আলেন্দে অত্যন্ত সম্মান সহকারে বঙ্গবন্ধুর চিঠি পড়ে বললেন, আমরা স্বীকৃতি জানানোর চেষ্টা করছি, কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। তবে শিগগিরই তা উতরে যাব বলে আশা করছি। সদস্যপদ লাভের জন্য তিনি চীনকে অ্যাপ্রোচ করার পরামর্শ দিলেন। পাকিস্তান ডেলিগেশনের আমার একজন প্রাক্তন সিএসপি সহকর্মীর সহযোগিতায় চৈনিক ডেলিগেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছুটা নাটকীয়ভাবেই সবার সহযোগিতায় জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার আগেই প্রথম ইউএন সংস্থা আঙ্কটাডের সদস্যপদ লাভ করলাম, যা আমাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে এবং গ্যাটের সদস্যপদ লাভের চেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে গেল। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা, একাগ্রতা আন্তর্জাতিক সম্মানের জন্যই এটা সম্ভব হয়েছিল।

আরো একটি ঘটনার কথা বলছি। বঙ্গবন্ধু চাইতেন বাণিজ্যিক সম্পর্ককে বিস্তৃততর করতে এবং আমাদের রফতানিকে এক পণ্যনির্ভর না করে তাতে বহুত্ব নিয়ে আসতে। চীন যদিও তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিলেন যে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৭৫ সালের প্রথমার্ধে একটি ডেলিগেশনকে চীনে পাঠান। চীনে নিযুক্ত পাকিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত তত্কালীন বার্মায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কেএম কায়সারের উদ্যোগে সেটা সম্ভব হলো। সে প্রতিনিধি দলে তিনজন ছিলেন বেসরকারি সদস্য এবং শুধু আমিই ছিলাম একমাত্র সরকারি সদস্য। আমার ওপর নির্দেশ ছিল, যেকোনো উপায়ে চীন বা চীনের কোনো সংস্থার (সবই সরকারি ছিল) সঙ্গে আমদানি-রফতানির চুক্তি করা এবং তা সম্পাদনের পূর্ণ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির নির্দেশে আমাকে প্রদান করা হয়েছিল। কোনো সরকারি আমন্ত্রণও নেই। তাই ওই অবস্থায় এটি ছিল একটি ঝুঁকিপূর্ণ সফর। কিন্তু দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু বলিষ্ঠ চিন্তাধারায় ভেবেছিলেন, আমাদের বাণিজ্যিক অর্থনৈতিক যোগাযোগ যথাসাধ্য বাড়াতে হবে। যথাযথ আলোচনা নেগোসিয়েশনের পরে ওদের বিভিন্ন করপোরেশনের সঙ্গে আমি দুটি রফতানি এবং দুটি আমদানির চুক্তি স্বাক্ষর করি। ফিরে এলে বঙ্গবন্ধু এতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। নিজের দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে একক সিদ্ধান্তই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের স্বীকৃতির পর লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করেন। এতে বাংলাদেশের পক্ষে আইডিবির সদস্য লাভ সহজ হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিরাট সম্প্রসারণ সম্ভব হয়। পরে ইআরডির (অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ) সচিব এবং তত্পরবর্তীকালে আইডিবির ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন আমি দেখেছি, আইডিবির অর্থনৈতিক সহযোগিতা আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের উল্লেখযোগ্য সহায়ক হয়ে দাঁড়ায়।

একটি কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশের ওই সমস্যাসংকুল প্রশাসনিক সময়ে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ দূরদর্শিতা এবং অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব দেশের অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের দৃঢ় ভিত্তি রচনা করেছিল। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশ লাভ করেছিল আঙ্কটাড এবং পরবর্তীকালে জাতিসংঘের সদস্যপদ; যোগ দিয়েছিল কমনওয়েলথ, ওআইসি, আইডিবি জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রমণ্ডলীর দলে। এসব না ঘটলে বিশ্বব্যাপী ক্যানভাসে আমরা বাংলাদেশের বাণিজ্যিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির রূপরেখা রচনা বাস্তবায়ন করতে পারতাম না।

বাস্তব প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতেই বঙ্গবন্ধু তার গতিপথ নির্ধারণ করেন। ভারত সরকার কয়েকজন পরামর্শকের ব্যবস্থা করে; কিন্তু আমাদের সরকার তা ধন্যবাদের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে। একজন পরামর্শক তো শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে একজন যুগ্ম সচিব পর্যায়ের অধিকর্তাকে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে তার অপ্রয়োজনীয়তার কথা জানালে তিনি আর যোগদান করেননি। আগেই বলেছি, একটি শক্তিশালী উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্ল্যানিং কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন মন্ত্রী পর্যায়ের; সদস্যরা প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় এবং ডিভিশন চিফরা ছিলেন সচিবের পদমর্যাদায়। স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীকালে আমাদের জরুরি সমস্যা ছিল বন্ধ ফ্যাক্টরিগুলো অবিলম্বে চালু করা, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি বীজ, সার সংগ্রহে মনোযোগী হওয়া, ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো যথাসম্ভব পুনর্নির্মাণ করা, ক্ষুদ্র শিল্পসহ অন্যান্য শিল্প উৎপাদনে কলকারখানার জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ করা এবং দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান করা। প্ল্যানিং কমিশন এসবের ওপর বিশেষ নজর না দিয়ে রচনা করে ১৯৭৩-৭৮ সালের জন্য প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা স্বনিভর্রতা সমাজতান্ত্রিক কাঠামো গঠনের ওপর প্রাধান্য দিয়ে। যেসব সংখ্যাতত্ত্বের ওপর নির্ভর করে প্ল্যানটি রচিত হলো সেগুলো যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য ছিল না। জাতীয়করণ শিল্প বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো উপযুক্ত জনশক্তির অভাবে সম্পূর্ণ কর্মক্ষম হতে পারল না। দুর্ভাগ্যবশত খরা বন্যা দুই প্রকৃতির প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হলো দেশকে, যখন বিরাট সংখ্যায় বাস্তুচ্যুতদের পুনর্বাসনের সমস্যা ছিল প্রকট। কিউবার সঙ্গে একটি পাট বিক্রি চুক্তির প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুত খাদ্য সরবরাহ ইচ্ছাকৃতভাবেই বিলম্বিত এবং অনিশ্চিত করে তুলল। সম্ভবত দৃশ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধানের চেষ্টার পথে না গিয়ে প্ল্যানিং কমিশন আদর্শবাদী একটি পঞ্চবার্ষিক অর্থনৈতিক এবং অন্যবিধ উন্নয়ন প্রচেষ্টার রূপরেখা তুলে ধরল, যা তত্কালীন বিদ্যমান অবস্থায় ছিল যথেষ্ট অবাস্তব।

এমতাবস্থায় যে দেশ তার সংগ্রামী নেতৃত্বে ৩০ লাখ শহীদের রক্তদান এবং লাখ লাখ মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষায় স্বাধীন সার্বভৌম অস্তিত্বে আত্মপ্রকাশ করল, সে দেশকে ওই নিরাশাব্যঞ্জক অনভিপ্রেত অবস্থান থেকে রক্ষা করে তাকে কল্পনার সোনার বাংলা রূপান্তরের পথে চলমান করার মানসে কয়েকটি দৃঢ়, বলিষ্ঠ দূরদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করলেন দেশকে এবং দেশের মানুষকে সীমাহীন ভালোবাসার তাগিদে। কিন্তু তার স্বাধীন, আপসহীন দেশপ্রেমমূলক এবং গণবান্ধব নীতির বিরুদ্ধে একটি ভয়াবহ ষড়যন্ত্র নিষ্ঠুর চক্রান্তের শিকার তাকে হতে হলো। শুধু তিনি নন, ইতিহাসের বিষাদতম ট্র্যাজেডিতে আত্মাহুতি দিলেন ঢাকায় অবস্থানরত তার সব পরিবার সদস্য নিকটজন।

বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন বটে তার আদর্শ, তার নীতি, তার প্রদর্শিত পথ রয়ে গেল। মুজিব বর্ষে সেটাই হবে উদ্ভাসিত। সেই পথ ধরে তার চিহ্নিত লক্ষ্যে পৌঁছতে আজ নিরলস প্রচেষ্টারত তার যোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। সর্বাত্মক সহযোগিতায় তা সফল করে তুলতে সকৃতজ্ঞ জাতি মুজিব বর্ষ উদযাপনের শুভক্ষণে নেবে অঙ্গীকার।

ইনাম আহমেদ চৌধুরী: সাবেক সচিব, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন