আসন্ন বাজেট

সামাজিক সুরক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে চাই প্রাধিকার

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে এবং বিশেষ করে করোনাভাইরাসে ভুক্তভোগী বাংলাদেশের জন্য জাতীয় বাজেটের আকার অবয়ব নিয়ে চিন্তাভাবনার অবকাশ এমনিতেই এসে যায়। বিষয়টি কারণেও গুরুত্ববহ যে মহামারী মোকাবেলায় একটি উদীয়মান উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য যেসব চ্যালেঞ্জ এরই মধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, তা কী ধরনের কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে উতরানো যাবে তার একটা পথনকশা, পদক্ষেপের পদাবলি বাজেটে প্রত্যাশিত থেকেই যাচ্ছে, যাবে। আপাতত আগামী মাসে সংসদে যে জাতীয় বাজেটটি উপস্থাপিত আলোচিত হয়ে কণ্ঠভোটে পাস হয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য যাবে, যার বাস্তবায়ন শুরু হবে জুলাই থেকে, তার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। গত বছর যে বাজেট পাস হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন পরিস্থিতি পরিসংখ্যানের প্রতি প্রশ্ন-আগ্রহ ইদানীং বড় একটা দেখা যায় না। সবাই দেখতে চায় নতুন বাজেট। বাজেট বাস্তবায়ন পরিস্থিতির প্রতি নজর থেকেও যেন নেই। অথচ বাস্তবায়নের মধ্যেই বাজেটীয় সাফল্য বা প্রভাব, প্রত্যাশার প্রকৃত প্রাপ্তি নির্ভর করে এবং অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন বাজেটে কৌশল পুনর্নির্ধারণের তাগিদ উঠে আসে।

বাজেট কার, কার জন্য বাজেট

সংবিধানের প্রস্তাবনায় সর্বপ্রথমে উচ্চারিত তিন শব্দআমরা বাংলাদেশের জনগণ। সংগত কারণে জাতীয় বাজেটে প্রতিফলিত হওয়া উচিত সেই সকল জনগণের প্রত্যাশা প্রাপ্তির বিধিবিধান, খতিয়ান। বাজেট বিশাল টাওয়ার কিংবা বড় গ্রুপ কোম্পানির কর্ণধারের যেমন, বাজেট নীলফামারীর ডোমার উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র কৃষকের, শরত্চন্দ্রের গফুর মহেশের, চাষাদের, কামার, কুমার-মজুরের। জাতীয় বাজেটটি হবে রাষ্ট্রের, শুধু সরকারের নয়, শুধু পক্ষের নয়, বিপক্ষেরও; সবার। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি খাতে অগ্রাধিকার এবং বরাদ্দ বাড়ালেই বাজেট জনগণের বাজেট বা ইতিবাচক হয় না; স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ালেই মহামারী মোকাবেলা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়ে না; খাতের ব্যয়ের সক্ষমতা সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন যদি বহাল থাকে, দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা-অপারগতায় আকীর্ণ থাকে এবং তা নিরসন নিয়ন্ত্রণে তথা জবাবদিহিকরণে কথায় নয় কাজে অগ্রগতি না থাকে। বাজেটে বরাদ্দ বড় কথা নয়, অর্থনীতিতে সেই বরাদ্দের কতটা সম্পদ সেবা সৃষ্টি হলো, প্রভাব ফেলতে পারল, সেটিই বড় কথা।

করোনা সংকটে বেশিমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প, মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তের কর্মসংস্থান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার মতো খাতগুলো অগ্রাধিকারপ্রাপ্য। গত বছর (এখন পর্যন্ত চলতি বাজেট বর্ষে) করোনার প্রভাবে বাজেট প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্য কৃষি খাতের গুরুত্ব আলোচিত হলেও সেখানে বরাদ্দ নমিনাল টার্মে আপেক্ষিকভাবে কিছুটা  বৃদ্ধি পেলেও দেখা যায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শিক্ষা, দক্ষ জনসম্পদ তৈরি, আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসৃজনমূলক শিল্প উদ্যোগে কার্যকর পদক্ষেপের, বাস্তবায়নের খাতে বরাদ্দ সে হারে আরো বাড়ানো প্রয়োজন ছিল, যেভাবে বা হারে জনপ্রশাসনসহ অন্য অনেক অগৌণ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছিল, সেভাবে বা হারে করোনা যে আর্থিক সামাজিক ক্ষতিসাধন করেছে, তা পুনরুদ্ধারে পরিপূরক সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারত, সেসব খাতযেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সামাজিক সুরক্ষা খাতে বাড়েনি। তদুপরি সেই বরাদ্দকৃত অর্থের বণ্টন ব্যবহার বা বাস্তবায়নের হিসাব মেলানোর সুযোগ সীমিত। করোনাকালে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ শিক্ষা কার্যক্রমবিহীন (বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে) খাতে ব্যবহূত হয়েছে। বিদ্যমান ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে মহানগর শহরে বিকল্প (অনলাইনভিত্তিক) শিক্ষা কার্যক্রম চললেও বিশাল ব্যাপক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পাঠবিমুখ করা হয়েছে। টেবিল-চেয়ার পাহারা আর দায়দায়িত্ব কর্মহীন শিক্ষকের পেছনে এবং বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণে ব্যবহূত হয়েছে সিংহভাগ বরাদ্দ। অগৌণে শিক্ষা খাতের দিকে দৃষ্টি না দিলে শিক্ষায় বা সমাজে যে ক্ষরণ ক্ষত সৃষ্টি হবে, তা হবে করোনার বড় অভিঘাত।

উন্নয়নশীল অর্থনীতির বাজেট

বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নিম্ন থেকে নিম্নমধ্যবিত্তের তকমা পেতে হলে সব খাত ক্ষেত্রে একযোগে উন্নয়নশীল হতে হবে। বাংলাদেশ অর্থনীতির প্রাণবায়ু কৃষি খাতে কৃষির উৎপাদন কৃষি তথা সামগ্রিকভাবে কৃষি খাতের উন্নতি একটি সম্মিলিত প্রয়াস। যেখানে কৃষিবিদ, কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষক কৃষি উপকরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি খাত, আমিষ, শর্করা সরবরাহকারীরাও সরাসরি জড়িত। কৃষি ক্ষেত্রে ভর্তুকি/প্রণোদনা যেন যথাযথভাবে এবং যথাসময়ে সত্যিকার প্রান্তিক চাষীরা, খামারিরা পান। নতুন নতুন উদ্ভাবন সম্প্রসারণে বাংলাদেশে ব্যক্তি খাতের অবদান কম নয়। সেজন্য রাষ্ট্রীয় খাতের পাশাপাশি ব্যক্তি খাতেও বাজেট বরাদ্দ থাকা উচিত। রাসায়নিক সারের তুলনায় জৈব সার মাটির স্বাস্থ্য ভালো করে বিধায় রাসায়নিক সারের মতো বাজেটে জৈব সার উৎপাদনে ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। দেশের প্রান্তিক চাষীরা যাতে তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান, তার সুস্পষ্ট কৌশল, মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রতিরোধ, পথে পথে চাঁদাবাজের দৌরাত্ম্য, প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত দুর্নীতি কমানোর অঙ্গীকার বাজেটে থাকা দরকার। বাংলাদেশের প্রায় সব খাতেই বীমার ব্যবস্থা থাকলেও গত বাজেটে কৃষি কৃষকের বীমার প্রস্তাবনা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। প্রান্তিক চাষী, ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তা, খামারি, মাছচাষীর কাছে প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা পৌঁছেনি। ব্যাংক বা আর্থিক খাতে বিশাল ব্যাধির সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হয়নি। ধনী আরো ধনী হওয়ার সহজ সুযোগে আয়বৈষম্য বেড়েই চলেছে। অন্তর্ভুক্তির নামে বিচ্ছিন্নতাই বাড়তে থাকলে কাউকে পেছনে ফেলা যাবে না’—এসডিজি লক্ষ্য অর্জনের মর্মবাণী ব্যর্থ হবে।

গ্রামীণ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় বরাদ্দ আরো কর্মসৃজনমূলক সৃজনশীল খাত সৃষ্টি এবং নমিনাল টার্মে বেশি থাকা দরকার এবং বণ্টনে পক্ষপাতিত্বহীন স্বচ্ছ হওয়া আবশ্যক। ৫০ লাখ প্রাপককে যে বিশেষ অর্থ প্রদান করা হয়েছিল এবং সামনে ঈদ উপলক্ষে আরো বিপুল প্রাপককে প্রদানের ঘোষণা আসছে, তা বিলিবণ্টনে ন্যায্যতা, সঠিক গন্তব্য   প্রাপ্যতা নিয়ে এখনো যে সংশয় রয়ে গেছে, তার নিরসনে ব্যবস্থা বা নজর থাকা আবশ্যক হবে।

ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগবান্ধব বাজেট

চলতি বাজেটে একদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের সুশাসনের কথা থাকলেও যেভাবে অপ্রদর্শিত কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে, তা স্ববিরোধিতায় আকীর্ণ। জরিমানা ছাড়া মাত্র ১০ শতাংশ হারে কর প্রদান করলে কোনো সংস্থা কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না’—এভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকলে সৎ নিয়মিত করদাতাদের আরো নিরুৎসাহিত করা হবে। যথাযথ জরিমানা প্রযোজ্য কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সময় নির্দিষ্ট করে দেয়া না হলে এবং অর্জিত আয় উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন না তোলার প্রতিশ্রুতি দেয়ার অর্থই হবে সংবিধানের ২০() ধারায় বর্ণিত বিধানের (রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না) পরিপন্থী অবস্থান গ্রহণ। রাষ্ট্রের দায়িত্ব যেখানে কালো টাকা আয় উপার্জনের পথ বন্ধ করা এবং উদ্ধারে কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়া, তার পরিবর্তে রাষ্ট্র যদি দুর্নীতিজাত অর্থ উদ্ধারের নামে প্রণোদনামূলক পদক্ষেপে যায় বা দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে, তবে তা হবে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি সহায়তার নামান্তর। কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস কেন কীভাবে বাড়ছে, কেন কীভাবে সেই দুর্নীতিজাত আয়ের অর্থ পাচার হচ্ছে, সেদিকে মনোযোগ না দেয়া হবে আত্মঘাতী, ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগবান্ধব বাজেট ঘোষণার প্রতি প্রতারণা।

বেকারত্ব দূর তথা কর্মসংস্থানের জন্য বাজেট বক্তৃতায় অনেক কথা বলা হয়। তবে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি, বিদেশফেরত প্রবাসীদের হতাশা দূর মুহূর্তে অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন কাজের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেটা কীভাবে সমন্বয় হবে, প্রশিক্ষণসহ অন্য কী ব্যবস্থা নেয়া হবে, অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করা যাবে, সেই সুযোগের ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ দিকনির্দেশনা চলতি বাজেটেও যেমন প্রয়োজন ছিল, নতুন বাজেটে সেসবের বাস্তবায়নানুগ লক্ষ্যভেদী পদক্ষেপ থাকতে হবে।

করোনা-উত্তর পরিবেশ পরিস্থিতিতে চীনসহ অনেক দেশ থেকে জাপানি বিনিয়োগ অন্যত্র স্থানান্তরের যে সুযোগের হাতছানি আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেখানে গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশকে সক্ষম করে তোলার প্রয়োজনীয়তা অগ্রগণ্য, বাজেটে তার কার্যকর কর্মপরিকল্পনা থাকা দরকার।

করোনা মোকাবেলায় সম্প্রসারণধর্মী বাজেটের প্রয়োজনীয়তা কেন

মুহূর্তে করোনা মোকাবেলায় দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে চলমান   টেকসই রাখতে সুপরিকল্পিত সম্প্রসারণধর্মী বাজেটের কোনো বিকল্প নেই। করোনাকালে এবং করোনা-উত্তর পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়নশীল দেশে উন্নীতকরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত প্রগতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে একটি বহুমুখী, বাস্তবায়নযোগ্য এবং সম্প্রসারণশীল বাজেটের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো এর গতি-প্রকৃতির সঙ্গে তুলনা করলে সাম্প্রতিক কালের বাজেট বরাদ্দকে উচ্চাভিলাষী বলা চলে না, বাস্তবিকভাবেই বাজেট বরাদ্দ খুব বেশি নয়। দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করা, অবকাঠামোগত উন্নয়নে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বৃদ্ধি, সামগ্রিক ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের জন্য বাজেটের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করার অবকাশ রয়েই যাচ্ছে।

বাংলাদেশের বাজেটের আকার বাড়ছে, বাড়বে। ঘাটতি বাড়বে। সে কারণে বাজেট সামলানো বাস্তবায়ন সক্ষমতা বাড়ানোর চাপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাজেট বরাদ্দে দক্ষতা উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, বাজেট বাস্তবায়নে যথাযথ পরিবীক্ষণ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ধর্মী যোগাযোগ লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সমঝোতা বৃদ্ধি, ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সবার সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করতে পারলে করোনাকালেও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বৈকি। করোনাকাল সহসা চলে যাবেএমন ধারণায় চলতি বাজেট করা হয়েছিল। করোনা এখনো যায়নি, জীবন জীবিকার সন্ধানে ঝুঁকি নিয়ে মানুষ দ্বিতীয় ধাক্কা আসার আগে নিজের থেকে ছোটাছুটি করছেএটাকে স্বস্তির আত্মতৃপ্তির বিষয় ভাবা সমীচীন হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। ২০২১ সালেও করোনার অভিঘাত অব্যাহত থাকবেএটা মনে রেখে বাজেটে পরিকল্পনা আঁটতে হবে।

এখন বড় ইস্যু হচ্ছে করোনাভাইরাস। জীবন বাঁচানোর প্রশ্ন প্রথম, দ্বিতীয় ইস্যু হচ্ছে জীবিকা। তৃতীয় এবং অন্যতম ইস্যু সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত দুর্নীতি দমন। অভ্যন্তরীণ বাজার ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো। এটা এখন এক নতুন বাংলাদেশ। আগের অবস্থা আর ফিরে আসবে না। নতুন পরিস্থিতি, নতুন সমস্যা, নতুন সম্ভাবনা। অর্থনীতির কাঠামো পরিবর্তনে এগিয়ে আসতে হবে। মোদ্দাকথা, অর্থনীতিতে স্থায়িত্বশীলতা এবং মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। আসন্ন বাজেটে লক্ষ্যে উপযুক্ত প্রেসক্রিপশন প্রত্যাশিত থাকবে।

বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ

ব্যয়ের বাজেটে অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ (রাজস্ব আয়) সম্পদের অপ্রতুলতা। বেসরকারি খাতে  বিনিয়োগে দৃশ্যত স্থবিরতা। স্বচ্ছতা জবাবদিহির অনুপস্থিতির আড়ালে দুর্নীতিগ্রস্ততায় অর্থনীতিতে ক্ষরণ, কস্ট অব ডুয়িং বিজনেসের ঊর্ধ্বগামিতা। সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতা এবং এমনকি সম্পূরক বাজেট অনুমোদনকালে তা যথাবিবেচনায় না আসা। মেগা প্রকল্পে ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়ার পরিবর্তে ব্যয় বৃদ্ধি, প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা, করোনাকালে কিংবা করোনা-উত্তর অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় কৃচ্ছ্রসাধন ব্যয়সংকোচনের দাবি এবং যৌক্তিকতা অনুসরণে অপারগ পরিস্থিতি পরিবেশ। ঐকমত্যের ওজস্বিতা অনৈক্যের মাশুল দিতে দিতে হ্রাস পাওয়া। অন্তর্ভুক্তির দর্শন বিচ্ছিন্নতার বাস্তবতায় ধোঁয়াটে হওয়া। বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া, প্রবাসীদের দেশে ফেরা, রফতানি বাজার সংকুচিত হওয়া, জলবায়ুর পরিবর্তন হেতু বন্যা, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ে কৃষি উৎপাদন জানমালের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বহির্মুখীন খাত ক্ষেত্রগুলো সংকুচিত হওয়া। 

চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাজেটে করণীয়

রাজস্ব আহরণ খাতে চলমান সংস্কার অনলাইনকরণ বাস্তবায়নে দৃঢ়চিত্ত সময়সূচিভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করা। বিদ্যমান আইনের সংস্কার এবং অনলাইনকরণ ব্যতিরেকে বিদ্যমান কর্মকাঠামো লোকবল দিয়ে রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি পরিবেশের উন্নয়ন সাধন সম্ভব সমীচীন হবে না।

রাজস্ব আহরণ প্রদান ব্যবস্থাপনাকে গতিশীল আস্থায় আনতে সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির তত্ত্বাবধানে সরকারি-বেসরকারি খাত সমন্বয়ে উপদেষ্টা প্যানেল প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, প্যানেল থেকেই করনীতি রাজস্ব আহরণ পদ্ধতি প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রস্তাব আসতে পারে। জাপানসহ অনেক উন্নত অর্থনীতির দেশে ধরনের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আছে।

করদাতা এবং কর আহরণকারী দপ্তরের মধ্যে রাজস্ব আহরণবিষয়ক জটিলতা সমস্যা আপিল আবেদন নিষ্পত্তি উপরিদর্শনের মাধ্যমে পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কর ন্যায়পাল অফিস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। ২০০৫ সালে যে উদ্দেশ্য অভিপ্রায়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান কর ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ২০১১ সালে অর্থাৎ মাত্র সাড়ে পাঁচ বছরের মাথায় বিশ্বব্যাপী অনুসৃত প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত করার প্রেক্ষাপটটি পুনঃপর্যালোচনার অবকাশ রয়েছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে অর্থবছর শুরু শেষ হয় পূর্ণ বর্ষা মৌসুমে (আষাঢ় মাসে) বর্ষায় অর্থবছর শুরু হওয়ায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু হতে দেরি হয়। একইভাবে শেষের দিকেও বর্ষা থাকায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্মাণকাজ চালিয়ে যাওয়া/শেষ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। ফলে এডিপি বাস্তবায়নে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে বর্ষাকাল, প্রাকৃতিক দুর্য়োগ ইত্যাকার কারণে অর্থবছর শেষের তিন মাসের মধ্যে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা অর্থবছর শেষ হওয়ার পাঁচ মাস পর অর্থাৎ নভেম্বরে। সামষ্টিক অর্থনীতি পরিচালনার স্বার্থে আয়কর এত দেরিতে পাওয়া বিধেয় নয়। এসব কারণে ভারত, জাপানের মতো জানুয়ারি অথবা এপ্রিল ৈবশাখ) থেকে অর্থবছর শুরু করা হলে এডিপি বাস্তবায়ন, রাজস্ব আহরণ কাজের মান নিশ্চিত করা সহজ হবে।

ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি করার জন্য কর নেট বাড়ানো প্রয়োজন। একই সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠান সংস্থা সঠিকভাবে কর পরিশোধ করছে কিনা, তাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দেশী-বিদেশী বহুজাতিক সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের করপোরেট ব্যক্তিগত কর আদায় নিশ্চিত করতে পারলে শুধু করপ্রাপ্তিই বাড়বে না, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান/সংস্থার হিসাবেও অধিকতর স্বচ্ছতা জবাবদিহির আওতায় আসবে। 

ঢালাওভাবে অধিক বা অধিকাংশকে কর, ভ্যাট শুল্ক ছাড় দেয়ার বিষয়টি স্বচ্ছতা জবাবদিহিতার দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করা উচিত। যারা কর রেয়াত শুল্ক মওকুফ পেয়ে থাকে, তাদের হিসাব সংরক্ষণ যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না। আয়কর, মূসক শুল্ক পরিশোধের উদ্দেশ্য শুধু রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য নয়, এটি সুশাসন, স্বচ্ছতা জবাবদিহিতার ভিত্তি নির্মাণ করে।

নীতি সম্ভাব্যতার সুবিধার্থে আর্থিক নীতিমালা ঘন ঘন পরিবর্তন না করা এবং আইন, বিধি, পদ্ধতি জারিতে কনসিসট্যান্সি থাকা বা রাখা উচিত।

বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অচল অর্থনীতিকে সচল রাখা, বেকার ক্ষুধা রোখা, করোনায় ক্ষতি পুনরুদ্ধার পুনর্বাসন, করোনায় সৃষ্ট মন্দা মোকাবেলা এবং সম্ভাব্য সুযোগের (কৃষি, স্বাস্থ্য খাত, আইটি, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার খাতে অধিক মনোযোগ, দক্ষ জলবল সৃষ্টিসহ বিদেশফেরত বিদেশী বিনিয়োগ ঘরে আনা) সদ্ব্যবহার এবং অনিশ্চিত পরিস্থিতি মোকাবেলার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ, কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন দিকনির্দেশনা ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটে আয়-ব্যয় বণ্টনে তার প্রতিফলন থাকতে হবে।

রাজস্ব আয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনীতির কিছু সূচকের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত হওয়া দরকারএসবের পরস্পর প্রযুক্ততার বিশ্লে­ষণে গেলে স্ববিরোধিতা ফুটে ওঠে। এসব নিশ্চিত হতে গেলে () বিশ্বমন্দা দ্রুত কেটে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের দেশগুলোয় বাংলাদেশের পোশাকের চাহিদা বাড়তে হবে; () প্রবাসী শ্রমিকদের ফিরিয়ে নিতে হবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর; () দেশের মধ্যে সাধারণ মানুষের হাতে নগদ অর্থ থাকতে হবে;  (বাড়তে হবে চাহিদা; (কেউ চাকরি হারাবেন না, কারো বেতনও কমবে না; সর্বোপরি () বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ১২ দশমিক শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৫ দশমিক শতাংশ হতে হবে। অথচ বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির শতাংশ বাড়াতে পাঁচ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে যে অর্থনীতিতে, যখন সেই অর্থনীতিতে করোনাভাইরাস বেসরকারি খাতনির্ভর বেসরকারি বিনিয়োগ এক অর্থবছরেই জিডিপির ২৪ দশমিক শতাংশ থেকে কমে ১২ দশমিক শতাংশ নেমে যাওয়ার মতো ক্ষতি এরই মধ্যে সাধন করেছে এবং  জিডিপি প্রবৃদ্ধির পতাকা দশমিক স্কেল থেকে দশমিক - নামাতে হয়েছে। বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়েই, বিবেচনায় রেখেই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা উচিত।

বাংলাদেশ বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে যাচ্ছে, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে বড় উল্ল­ম্ফন হতে যাচ্ছে ধরনের অনুমান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ভুল বার্তা দিতে পারে। এটি কভিড মোকাবেলায় তহবিল পাওয়ার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বছর আপাতত প্রবৃদ্ধির চেয়ে মানুষের নজর জীবনযাত্রা কর্মসংস্থান কতটা টিকে থাকবে, সেদিকে রাখতেই হবে।  জিডিপির প্রবৃদ্ধি এবার এমনকি দশমিক কিংবা শতাংশ হলেও পরের অর্থবছরে করোনা, সম্ভাব্য বৈশ্বিক মন্দা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা এবং জাতীয় পুঁজি সংবর্ধন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ন্যূনতম কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে - শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়তো খুব কঠিন হবে না।

 

. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সরকারের সাবেক সচিব

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন