বৈশ্বিক অর্থনীতি

কভিডসৃষ্ট ‘দারিদ্র্য মহামারী’ মোকাবেলায় করণীয়

লিনজি কোটস, জন ফ্লোরেটা

গত ২০ বছরের মধ্যে বিশ্বজুড়ে প্রথমবারের মতো হতদরিদ্র বাড়ছে। অনেক দরিদ্র দেশ এখন কভিড-১৯-এর টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে বটে, তবে কবে মহামারী নিয়ন্ত্রণে আসবে, তা অনিশ্চিত। অবস্থায় ২০২১ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বের প্রায় ১৫০ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমনটি হলে দারিদ্র্য বিমোচনে কয়েক দশকের বৈশ্বিক অগ্রগতি ব্যাহত হতে পারে বৈকি। 

অবশ্য কভিডসৃষ্ট দারিদ্র্য বৃদ্ধির প্রবণতা রোধের ক্ষেত্রে বিশ্বের কাছে অনেক উপায়ও রয়েছে। এটা শুধু কেবল অধিক সহায়তা বাড়ানো টিকা বণ্টনেই সীমাবদ্ধ নয়, দারিদ্র্য বিমোচনে আরো কিছু কার্যকর উপায়ও বিদ্যমান। কভিড পরিস্থিতিতে অনেক দেশ, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের দেশগুলো এখন ভীষণ আর্থিক চাপে। কাজেই ব্যাপকতর সামাজিক সুরক্ষা জীবিকাভিত্তিক কর্মসূচি বাড়াতে নিম্ন আয়ের দেশগুলোরও আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন। এসব উদ্যোগ টেকসই সমাধান দেয়, যার ওপর ভিত্তি করে মানুষ ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় সমর্থ হয়। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গবেষকরা মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর পথটির দিকনির্দেশনা দিতে পারে।

বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে সুনির্দিষ্ট সামাজিক নীতি কর্মসূচিগুলোর কার্যকারিতা মূল্যায়নে উচ্চমানের গবেষণা গত দুই দশকে লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে র্যান্ডমাইজড ইভালুয়েশন নামে পরিচিত একটি ব্যাপকতর গবেষণা অ্যাপ্রোচ এমন এক পদ্ধতির অবতারণা করে, যা মেডিকেল ট্রায়ালের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। আর এটি সম্ভাবনাময় উদ্ভাবনগুলোর বাস্তব জীবনের প্রভাব মূল্যায়নে ব্যবহূত হয়।

গবেষণা (র্যান্ডমাইজড ইভালুয়েশন) স্কুলে অধিক মেয়েদের ভর্তি, চাকরি অন্বেষণকারী বেকারদের সাহায্য করা, ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে ভোটারদের অধিক পরিপক্ব সিদ্ধান্ত  নিতে সাহায্যসহ হতদরিদ্রের সংখ্যা কমাতে নানা ধরনের কার্যকর ব্যবস্থা চিহ্নিত করেছে। গবেষণার ব্যাপকতর মূল্য ২০১৯ সালে স্বীকৃত হয়, যখন এর তিনজন পুরোধা গবেষক এমআইটির অভিজিৎ ব্যানার্জি, এস্থার ডুফলো হার্ভার্ডের মাইকেল ক্রেমার নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।

মহামারীতে জীবিকা ব্যাহত হওয়া জনগোষ্ঠীর জীবনে সামাজিক নীতিসংক্রান্ত গবেষণা উন্নয়ন সহযোগিতা কীভাবে বাস্তব ব্যবধান তৈরি করতে পারে, তার একটি উদাহরণ গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচ। অ্যাপ্রোচের কার্যকারিতা ডুফলো ব্যানার্জি খতিয়ে দেখেছেন। তারা দুজন এটা নিয়ে গবেষণা করেছেন। গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচটি মূলত দক্ষিণ গোলার্ধের সবচেয়ে বড় এনজিও বাংলাদেশভিত্তিক ব্র্যাক কর্তৃক উদ্ভাবিত পরিচালিত। এটি একটি  প্রমাণভিত্তিক অ্যাপ্রোচ এবং এতে স্থানীয় প্রেক্ষাপটে ব্যাপকভাবে অভিযোজনযোগ্য হস্তক্ষেপের ওপর জোর দেয়া হয়। বড় কথা, হতদরিদ্র মানুষের বহুমাত্রিক প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যেই এটি প্রণীত।

ব্র্যাকের আলট্রাপুওর গ্র্যাজুয়েশন কর্মসূচির সুফলভোগীদের একটি গরু, সেলাই মেশিন কিংবা নগদ অর্থের মতো আয়বর্ধক সম্পদ জোগানো হয়। এছাড়া তারা পরবর্তী ১৮ থেকে ৩৬ মাস পর্যন্ত সম্পদ থেকে কীভাবে আয় বাড়াতে হয়, তার প্রশিক্ষণ, জীবন দক্ষতা কোচিং, ভোগ সমর্থন, সঞ্চয়ী হিসাবে প্রবেশাধিকার এবং সরকারি সহযোগিতা প্রাপ্তিতে সংযোগ স্থাপনসহ বিভিন্ন ধরনের সমর্থন পায়। 

ব্র্যাক আগে বাংলাদেশের গ্রামীণ দারিদ্র্যের ওপর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের প্রভাব গবেষণা করতে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের (এলএসই) সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। এলএসইর একদল অর্থনীতিবিদের সঙ্গে যৌথভাবে তারা একটি র্যান্ডমাইজড ইভালুয়েশন বা গবেষণা করেছিল। এর ফল ছিল চমকপ্রদ। ওই গবেষণায় উঠে আসে যে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ চার বছরে দরিদ্র সুফলভোগীদের আয় গড়ে ৩৭ শতাংশের বেশি বাড়িয়েছিল। তবে অ্যাপ্রোচ অন্য প্রেক্ষাপটে, অন্য দেশে কার্যকর হতে পারে কিনা, এটি এক বড় প্রশ্ন।

প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণে অবশ্য ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা কার্যক্রম চালানো হয়। গবেষণা অব্যাহত থাকার সময় আলোচ্য কর্মসূচি পরিচালনায় পাকিস্তান থেকে পেরু সাত দেশে কাজ করা বেশ কয়েকটি অলাভজনক সংস্থার কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। এমআইটির আব্দুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশন  ল্যাব (জে-পাল) ইনোভেশনস ফর পভার্টি অ্যাকশন প্রতিটি দেশে ছয়টি র্যান্ডমাইজড ইভালুয়েশন (পড়ুন গবেষণা) কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল। এসব সমন্বিত গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, হতদরিদ্র থেকে মানুষকে উত্তরণের ক্ষেত্রে গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচ অন্যতম কার্যকর গবেষণালব্ধ কর্মসূচি হতে পারে।

প্রায় প্রতিটি দেশেই গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের সুফলভোগীরা তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছিলেন। তারা সফলভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসা চালু করতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং তা থেকে অর্জিত আয় অন্য উপায়ে অর্থ তৈরির কৌশল উন্মোচনে তাদের সাহায্য করেছিল। একই সঙ্গে বাড়তি আশার বোধ সৃষ্টিসহ মানসিক স্বস্তি এনে দিয়েছিল তাদের জীবনে। গবেষণা জরিপে তারা এটা স্বীকার করেছিলেন। ২০২০ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত একটি ফলোআপ গবেষণায় উঠে এসেছিল যে এসব ইতিবাচক প্রভাব কর্মসূচিটি শেষ হওয়ার পর অন্তত দশ বছর পর্যন্ত বজায় ছিল। 

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ব্র্যাক দশমিক মিলিয়নের বেশি পরিবারের কাছে পৌঁছেছে। মজার বিষয় হলো, যেখানে কর্মসূচিটি প্রথম বাস্তবায়ন হয়, সেখানে সুফলভোগীদের উত্তরণ হার (গ্র্যাজুয়েশন রেট) ৯৫ শতাংশের মতো। ২০১৮ সালের তথ্যানুযায়ী প্রায় ৫০টি দেশের ১০০-এর বেশি সংস্থা গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম পাইলটিং করেছে, বাস্তবায়ন করেছে।

গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচের বিশ্বব্যাপী বিস্তার হতদরিদ্রের চক্র ভাঙার পরীক্ষিত সক্ষমতা প্রমাণ করে যে অভিনবমূলক কর্মসূচি প্রণয়ন, গবেষকদের সহায়তায় তা বিস্তৃতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এবং সরকারের সঙ্গে আস্থাশীল অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা সবচেয়ে কার্যকর কর্মসূচি পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে সুফল দেয়। উচ্চমানের গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে যে গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচের কার্যকারিতা ব্র্যাক, জে-পাল এবং অন্য অংশীদারদের ব্যাপারে অর্থায়নের ক্ষেত্রে দাতা সংস্থা সরকারগুলোর আস্থা বাড়িয়েছে। এটা তাদের প্রলুব্ধ করতে সাহায্য করেছে, মডেলটি নাজুক জনগোষ্ঠীর টেকসই জীবিকা সৃষ্টি এবং সামাজিক সুরক্ষা নীতিগুলো অধিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যকর করে তুলতে পারে। কাজেই এখানে নির্ভরতার সঙ্গে অর্থায়ন করা যায়।

প্রত্যক্ষ বাস্তবায়ন অংশীদারদের সহযোগিতার মাধ্যমে ব্র্যাক যেহেতু বিশ্বব্যাপী গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচটি ছড়িয়ে দেয়ার কাজটি করে, সেহেতু প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষা অর্জন করেছে। এসব শিক্ষা তারা সমধর্মী অন্য উদ্যোগ, প্রচেষ্টাগুলোর সঙ্গে বিনিময় করতে পারে। সর্বোপরি, যেকোনো কর্মসূচির কার্যকর প্রভাবের ক্ষেত্রে এর অন্তর্নিহিত প্রধান মূলনীতিগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি প্রেক্ষাপটে মডেলটির লাগসই অভিযোজনের বিষয়টিও। বাংলাদেশে গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামটির ২০ বছরের বিবর্তন যেমনটা দেখিয়েছেযেকানো কর্মসূচির সাফল্যের পেছনে এর মৌলনীতি এবং অব্যাহত আত্মমূল্যায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ওপর কোনো কর্মসূচির প্রভাব যাচাই এবং এর আকার প্রদানকৃত জীবিকা প্যাকেজের মতো তাত্পর্যপূর্ণ উপাদানগুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা অব্যাহত রাখার মাধ্যমে আমরা হতদরিদ্রে থাকা জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নীত করতে পারি।

আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যে উদ্ভাবনমূলক প্রমাণভিত্তিক অ্যাপ্রোচগুলো যখন ভালোভাবে পরিচালিত হয়, তখন আমরা দারিদ্র্য জয় করতে পারি। মহামারী যেহেতু আমাদের কষ্টার্জিত বৈশ্বিক অর্জনগুলো ব্যাহত করার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করছে, সেহেতু নীতিসংশ্লিষ্ট গবেষণা এবং কার্যকর সমাধানগুলো তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা আগের চেয়ে অনেক বেশি অনুভূত হচ্ছে। কাজেই করোনা দুর্যোগসৃষ্ট দারিদ্র্য মোকাবেলার ক্ষেত্রে আমাদের সফল কর্মসূচিগুলো বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। সমরূপভাবে, অব্যাহত গবেষণার মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঘিরে অভিনবমূলক কার্যকর নতুন কর্মসূচিরও বিন্যাস করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্র্যাকের গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচ একটি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

লিনজি কোটস: ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন ইনিশিয়েটিভের ম্যানেজিং ডিরেক্টর

জন ফ্লোরেটা: এমআইটির আবদুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশন ল্যাবের (জে-পাল) গ্লোবাল ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন