আলোকপাত

কভিড-১৯ ও প্রবীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য

ডা. মোজাহারুল হক

ষাটোর্ধ্ব বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে বয়স্ক বা প্রবীণ বা ইংরেজিতে সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে গণ্য করা হয়। স্বাস্থ্য জীবন ব্যবস্থার উন্নতির কারণে বিভিন্ন দেশে মানুষের আয়ু বেড়েছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় মানুষ বেশিদিন বাঁচে। তাদের গড় আয়ু বেশি, সে তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু তুলনামূলকভাবে কম, তার পরেও বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, যা বর্তমানে পুরুষের প্রায় ৭৫, নারীদের ৭১ বছর। বিশ্বে হংকংয়ের মানুষের গড় আয়ু সবচেয়ে বেশি। তারা ৮৫ বছর বাঁচে, জাপানের মানুষের গড় আয়ুও প্রায় ৮৫ বছর, ইউরোপের মানুষের গড় আয়ু ভালো। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকার মানুষের গড় আয়ু ৭৪ বছর, যা অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি। ভারতের মানুষের গড় আয়ু ৭০-এর মতো  (সূত্র ইউএনডিপি)

জাপানে জনসংখ্যার প্রায় ২৮ শতাংশ, যাদের বয়স ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে। এর পরই ইতালি, হংকংয়ের ১৬ শতাংশ, মানুষ বাঁচে ৬৫ বছরের বেশি। সবচেয়ে বেশি বয়স্ক লোক চীনে। এটা মনে করা হয় ২০৫০ সালে বিশ্বের ২২ শতাংশ জনগোষ্ঠীর বয়স হবে ষাটোর্ধ্ব, যা ২০১২ সালে ছিল ১১ শতাংশ  

বাংলাদেশে প্রায় ৭৫ শতাংশ প্রবীণ লোক আছে, যা সংখ্যায় প্রায় কোটি ২৫ লাখ হবে। ধারণা করা হয়, ২০৫০ সালে তা ২০ শতাংশ হয়ে প্রায় চার কোটি দাঁড়াতে পারে। অনুমান করা হয়, বাংলাদেশে ১০ জনে একজন প্রবীণ; যা ক্রমে বাড়ছে।

যেহেতু প্রবীণ জনগোষ্ঠী একটি বড় জনগোষ্ঠী এবং এটি ক্রমবর্ধমান, সেহেতু বাংলাদেশের উচিত তাদের জন্য একটি কল্যাণমুখী প্রবীণ নীতি বাস্তবায়ন করা। এটা করা অত্যন্ত জরুরি। প্রবীণ জনগোষ্ঠী নানা রকম অবহেলাসহ অন্যান্য দমন-নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নিয়ত। এসব বেশি হচ্ছে পরিবারের মধ্যে থেকে, তাদের অধিকার সম্মান রক্ষা এখন যেমন আইনের মাধ্যমে করা হচ্ছে না, পাশাপাশি অন্যান্য দেশের মতো তাদের অধিকার সুযোগ-সুবিধাগুলো আজও নিশ্চিত করা হয়নি। যেমন তাদের আলাদা জাতীয় পরিচয়পত্রসহ স্বাস্থ্য সুবিধা এবং রেল, নৌযান বাসে যাত্রী সুবিধা কম মূল্যে ভাড়া পরিশোধের ব্যবস্থা সুবিধাগুলো বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে তারা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী এবং প্রায় সবাই কোনো না কোনো রোগে যেমন ভোগেন, তাদের স্মৃতিশক্তি, শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তিসহ চলাচলের শক্তিও সীমিত।  বিশেষ করে তাদের অধিকাংশই সংক্রামক অসংক্রামক রোগেও ভোগেন। 

অসংক্রামক রোগের মধ্যে ডায়াবেটিস, হূদরোগ, শ্বাসযন্ত্রের রোগগুলো, স্ট্রোকসহ প্যারালাইসিস অন্যতম। বর্তমানে কভিড-১৯ বা নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যে সংখ্যায় মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের মধ্যে সংখ্যা হারে  প্রবীণরা অন্যতম। তারা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করোনাকালে।

বাংলাদেশে বয়সভিত্তিক মৃত্যুর সংখ্যা লক্ষ করলে দেখা যাবে ৬০ শতাংশ মৃত্যু হয়েছে প্রবীণ জনগোষ্ঠী মানুষের। সংখ্যায় মৃত্যু ইউরোপের দেশগুলোর প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যেও দেখা গেছে বেশি। বেশি বয়স্ক লোকেরা মারা গেছেন সব দেশেই। পুরুষের মৃত্যুসংখ্যা নারীদের চেয়ে বেশি লক্ষণীয়। সংক্রমণের বেলায়ও তা-ই। এর একটি কারণ আমাদের দেশের নারীরা অন্তর্মুখী বের হন কম প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে। তাছাড়া পর্দাও তাদের সুরক্ষা দেয়। নারীরা স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারেও আন্তরিক।

বাংলাদেশ প্রথম নভেল করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীটি একজন প্রবাসী ছিলেন, তার মাধ্যমে রোগটি ছড়ায় এবং প্রথম যে দুজন মৃত্যুবরণ করেন, তারাও প্রবীণ মুসল্লি ছিলেন এবং মসজিদে সংক্রমিত হয়েছেন, যাদের একজন মসজিদের ইমাম।     

যদিও ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম এর সংক্রমণ ধরা পড়ে, বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয় মার্চ এবং প্রথম মৃত্যু ১৮ মার্চ। ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে বিশ্ব মহামারী হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং বিশ্বের দেশগুলোয় এই মহামারী নিয়ন্ত্রণের জরুরি পরামর্শ দিকনির্দেশনা দেয়। পরামর্শগুলোর উল্লেখযোগ্য দিক ছিল কী কী উপসর্গ হলে এই রোগ হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে এবং এই রোগের কী পরীক্ষা বা টেস্ট করতে হবে। উপসর্গগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জ্বর, শুকনো কাশি, মাথাব্যথাসহ সারা শরীর ব্যথা।

শ্বাসকষ্ট হলে তাকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে অক্সিজেন দেয়াসহ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হবে পরামর্শও ছিল। অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে ছিল হাত ধুতে হবে, দূরত্ব বজায় রাখতে হব, বাইরে গেলে মাস্ক পরতে হবে। জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। যতটা সম্ভব চলাচল সীমিত রাখতে হবে এবং ঘরে থাকাই উত্তম।

বিশেষ করে প্রবীণ অসুস্থদের অবশ্যই ঘরে থাকতে হবে, সেখানেই তাদের যত্ন সেবা নিশ্চিত করতে হবে। আক্রান্ত হলে অবশ্যই হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।  বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এই পরামর্শ মেনে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ এনেছে এবং আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসছে। অনেক মৃত্যু ঠেকিয়েছে।

আজ পর্যন্ত এই রোগের কোনো চিকিৎসা যেমন নেই, তেমনি রোগ প্রতিরোধের কোনো টিকাও আবিষ্কৃত হয়নি। তবে টিকা আবিষ্কারের জোর প্রচেষ্টা চলছে।

স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের প্রবীণ নাগরিকদের যেসব অধিকার রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা, তা এখনো নিশ্চিত হয়নি। ২০১৩ সালে করা প্রবীণ নীতিটি আজও বাস্তবায়ন হয়নি। প্রবীণরা নানা ক্ষেত্রে সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এবং প্রবীণদের স্বীকৃত ন্যায্য অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

দেশের প্রায় কোটি ২৫ লাখ প্রবীণ রোগীর জন্য আলাদা কোনো প্রবীণ হাসপাতাল নেই। কোনো বড় হাসপাতালে প্রবীণদের জন্য জেরিয়াট্রিক ওয়ার্ড নেই বা বা সিট নেই, যেখানে তারা প্রয়োজনে অগ্রাধিকার পাবেন।  

প্রবীণদের চিকিৎসক (জেরিয়াট্রিক স্পেশালিস্ট) নেই বললেই চলে। বিশেষায়িত নার্স প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নেই। এই বৈষম্য দূর করা দরকার। কারণ তাদের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে, বিশেষত চিকিৎসক নার্সের সেবার মাধ্যমে, স্বাস্থ্য খাতে বৈষম্য হ্রাস করতে হলে স্বাস্থ্যসেবার কাউকে অবহেলা করা যাবে না, প্রবীণদের তো নয়ই, বরং নীতি হবে লিভ নো ওয়ান বিহাইন্ড। তাছাড়া সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সবার জন্য মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি আসছে বাংলাদেশ। বর্তমান কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে প্রবীণদের স্বাস্থ্যবিধি যেমন মেনে চলতে হবে, পাশাপাশি পরিবার যে সমাজে প্রবীণরা বাস করেন, তাদেরকে সামাজিক সুরক্ষা, সচেতনতা বৃদ্ধি, উদ্দীপনাসহ সব রকম প্রাক-চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা রোগ এড়াতে পারেন বা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করতে পারেন।

সরকারের নিশ্চিত করতে হবে তারা স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলছেন এবং নিশ্চিত করতে হবে উপসর্গ দেখা দিলে বা আক্রান্ত হলে বিশেষ ব্যবস্থায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের পরীক্ষার ব্যবস্থাসহ হাসপাতালে স্থানান্তর সেবা প্রদান করা। মনে রাখতে হবে তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি এবং তাদের জন্য ভেন্টিলেটর, আইসিইউ অক্সিজেন প্রাপ্তি নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। এখানে কোনো অবহেলা তাদের মৃত্যুঝুঁকিতে ফেলবে। ব্যাপারে সরকারের প্রবীণদের জন্য অগ্রাধিকার নিশ্চিত করে নির্দেশনা দেয়া উচিত। যেহেতু টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে, টিকার প্রাপ্তির ব্যাপারে স্বাস্থ্যকর্মী প্রবীণদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে টিকা পাওয়ার বিষয়টি নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখা উচিত। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় প্রবীণ নীতি বাস্তবায়ন হয়েছে অনেক আগেই। শ্রীলংকা ব্যাপারে অনেক এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের উচিত ২০১৩ সালের প্রবীণ নীতিটি অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা, এটিকে সাত বছর ঝুলিয়ে রেখে, প্রবীণদের তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে তাদের প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে। কভিড  আক্রান্ত রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠলে পরিবারকে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকে বিবেচনায় রাখতে হবে, পাশাপাশি তাদের অন্যান্য রোগের সঠিক সুচিকিৎসা করাতে হবে। মনে রাখতে হবে তাদের জন্য দরকার সার্বক্ষণিক স্বাস্থ্যসেবা যত্ন। 

কভিড-১৯ মহামারী বিশ্বের দেশগুলোর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার দিকগুলো জনগণের কাছে উন্মোচন করেছে। প্রবীণদের মৃত্যুহার সরকারগুলোকে তাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব নিশ্চিত করতে সাহায্য করেছে। প্রবীণ নাগরিকরা যে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, সেটা এখন সবাই জানে। উন্মোচিত করেছে এর সীমাবদ্ধতা। ভেন্টিলেটর আইসিইউর অভাবে প্রচুর প্রবীণের মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। বছর জাতিসংঘের ৭৫তম বার্ষিকী আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের ৩০তম বার্ষিকী চলছে। ২০২০ থেকে ২০৩০ সালকে ডিকেড অ্যান্ড হেলদি এজ হিসেবে পালন করা হবে বাংলাদেশেও। দশকটিতে প্রবীণ স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে তাদের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিরাপদ খাদ্য যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি অগ্রাধিকার হিসেবে সুলভে বা বিনা ব্যয়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিও নিশ্চিত করতে হবে।

প্রথমেই বছর যেটা করতে হবে, ২০১৩ সালের প্রবীণ নীতি বাস্তবায়ন করা। ঢাকায় প্রবীণ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি প্রতিটি জেলা-উপজেলা হাসপাতালে সার্বক্ষণিক আলাদা ওয়ার্ড বা বেড নিশ্চিত করতে হবে। তাদের যোগ্যতা অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কর্মে নিয়োগ দিতে হবে। সক্ষম প্রবীণদের জ্ঞান অভিজ্ঞতা কোনো অংশে কম নয়, এতে দেশ উপকৃত হবে। প্রবীণদের অবসর বিনোদনের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি রাষ্ট্রের দায়িত্ব আর এসব কাজে প্রবীণদের সম্পৃক্ত করেই সিদ্ধান্তগুলো নিতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রবীণদের অবহেলা করে সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়, তাদের জ্ঞান অভিজ্ঞতা রাষ্ট্রের সম্পদ হিসেবে চিন্তা করে সক্ষম প্রবীণদের রাষ্ট্রের উন্নয়নে সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগানো রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক। 

আগামী দিনের প্রবীণদের জন্য এখনই ভাবতে হবে।

 

ডা. মোজাহারুল হক: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা

প্রতিষ্ঠাতা, পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন