এলপিজির বাজার

প্রতিযোগিতা বাড়লেও সুফল পাচ্ছেন না গ্রাহক

আবু তাহের

আবাসিকে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহারে উৎসাহিত করছে সরকার। বন্ধ রাখা হয়েছে বাসা-বাড়িতে নতুন গ্যাস সংযোগ। পরিস্থিতিতে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় খাতে বিনিয়োগ করেছে ২০টির বেশি কোম্পানি। যদিও প্রতিযোগিতা বাড়লেও দামের ক্ষেত্রে এর সুফল পাচ্ছেন না গ্রাহক।

দেশে ভোক্তা পর্যায়ে ১২ লিটার ওজনের প্রতি সিলিন্ডার এলপিজির দাম ৭০০ থেকে কমিয়ে ৬০০ টাকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) কিন্তু বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সরবরাহ করা একই ওজনের গ্যাসের দাম সর্বোচ্চ ৯৫০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে গ্রাহকদের কাছ থেকে। কোম্পানি স্থানভেদেও রয়েছে দামের পার্থক্য। সব মিলিয়ে ক্রমবর্ধমান এলপিজির বাজারে দামের ক্ষেত্রে এক ধরনের নৈরাজ্য বিরাজ করছে বলে অভিযোগ করেছেন ভোক্তারা।

রাজধানীর বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা মো. ইমরান হোসেন। বাসার জন্য প্রতি মাসে ১২ কেজি ওজনের এক সিলিন্ডার এলপি গ্যাস কেনেন তিনি। সরকার এলপিজির দাম কমিয়েছে এমন সিদ্ধান্ত জেনেই চলতি মাসে খুচরা বিক্রেতাকে নির্ধারিত দাম দেন তিনি। কিন্তু বিক্রেতা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ২০০ টাকা বেশি রাখায় রীতিমতো বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। খুচরা বাজারে বিক্রেতাদের এমন আচরণে হতাশ গ্রাহক বলেন, সরকার যেখানে ৬০০ টাকায় এলপিজি দিচ্ছে, সেখানে খুচরা বাজারে বেসরকারি এলপিজি কেন ১৫০-২০০ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হবে? তাহলে দাম কমিয়ে গ্রাহকদের সুফলটা কোথায়?

একই হতাশার কথা জানান মিরপুরের আফজাল হোসেন। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি মূল্যে এলপিজি কিনতে নারাজ তিনি। ঠিক কী কারণে বেসরকারি গ্যাসের দাম কমানো যাচ্ছে না, প্রশ্ন রাখেন এই গ্রাহক।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীতে বিভিন্ন কোম্পানির এলপি গ্যাস সিলিন্ডার জায়গা বিশেষে ভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে। মগবাজারে ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ৮৫০-৯০০ টাকায়, সেখানে মিরপুরে বিক্রি হচ্ছে হাজার টাকায়। আবার একই কোম্পানির গ্যাস গাজীপুরে বিক্রি হচ্ছে ৯৫০ টাকায়। যদিও পরিবেশক পর্যায়ে ৭০০ টাকায় গ্যাস সরবরাহ করছে উৎপাদক কোম্পানি। গ্যাসের এমন মূল্য পার্থক্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে গ্রাহকদের মধ্যে।

বেসরকারি এলপিজির দামে গ্রাহকদের অসন্তুষ্টির বিষয়ে জানতে চাইলে ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের পরিচালক এবং এলপিজি অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়াব) সভাপতি আজম জে চৌধুরী বলেন, বর্তমানে এলপিজির যে দাম রয়েছে, সেটা যে দাম হওয়ার কথা তার চেয়ে অনেক কম। অপারেটররা নিজেদের ভেতরে প্রতিযোগিতা করে এলপিজির দাম কমিয়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু পরিবেশকরা গ্রাহকের কাছ থেকে বাড়তি টাকা লুফে নিচ্ছে।

তিনি বলেন, গ্রাহকদের কাছে এলপি গ্যাস কত কম মূল্যে পৌঁছানো যায় সেটা নিয়ে আমরা সরকারের সঙ্গে কাজ করছি। একটাঅটোমেটিক প্রাইসিংকরা যায় কিনা বা সিলিন্ডারের গায়ে মূল্য নির্ধারণ করা যায় কিনা তা নিয়ে কাজ চলছে। এটি হলে মধ্যস্বত্বভোগীরা গ্রাহকদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় করতে পারবে না।

এদিকে পরিবেশকরা বলছেন, তারা সংশ্লিষ্ট কোম্পানি থেকে ৭০০ টাকা মূল্যে ১২ কেজি এলপি গ্যাস কেনেন (পরিবহন খরচসহ) এরপর একই দামে খুচরা বাজারে সেটি বিক্রি করেন। খুচরা বিক্রেতারা সেটি আবার ১০০-১৫০ টাকা লাভ রেখে বিক্রি করেন। তবে বাজারে প্রতিযোগিতা হচ্ছে মূলত একই খুচরা ব্যবসায়ী চার-পাঁচটা কোম্পানির এলপি গ্যাস বিক্রি করায়। এক্ষেত্রে দরকষাকষি করে তারা বিভিন্ন কোম্পানির পরিবেশকদের কাছ থেকে এলপিজি কিনে বাজার ছাড়া বেশি দামে বিক্রি করছে।

রাজধানীর মগবাজারে ওমেরা এলপিজির ডিস্ট্রিবিউটর আহমেদ এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার মো. লতিফ জানান, সরকারি এলপিজির দাম কমায় গ্রাহকরা আমাদের কাছে প্রথমেই দাম নিয়ে কথাকাটাকাটি করছেন। কিন্তু সরকারি এলপিজির সঙ্গে বেসরকারি এলপিজির বাজারের বিষয়টি তারা বুঝতেই চাচ্ছেন না। অনেকে এলপিজির দামের বিষয়টি নিয়ে ট্রিপল নাইনে কল দেয়ার হুমকিও দেখাচ্ছেন।

দেশে এলপিজির বাজারের বড় একটা অংশ বসুন্ধরার দখলে আছে। কোম্পানিটির সরবরাহ করা ১২ লিটারের প্রতি সিলিন্ডার এলপি গ্যাস খুচরা পর্যায়ে ৮০০-৯৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একই দামে বিক্রি হচ্ছে জি-গ্যাসের এলপিজি। এছাড়া ওরিয়নের গ্যাস ৮০০-৮৫০ টাকা, বেক্সিমকোর গ্যাস ৯০০ টাকা, টোটাল গ্যাস ৮০০-৮৫০ টাকা, নাভানা ৯০০-৯৫০ টাকা, পেট্রোম্যাক্স ৮০০-৮৫০ টাকা এবং ফ্রেশ এলপিজি ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা পর্যায়ে।

এদিকে ঢাকার বাইরে যশোরে বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের ১২ কেজি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ৭৮০ টাকা, যমুনা ৮০০ টাকা, টোটাল ৮০০ টাকা, জি-গ্যাস ৮২০ টাকা, বেক্সিমকো ৮৫০ টাকা। রাজশাহীতে বিভিন্ন কোম্পানির এলপি গ্যাস খুচরা পর্যায়ে ৯০০-১০৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

যশোরের এলপিজি ব্যবহারকারী মো. বুলবুল ইসলাম জানান, গত মাসে ১২ কেজি সিলিন্ডার গ্যাস কিনেছিলাম ৯০০ টাকায়, কোন কোম্পানির গ্যাস কিনেছিলেন বলতে না পারলেও মাসে বসুন্ধরা কোম্পানির এলপি গ্যাস কিনেছেন ৮৫০ টাকায়। তবে গত মাসের চেয়ে দাম কমায় বেশ খুশি তিনি।

দেশের বিভিন্ন এলাকার এলপিজি গ্রাহকদের কাছে দামের বিষয়টি জানতে চাইলে তারা জানান, বিভিন্ন সময়ে বিক্রেতারা নানা কারণ দেখিয়ে ১০০-১৫০ টাকা পর্যন্ত বেশি দাম নেন। সব কোম্পানির এলপিজি যদি সরকারের নির্ধারিত দামে বিক্রি হতো, তাহলে গ্রাহকরা উপকৃত হতেন।

সরকারি এলপিজির চেয়ে বেসরকারি এলপিজির মূল্য কেন এতটা বেশি জানতে চাইলে জি-গ্যাস এলপিজির জেনারেল ম্যানেজার (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) আবু সাঈদ রাজা বলেন, সরকারি কোম্পানি যে এলপিজি বাজারজাত করে, সেটা সরকার নিজস্ব রিফাইনারি এবং দেশীয় খনি থেকে উপজাত হিসেবে পায়, যেখানে খরচটা কম হয়। অন্যদিকে বেসরকারি কোম্পানিগুলো সৌদি আরামকো কোম্পানির মূল্যের ওপর নির্ভর করে দাম নির্ধারণ করে। এছাড়া বিপিসি যে এলপিজি বাজারে সরবরাহ করে তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। ফলে মার্কেটে সেটার দামেও খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। অন্যদিকে বেসরকারি এলপিজি কোম্পানিগুলো আমদানিনির্ভর হওয়ায় সবকিছু খরচ বিবেচনা করে বাজারে এলপিজির দাম নির্ধারণ করতে হয়।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে এলপিজির চাহিদা ছিল ৪৪ হাজার ৯৭৪ টন। নয় বছরের ব্যবধানে চাহিদা লাখ ১৩ হাজার টনে এসে দাঁড়িয়েছে।

আমদানির তথ্য অনুযায়ী, ৪০ হাজার টন এলপিজি সরবরাহ নিয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ বাজার নিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে বসুন্ধরা গ্রুপ। এরপর ১৩ শতাংশ বাজার নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে ওমেরা এলপিজি। ১১ শতাংশ সরবরাহ নিয়ে তৃতীয় স্থানে আছে বিএম এলপি গ্যাস। এছাড়া যমুনা শতাংশ, পেট্রোম্যাক্স , লাফস গ্যাস , টোটাল গ্যাস , জি-গ্যাস , নাভানা এলপিজি , বেক্সিমকো এলপিজি , ইউনিভার্সাল এলপিজি ইউরোগ্যাস এলপিজি শতাংশ বাজার দখলে রেখেছে। পাশাপাশি দেশের বার্ষিক মোট চাহিদার মাত্র ১৬ হাজার টন এলপিজি সরবরাহ করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন