ন্যাশনাল প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট পলিসি-২০২০

সম্ভাবনার সদ্ব্যবহারে পরিবেশ ও কমপ্লায়েন্স ইস্যুকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে

দেশের সার্বিক উন্নতির ফলে গার্মেন্ট, ওষুধসহ সব ধরনের পণ্যে এখন প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। দেশে কাঠের বিকল্প ফার্নিচার হিসেবে প্লাস্টিকসামগ্রী দিয়ে এখন টেবিল-চেয়ার থেকে শুরু করে গৃহে ব্যবহারের সামগ্রীও উৎপাদন হচ্ছে। এসব পণ্য ব্যবহারে দিন দিন জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। ধারণা করা হচ্ছে, মানুষ যতই আধুনিক হবে ততই সবকিছুতে প্যাকেটজাত পদ্ধতির চাহিদা বাড়বে। ফলে দেশ-বিদেশে প্লাস্টিক পণ্যের চাহিদা আরো বাড়বে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পর গত অর্থবছর (২০১৮-১৯) হাজার ২০০ কোটি টাকার প্লাস্টিক পণ্য রফতানি হয়েছে, যার মধ্যে পরিবেশ দূষণকারী হিসেবে পরিচিত প্লাস্টিক বর্জ্য রফতানির পরিমাণ ছিল অন্তত শতকোটি টাকা। পাঁচ বছর আগের তুলনায় গত বছর প্লাস্টিক পণ্য খাতে রফতানি বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। প্লাস্টিক খাতের সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়ে ন্যাশনাল প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট পলিসি-২০২০-এর সপ্তম খসড়া প্রকাশ করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়েছে, বিপুল সম্ভাবনার খাত হলেও বাংলাদেশের প্লাস্টিক শিল্পের বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠার সুচিন্তিত নকশা কৌশলের ঘাটতি রয়েছে। খাতের টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বড় বাধার মধ্যে আছে মান নিয়ন্ত্রণ, উদ্ভাবনী প্রযুক্তি, ছাঁচ তৈরির ব্যবস্থা, প্লাস্টিক বর্জ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনা, ব্যবসাবান্ধব কর শুল্কের ব্যবস্থা। -জাতীয় কৌশলগত পদ্ধতি স্বতন্ত্র প্রতিযোগিতামূলক শক্তি ছাড়া বাংলাদেশে তৈরি প্লাস্টিক পণ্যগুলোর বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন সরকারি বেসরকারি প্লাস্টিক খাতসংশ্লিষ্টরা। আমাদের দেশে প্রধানত ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জাপান, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করা হয়। প্লাস্টিকসামগ্রী তৈরির কাঁচামাল তৈরি হয় পেট্রলের বর্জ্য থেকে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিলে চট্টগ্রাম বন্দরে পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স নির্মাণ করা যেতে পারে। আমরা নিজেরা যদি কাঁচামাল উৎপাদন করতে পারি, তবে একদিকে আমদানি ব্যয় হ্রাস পাবে, পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয় কমবে। পরনির্ভরতা কমার পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। দেশের অর্থনীতির সম্ভাবনাময় খাতকে এগিয়ে নিতে সরকারি পর্যায়েও নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে। প্লাস্টিক পণ্যে বৈচিত্র্য এনে দেশী-বিদেশী ভোক্তাদের মন কীভাবে জয় করা যায়, তা নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক গবেষণাও প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, প্লাস্টিক শিল্প শ্রমঘন শিল্প। শ্রমঘন হওয়ায় প্লাস্টিক শিল্পে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। ব্যবহারের ক্ষেত্র বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যোগ হচ্ছে উৎপাদনের নতুন নতুন মাত্রা। ফলে বাড়ছে নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র। শিল্পের উৎপাদন, রফতানি প্রক্রিয়া, বিপণন ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে ৪০ লাখের বেশি জনশক্তি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। প্লাস্টিক শিল্প এখন একটি সম্ভাবনার নাম। প্লাস্টিক কখনো বর্জ্য পণ্য হয় না। রিসাইক্লিং করে আবার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তাই সাশ্রয়ী, সহজ ব্যবহারযোগ্য, কম ঝুঁকি, ডিজাইন, টেকসই দৃষ্টিনন্দন নকশার কারণে আধুনিক জীবনযাপনের সঙ্গী হয়ে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকসামগ্রী এখন বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।

দেশের চাহিদা অনুযায়ী পলিমার উৎপাদনে পর্যাপ্ত প্রতিষ্ঠান নেই। আমদানির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে। তবে একে শিল্প বিশেষজ্ঞরা অসুবিধা হিসেবে দেখছেন না। বরং সস্তা শ্রম আর পর্যাপ্ত রিসাইকেলিং প্রতিষ্ঠান দেশের প্লাস্টিক শিল্পকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা খাতের অন্যতম প্রতিবন্ধক। দক্ষ কর্মী, ছাঁচ পরিকল্পনা প্রস্তুতকরণ, গুণগত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা, কারিগরি পরামর্শক সহায়তা, যন্ত্রপাতির যথাযথ ব্যবহার, প্লাস্টিক বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে খাতে দুর্বলতা লক্ষণীয়। তাছাড়া মূলধনের অভাবের বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য। এসএমই ঋণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তাদের অনেক ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। এছাড়া পরিবেশগত বিষয়ে প্লাস্টিক শিল্পের নেতিবাচক ইমেজ শিল্প প্রসারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। প্লাস্টিক শিল্প আমাদের অর্থনীতিতে সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। খাতের প্রসারের মাধ্যমে রফতানি আয়কে যেমন আরো বহুগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব, সেই সঙ্গে আরো বেশি লোকের কর্মসংস্থানও সম্ভব। এজন্য চাই সরকারের উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা। বিশেষ করে ক্ষুদ্র মাঝারি প্লাস্টিক শিল্পোদ্যোক্তাদের এসএমই ঋণের মাধ্যমে মূলধনের জোগান, প্লাস্টিক পণ্যের পরিবেশগত স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণসহ যে সমস্যাগুলো বিদ্যমান, তা দূর করার যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ বাস্তবায়ন করা হলে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়বে; সেই সঙ্গে বাড়বে রফতানি আয়। এগিয়ে যাবে দেশ। তৈরি হবে শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত। 

প্লাস্টিক শিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ন্যাশনাল প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট পলিসি-২০২০ দ্রুত প্রণয়ন বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বছরের পর ধরে ঝুলে রয়েছে সংশ্লিষ্ট নীতি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী এটি সপ্তম খসড়া। এভাবে ঝুলিয়ে রাখা কোনো শিল্পের জন্যই সুখকর নয়। একই সঙ্গে প্লাস্টিক শিল্পনগরী পূর্ণ রূপদান গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি রাখতে হবে পরিবেশের ইস্যুতে। সর্বনিম্ন পর্যায়ে এর ক্ষতি নির্দিষ্ট রাখতে হবে। পরিবেশ সার্বিক কমপ্লায়েন্সকে গুরুত্ব দিয়ে প্লাস্টিক শিল্পনগরীসহ প্লাস্টিক শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াসংক্রান্ত কৌশলগত নীতিমালা দ্রুত চূড়ান্ত করা প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন