নিখাদ সমসাময়িক

আইজাক আজিমভ ও সত্যজিৎ রায়

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

যারা প্রোফেসর শঙ্কুকে চেনেন, তারা সবাই যে ডক্টর সুজান কলভিনকে চিনবেন, এমন কোনো কথা নেই। শঙ্কু যেমন বৈজ্ঞানিক, সুজানও তেমন। সুজান যে মহিলা, তা তো নামেই বোঝা যাচ্ছে। আমেরিকার একটি সংস্থা ‘ইউএস রোবটস অ্যান্ড মেকানিক্যাল ম্যান, ইন্ক্.’-এ কাজ করেন সুজান। তার ডেজিগনেশন রোবোসাইকোলজিস্ট।
অনেক কল্পবিজ্ঞানপ্রেমী আছেন, যারা অনুমান করেন সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট কল্প-বৈজ্ঞানিক চরিত্র অধ্যাপক ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু বুঝি সত্যজিতের পিতৃদেব সুকুমারের গল্পের অভিযাত্রী বৈজ্ঞানিক হেঁশোরাম হুঁশিয়ার কিংবা গবেষক বিজ্ঞানী প্রোফেসর নিধিরাম পাটকেলের আদলে তৈরি। আরো একটা থিওরি নতুন উঠে এসেছে, তা হলো সত্যজিতের কাকা সুবিনয় রায় চৌধুরীর লেখা কয়েকটি গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আত্মম্ভরী ঘোষের সঙ্গে নাকি ত্রিলোকেশ্বরের অনেক সাদৃশ্য পাওয়া যায়। কিন্তু যে যা-ই বলুন, শঙ্কুকে তার পাঠকরা যতই একজন বয়স্ক, টাকমাথা, সাদা দাড়ি-গোঁফের ঋষিতুল্য মানুষ হিসেবে দেখুন, মার্কিন রোবোসাইকোলজিস্ট সুজান কলভিনের সঙ্গে শঙ্কুর অনেক সাদৃশ্য কিন্তু বড়ই প্রকট হয়ে ধরা পড়ে, যদি এই দুজনের জীবন খতিয়ে দেখা যায়।
সত্যজিতের শঙ্কু তার ডায়েরিতে লিখেছেন, তিনি ম্যাট্রিক পাস করেছেন ১২ বছর বয়সে, চৌদ্দোয় আইএসসি আর ষোলোয় ফিজিকস ও কেমিস্ট্রিতে ভালো অনার্স নিয়ে বিএসসি। এই ১৬ বছর বয়সেই এক কাণ্ড করেছিলেন সুজান, ডক্টর অ্যালফ্রেড ল্যানিংয়ের একটি সাইকো-ম্যাথ সেমিনারে উপস্থিত থাকার পর ‘প্র্যাকটিক্যাল অ্যাসপেক্টস অব রোবোটিকস’ শীর্ষক একটি পেপার লিখে বিজ্ঞানী মহলে হইচই ফেলে দেন।
সুজান কলভিন জন্মসূত্রে রুশ, কিন্তু বছর তিনেক বয়সে পরিবারের সঙ্গে আমেরিকায় চলে এসে আমেরিকান হিসেবেই জীবন অতিবাহিত করা বিশ্ববিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক আইজাক আজিমভের অনেকগুলো গল্পের নায়িকা। নায়িকা বলা অবশ্য ঠিক হলো না। কারণ তার বিপরীতে কোনো নায়ক কখনো ছিল না। সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ নেই। তাই সুজান কলভিনকে গল্পগুলোর ‘প্রোটাগনিস্ট’ বলেই বোঝাতে হচ্ছে।
রোবট বিশেষজ্ঞ, সুন্দরী যুবতী বৈজ্ঞানিক সুজান শঙ্কুর মতো ডায়েরি লিখতেন না ঠিকই। তিনি বিভিন্ন ঘটনা নিজ মুখে বলতেন এক সাংবাদিককে। আর সেই সাংবাদিক লিখতেন রোবটদের বিভিন্ন কাণ্ড সম্পর্কে গল্পের মতো করে। ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর জীবন যেমন স্ত্রী-ভূমিকা বর্জিত, প্রায় সেই রকমই পুরুষ-ভূমিকা বর্জিত জীবন সুজানের। আজিমভের রোবট-বিষয়ক প্রায় প্রতিটি গল্পে একটি করে বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন রোবট দেখা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কলভিন বা অন্য কাউকে সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করতে হয়। সত্যজিতের বিভিন্ন গল্পে যে সামান্য কয়েকটি রোবট দেখা গেছে, তাদের মধ্যেও কিন্তু কতকটা ওই ধরনের বৈশিষ্ট্যই ফুটে উঠত। এই বৈশিষ্ট্য বা বিশেষত্ব কিন্তু রোবটের নির্মাতারা আরোপ করেননি। সত্যি বলতে কি, এই বৈশিষ্ট্যগুলো ঠিক রোবটসুলভও নয়। বরং এগুলোকে মানবিক বলা যায়। সত্যজিতের বিধুশেখর যেমন নিজ থেকে শঙ্কুকে নিয়ে চলে গিয়েছিল অন্য এক গ্রহে বা অনুকূল যেমন বুঝতে পেরেছিল কী করে তার মনিবকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে। এগুলো তাদের মধ্যে ‘প্রোগ্রামড’ হয়ে থাকার কথা ছিল না। ঠিক এইভাবেই আজিমভ-এর ‘এসকেপ!’ গল্পের রোবট ‘দ্য ব্রেন’ মহাকাশে গিয়ে নভশ্চরদের সঙ্গে ঠাট্টা-মশকরা শুরু করে দিয়েছিল বা ‘লায়ার!’ গল্পের হারবির মধ্যে দেখা যায় টেলিপ্যাথিক অনুভূতি; কিংবা ছোট্ট মেয়ে গ্লোরিয়ার সঙ্গে ‘রব্বি’ গল্পের রোবটের এক অদ্ভুত স্নেহের সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায়।
বিভিন্ন সাক্ষাত্কারে সত্যজিৎ জানিয়েছেন, সায়েন্স ফিকশনের সঙ্গে তার পরিচয় ১০ বছর বয়স থেকে। প্রায় একই রকম বয়স থেকেই কল্পবিজ্ঞানের ভক্ত হয়ে ওঠেন আজিমভ। তার লেখালেখির শুরু ১১ বছর বয়সে। সেই অভ্যাস এমনই আকার ধারণ করেছিল যা দেখে আইজাকের বাবা ছেলেকে একটি টাইপরাইটার কিনে দিয়েছিলেন। বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈব-রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন আজিমভ, তবে তার আসল পরিচয় কিন্তু একজন যথার্থ, সফল ও জনপ্রিয় কল্পবিজ্ঞান লেখক হিসেবে, সেই বিচারে সত্যজিৎ রায় মানুষটির কাজকারবার ছিল একেবারে আলাদা। মূলত চলচ্চিত্র নির্মাতা হয়েও তাকে নিয়মিত সাহিত্য সৃষ্টি করতে হয়েছে সন্দেশ পত্রিকার কিশোর-বয়স্ক পাঠক-পাঠিকাদের জন্য। ফলে আজিমভ সাহেব যেমন অদৃশ্য হওয়া, আয়ুবর্ধক, নর-নারীর সম্পর্ক, মস্তিষ্ক-বিষয়ক, ভিনগ্রহী, গ্রহান্তর গমন প্রভৃতি সায়েন্স ফিকশনের প্রায় প্রতিটি শাখা তার লেখায় ব্যবহার করতে পেরেছেন, সেই সুযোগ সত্যজিতের ছিল না। বলতে গেলে প্রফেসর শঙ্কুর চরিত্রটি তার বাবার গল্পের নিধিরাম বা হেঁশোরাম, কিংবা কাকার লেখা কাহিনীর আত্মম্ভরী ঘোষের মতো কমিক্যাল বৈজ্ঞানিক হিসেবেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন, উনিশশো বিরাশি সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সম্প্রচারিত একটি সাক্ষাত্কারে সত্যজিৎ রায় বলেন, ওই গল্পটি লেখার পর থেকে তিনি আবার নতুন করে সমসাময়িক বিদেশী সায়েন্স ফিকশন পড়তে শুরু করেছিলেন। সাহিত্যের এ শাখার প্রতি তার পুরনো আবেগ আর মাথাচাড়া দিয়েছিল। ফলে শঙ্কু ক্রমেই একটি সিরিয়াস চরিত্রে পর্যবসিত হন। শঙ্কুকে মজাদার হাস্যকর চরিত্র থেকে গুরুগম্ভীর বৈজ্ঞানিকে পরিণত করায় যে লেখকদের সৃষ্টি করা সাহিত্য সত্যজিৎকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, সেই তালিকায় ক্লার্ক, ব্র্যাডবেরি, স্টারজিয়ন প্রমুখের সঙ্গে আইজাক আজিমভের নামটিও সত্যজিৎ রায় সেই সাক্ষাত্কারে উল্লেখ করেন যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে।
‘সমসাময়িক’ বলতে ঠিক যা বোঝানো হয়, ঠিক তার উদাহরণ বলা যায় আজিমভ ও সত্যজিৎকে। আজিমভ জন্মেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের এক বছর চার মাস আগে এবং মারা যান সত্যজিতের মৃত্যুর ১৭ দিন আগে। আজিমভের সায়েন্স ফিকশন সত্যজিৎকে সিরিয়াস কল্পবিজ্ঞান রচনায় উত্সাহ দেয়া ছাড়া দুজনের ভালো লাগার আরো অন্তত একটি বিষয় চোখের সামনেই আছে। তা হলো লিমেরিক রচনা। আজিমভ অবশ্য বেশ কিছু আদিরসাত্মক লিমেরিকও রচনা করেছিলেন, যে পথে সত্যজিৎ কখনো হাঁটেননি। কিন্তু বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিমেরিক রচনা করলেও আজিমভ পরিচিত সায়েন্স ফিকশন বিশেষজ্ঞ হিসেবে। অন্যদিকে সত্যজিৎকে নিজেকে শুধু কল্পবিজ্ঞানের আওতায় আটকে না রেখে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়। আজিমভের গল্পের টাইম মেশিন উইলিয়াম শেক্সপিয়ারকে বর্তমানে নিয়ে আসে। কিন্তু সত্যজিতের গল্পের টাইম মেশিনে বর্তমানের মানুষ কালভ্রমণ করে ছায়াশরীর নিয়ে। কল্পনাকে ভিনগ্রহে বা সুদূর মহাকাশে নিয়ে যাওয়া ছিল আজিমভের হাতের পাঁচ। সুজান কলভিন যেমন এক সময়ে বরাবরের মতো পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন স্পেস স্টেশনে; নাইটফল গল্পে যেমন আজিমভ বলেছিলেন ছয়টি সূর্যের আলোয় আলোকিত এক গ্রহের কথা, যেখানকার আকাশে তারা দেখা যায় হাজার বছরে একবার। সত্যজিৎ কিন্তু প্রোফেসর শঙ্কুর প্রথম গল্পে তাকে মঙ্গলগ্রহ আর টাফায় পাঠানোর পর কল্পনাকে আর পৃথিবী ছাড়তে দেননি। বরং ভিনগ্রহীদের নিয়ে এসেছিলেন সৌরজগতের এই তৃতীয় গ্রহটিতে। তিনি বোধহয় তার গুরুদেবের মতোই সুদূর আকাশে আঁকা ইন্দ্রধনুর চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসতেন তার ধরনীর প্রজাপতির পাখার রঙকে।
কতকটা সেই ভাবে কল্পনায় বিজ্ঞানকে সঙ্গী করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড-অতীত-ভবিষ্যৎ ঘুরে আজিমভও কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতেন এই পৃথিবীতে। চিন্তিত হতেন মানুষের, সমাজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। প্রোফেসর শঙ্কুর বাবা ত্রিপুরেশ্বর পুত্রকে বলেছিলেন, ‘রোজগার যেভাবেই করিস না কেন, যারা দরিদ্র্য, যারা নিরক্ষর, যারা মাথা উঁচু করে চলতে পারে না, তাদের কথা ভুলিস না।’ এসব মানুষের কথা ভুলতে পারেননি আইজাক আজিমভ নামক কল্পবিজ্ঞান রচয়িতাও। তাই তার লেখা গল্প-উপন্যাসে বারবার ফিরে আসত নতুন সব সমাজ ব্যবস্থার কথা, যাতে মানুষের অবস্থার উন্নতি ঘটানো যায়। যেমন বলা যায় ‘দি এন্ড অব এটারনিটি’ উপন্যাসের কথা, যেখানে কল্পনা করা হয়েছিল ইতিহাসের বহমানতা থেকে আড়াল করে রাখা এক সমাজ বা সভ্যতাকে, যাতে ‘এটারনিটি’ বা অনন্তকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় মানবজাতির সুবিধার্থে ও কল্যাণে।
প্রোফেসর শঙ্কুর মুখ দিয়ে সত্যজিৎ একবার বলিয়েছিলেন, ‘যন্ত্রের ওপর খুব বেশি করে যদি মানুষের কাজের ভার দেয়া যায়, তা হলে ক্রমে একদিন যন্ত্র আর মানুষের দাস থাকবে না, মানুষই যন্ত্রের দাসত্ব করবে।’ প্রায় একই কথা আইজাক আসিমভ বলেছিলেন একটু অন্যভাবে, তিনি বলেছিলেন, আধুনিক যুগের সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো বিজ্ঞান যত দ্রুত জ্ঞান অর্জন করছে, সামাজিক প্রজ্ঞার সঞ্চার সেই গতিতে হচ্ছে না।
দুই নিখাদ সমসাময়িকের মানসিক সাদৃশ্য যে কতখানি, এ কথা থেকেই তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়।

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত: নন-ফিকশন লেখক এবং সত্যজিৎ রায়ের ওপর একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন