‘ভুতুড়ে বাড়ি’ মরগান হাউজ

এএসএম শাহীন

কবিতা, গল্প আর গানে কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে কালিম্পংয়ের নাম যে কতবার শুনেছি তার হিসাব করা মুশকিল। তাই ডুয়ার্স ভ্রমণ শেষে সেবক ব্রিজ পার হয়ে কালিম্পংয়ের রাস্তা ধরলাম। চার হাজার ফুটের অধিক উচ্চতার কালিম্পং একসময় দার্জিলিং জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল, এখন সেটা আলাদা জেলার মর্যাদা পেয়েছে। চীনের তিব্বত দখলের আগ পর্যন্ত ইন্দো-তিব্বত বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল এই কালিম্পং। ডেলো পাহাড় দুরপিন পাহাড় নিয়ে তৈরি শহরকে ব্রিটিশরা ভারতের অন্যতম শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে। পরবর্তী সময় চীনের তিব্বত দখল ভারত-চীন যুদ্ধের পর এখানে প্রচুর বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বসবাস শুরু করেন।

তিস্তা নদীর পাড়ে, মনোরম আবহাওয়ার শহরে বিচিত্র অর্কিডসহ নানা ধরনের ফুল ফোটে। এখানে উল্লেখ্য, যারা ওয়েস্ট সিকিমের পেলিং, জোরেথাং বা ভার্সি রোডোডেনড্রন অভয়ারণ্য ভ্রমণে যাবেন, তারা যাওয়া-আসা মিলিয়ে ৩২ কিলোমিটারের বেশি ভ্রমণ করে

- ঘণ্টার মধ্যে কালিম্পংয়ের বেশকিছু দর্শনীয় স্থান উপভোগ করতে পারেন।


কালিম্পং ঘোরাঘুরির পরিকল্পনায় প্রথমেই ছিল মরগান হাউজের নাম। ইউটিউবের সুবাদেভুতুড়ে বাড়িতকমা পাওয়া পাথরনির্মিত দোতলা বাড়ির প্রতি আমার মেয়েরও অনেক আগ্রহ। যদিও সে রাতে থাকার সাহস করতে পারেনি। কিন্তু দিনের আলোয় অবশ্যই যেতে চায়। এখানে দর্শনীয় স্থানের মধ্যে আরো আছে ডেলো পার্ক, গল্ফ কোর্স, সায়েন্স সিটি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি, অনেক অর্কিড নার্সারি মনেস্ট্রি ইউরোপিয়ান ধাঁচের মরগান হাউজ নামে পরিচিত বাড়িটি। বিশিষ্ট পাট ব্যবসায়ী জর্জ মরগান ১৯৩০ সালের দিকে বাড়িটি তৈরি করেন। তত্কালীন ব্রিটিশ ভারতের দুই প্রভাবশালী নীল পাটের ব্যবসায়ী পরিবারের মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন উপলক্ষে চমত্কার ডিজাইনের বাড়িটি করা হয়। কালিম্পং শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে দুরপিন পাহাড়ে ১৬ একর জায়গাজুড়ে মরগান ম্যানসন। ফটক থেকে মূল প্রবেশদ্বার পর্যন্ত দুপাশে ফুলের বাগান, একটু দূরে দেবদারুসহ আরো অনেক উঁচু গাছের সারি। মূল ভবনের চারদিকে আলাদা আলাদা ছোট ছোট বাগান, যেখানে অনেক মানুষ একসঙ্গে আপ্যায়িত হতে পারে। উঁচু সিলিংয়ের কক্ষের জানালাগুলো দেখার মতো। নিচতলায় বিশাল ফায়ারপ্লেসহ ড্রইংরুম, ডাইনিং রান্নাঘর এবং ওপর তলায় সব শয়নকক্ষ। বাড়ির দোতালা বা লন থেকে আবহাওয়ায় ভালো থাকলে অনায়াসে সুউচ্চ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়।

বাড়িতে বসবাসরত অবস্থায় মিসেস মরগান মারা গেলে জর্জ মরগানও কিছুদিন পর রোগেশোকে ভুগে মারা যান। উত্তরাধিকারহীন বাড়িটি বেশ কিছুদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর আরো অনেক স্থাপনার মতো এটি সরকারের দখলে যায়। বাড়িটির নকশা পরিবেশ এত আকর্ষণীয় ছিল যে ১৯৬২ সালে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী নেহরু অসুস্থ হয়ে গেলে তার দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার জন্য এখানে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করা হয়। যদিও সেটা বাস্তবায়নের আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে এটি ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যুরিজম বোর্ডের তত্ত্বাবধানে একটি আবাসিক হোটেল হিসেবে ব্যবহূত হয়। এর গেস্ট লিস্ট অনেক সমৃদ্ধকিশোর কুমার, উত্তম কুমার, সুনীল দত্ত নার্গিস, ওম প্রকাশ, ভারতে অবস্থান করা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা।

আগ্রহী হলে যে কেউ নির্ধারিত উপায়ে বুকিং দিয়ে এখানে থাকতে পারেন। খেতে পারেন সে বিশাল ডাইনিং হলে, রেশমের পর্দা লাগানো বিশাল ফ্রেঞ্চ জানালায় তাকিয়ে থাকতে পারেন কাঞ্চনজঙ্ঘার রহস্যঘেরা চূড়ার দিকে। আর বোনাস হিসেবে পেতে পারেন গভীর রাতে কাঠের ফ্লোরে মিসেস মরগানের হাই হিলের শব্দ অথবা অট্টহাসি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন