ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন
অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্য কোর্স নিয়ে অসন্তুষ্টি
প্রকাশ করার একদিন পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য
কোর্স বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্য কোর্সের পক্ষে-বিপক্ষে
বিভিন্ন মত-দ্বিমত রয়েছে। বাণিজ্যিক সান্ধ্য কোর্স চালানোর জন্য বহুলাংশে
শিক্ষকদের আগ্রহকে বেশি দায়ী করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, গবেষণা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত
কোর্সে আগ্রহ কমলেও সান্ধ্য কোর্স এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে তাদের
আগ্রহ বেশি। শুধু আর্থিক কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এমন কর্মকাণ্ড
নৈতিকভাবেও সমর্থনযোগ্য নয়। যুগে যুগে শিক্ষকদের মর্যাদার আসনে বসিয়েছে মানুষ।
কিছু শিক্ষকের কারণে সে মর্যাদার আসন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটা
কাম্য নয়।
সান্ধ্য কোর্স বিশ্বের আরো অনেক
বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে, তবে সময়ের পার্থক্য ছাড়া সেখানে শিক্ষার মানের তেমন কোনো পার্থক্য না
থাকায় সেটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। এক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দুটি
খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সান্ধ্য কোর্সের বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে।
আইআইটিতে মুম্বাইয়ে কর্মরত পেশাজীবীদের জন্য এমটেক স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেয়ার সুযোগ
রয়েছে। সেখানে নিয়মিত এমটেক কোর্সটিও সন্ধ্যাকালীন। অন্যদিকে দিল্লির জওহরলাল
নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সান্ধ্য ডিপ্লোমা কোর্স রয়েছে। সেখানে সান্ধ্য কোনো
স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেয়ার তথ্য পাওয়া যায় না। ঠিক তেমনিভাবে আমাদের
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনো কোর্স চালু করলে দোষের কিছু হবে না। তবে তা করতে
হবে নিয়মিত কোর্সের কোনো প্রকার বিঘ্ন না ঘটিয়ে। ভর্তিসহ মূল্যায়ন একই মানের রাখাও
সংগত। আর বিবেচনায় রাখা জরুরি,
একই শিক্ষক বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়লে তার
শিক্ষাদানের মান ক্রমে উঁচু হওয়ার সুযোগ কম। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিত্যনতুন
বিভাগ খোলার পরিবর্তে বিদ্যমান বিভাগগুলোকে যুগোপযোগী শিক্ষার আওতায় আনা অধিক
জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো অধিকতর গবেষণাক্ষেত্র তৈরি করতে হবে, পাশাপাশি
শিক্ষার্থীদেরও কেবল সিলেবাস শেষ করে পরীক্ষায় ভালো সিজিপিএ পাওয়ার বদলে নিজেকে
সত্যিকারের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। শিক্ষকদের উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে
অতিরিক্ত সময় না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে আরো খানিকটা সময় দিয়ে এর মানোন্নয়নে ভূমিকা
রাখা।
সান্ধ্য কোর্সে যেসব শিক্ষক পড়ান, তারা
তাদের পরিশ্রমের বিনিময়ে অন্যদের তুলনায় কিছুটা বাড়তি আয়ের সুযোগ পান। কিন্তু
ইচ্ছা থাকলেও সব শিক্ষকের বেলায় এ ধরনের বাড়তি আয়ের সুযোগ নেই। কেননা সান্ধ্য
কোর্সগুলো চলে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী। সব বিষয়ের ক্ষেত্রে এ চাহিদা সমান নয়। অনেক
বিষয়ে বিদ্যার্থীদের আদৌ আগ্রহ নেই। বাংলা সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বা বিজ্ঞান
এবং জীব ও ভূবিজ্ঞান অনুষদভুক্ত বিভিন্ন বিষয় অথবা কৃষি অনুষদের অনেক বিষয়ে তাই
সান্ধ্য কোর্স চালুর সুযোগ থাকছে না। এসব হিসাব বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, একই
বিশ্ববিদ্যালয়ের হওয়া সত্ত্বেও প্রায় ৭০ ভাগ শিক্ষকের সান্ধ্য কোর্সের মাধ্যমে
বাড়তি রোজগারের উপায় নেই। কাজেই কারো কারো জন্য এ ধরনের বৈষম্যমূলক বাড়তি আয়ের
সুযোগ উচ্চশিক্ষার সার্বিক পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো
ঘোষণা বা তাদের সম্মানজনক বেতন দিলেই যে সান্ধ্য কোর্স সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা
নয়। এক্ষেত্রে মূলধারার শিক্ষার্থীদের আস্থায় আনাটাও জরুরি। কেননা চিরন্তন ছাত্র-শিক্ষক
সম্পর্ককে জলাঞ্জলি দিয়ে সান্ধ্য কোর্স চালু করতে গেলে শিক্ষা ব্যবস্থাই মুখ থুবড়ে
পড়তে পারে। উচ্চশিক্ষার বাড়তি চাহিদা পূরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের একই অবকাঠামো ব্যবহার
করা গেলে সরকারের ব্যয় কমতে পারে,
কেবল এমন ধারণাই যথেষ্ট নয়। কীভাবে মূলধারার
শিক্ষাকে ব্যাহত না করে অবকাঠামো ব্যবহার করা যায়, তা বিশদভাবে ভাবতে হবে। শিক্ষকরা
মূলধারার শিক্ষায় এবং শিক্ষাসহায়ক কর্মকাণ্ডে কতটা সময় দেবেন, যেসব
শিক্ষকের সান্ধ্য কোর্সে পড়ানোর সুযোগ নেই তাদের মনোভাব কী হবে, এসব
বিষয় বিবেচনার পাশাপাশি সান্ধ্য কোর্সের সিলেবাস নিয়েও ভাবা দরকার। একই বিষয়ের
মাস্টার্সের জন্য ক্লাস পৃথক হলেও সিলেবাস ও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র একই হওয়া
বাঞ্ছনীয় (বিশেষ ক্ষেত্র ব্যতিরেকে)। সাধারণ কোর্স
আর সান্ধ্য কোর্সের মধ্যে বেতন-ফির পার্থক্য বিষয়েও ভাবা জরুরি। কেবল উচ্চবিত্তরা সান্ধ্য কোর্সে পড়ার
সুযোগ পাবে, অথচ নিম্নবিত্ত বা সাধারণ চাকরিজীবী সে অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, এটি
প্রত্যাশিত নয়।
দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উচিত মানসম্মত এবং বিশ্বমানের শিক্ষা ও গবেষণার লক্ষ্যে
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য যুগপৎ ও গঠনমূলক আন্দোলন করা। প্রকৃতপক্ষে
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান হতে হয় বিশ্বমানের। তাই স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায়
না এনে আমাদের দরকার বিশ্বমানের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। হতাশাজনক হলেও সত্য, বৈশ্বিক
মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আমাদের পাশের দেশ ভারত, মালয়েশিয়া
ও চীনের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তালিকার উপরের দিকে ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান করে নিতে
পারলেও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই স্থান পায়নি। এর কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়
পর্যাপ্ত মানসম্মত আধুনিক শিক্ষা ও গবেষণার অভাবকে। আমাদের সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে
বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায়
বা জেলায় জেলায় নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় না খুলে চলমানগুলোর আরো অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো
এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কাজে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে সরকারকেই। আর এরই অংশ
হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক
‘উচ্চশিক্ষা গুণ-মান বর্ধন প্রকল্প’ শিরোনামে
বিশ্বব্যাংকের ঋণসহায়তায় কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার
মানোন্নয়নের জন্য তোড়জোড় চলছে,
যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। তবে সেখানেও
যথাযথ নিরীক্ষণ ও মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দেখা
যায়, পুরনো
বিভাগ/বিষয়/অনুষদগুলোয় শিক্ষক ও গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নতুন
নতুন বিভাগের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি। তাই এগুলোয় পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক, শিক্ষা
উপকরণ বা গবেষণার জন্য ন্যূনতম যন্ত্রপাতি/সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। সর্বোপরি গবেষণায় বরাদ্দ আরো
বাড়াতে হবে।