দুর্গোৎসব সর্বলোকের

গৌতম কুমার রায়

আইসিস নামে এক দেবীকে প্রাচীন মিসরীয়রা পুজো করত। হিন্দু মাইথোলজিতে এ আইসিস হলো তাদের দেবী দুর্গার আরেক নাম। আবার গ্রিসে মাতৃমায়া রূপে ভেনাস, মিনার্ভা ও ডায়ানা নামের দেবী বন্দনা করা হতো। হিন্দু দেবীদের মধ্যে মিনার্ভা হলেন দেবী সরস্বতী এবং লক্ষ্মী দেবী ভেনাস নামে পরিচিত ছিলেন। কেউ কেউ মিনার্ভাকে দেবী দুর্গা বলে জানতেন। ইতিহাস বলে, প্রাচীন যুগে ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলে শক্তির আরাধ্য হিসেবে এবং মাতৃরূপে দেবী পূজার প্রচলন ছিল। পূজার আসল বিষয় হলো, মানুষের মননচিত্তে অনুধাবনের জন্য আনন্দের চিরন্তন ও সরল ঐতিহ্যের প্রাসঙ্গিকতা তৈরি করা। এ পূজাই আসলে সে সময়ে ধর্ম হিসেবে পরিচিত ছিল। শিকার এবং আহারের জন্য মানুষ সারাক্ষণ যে শ্রম দিয়ে ক্লান্ত বিভোর থাকত, তা থেকে ফুরসত পেতে বিনোদনকে উপজীব্য করতে প্রাসঙ্গিকতার পথ খুঁজত। আনন্দের অনুভূতিকে মননে নাড়া দিয়ে যে আনন্দমাত্রার জোগান লাভ করত, তা ছিল উপাস্যকেন্দ্রিক বা তা ছিল ধর্ম জাগ্রতিক। প্রকৃত অর্থে ধর্ম মানুষকে কষ্ট বা ত্যাগের বিবৃতি ঘোষণা করত, আবার তা ভোগের বিলাসিতাকেও জাগিয়ে তুলত। যদি দেবী দুর্গার কথা বলি, তিনি মর্তলোকে আসেন দেবীপক্ষে সামান্য সময়ের জন্য। আবার তিনি কৈলাসগামী হন। দেবী নিরঞ্জনের মাধ্যমে অগণিত ভক্তকে তিনি কাঁদিয়ে চলে যাওয়ায় প্রাপ্তি ও ত্যাগ যোগের অনুধাবনিক অনুভূতি কাজ করে। এজন্য ভক্তের মনে দেবী এ সময়ের জন্য হলেও তিনি জাগতিক। দেবী আসেন আবার ফিরে যান। এ যেন স্বর্গীয় সুরের বিরল সওগাত নিয়ে আসা-যাওয়া। শ্রমবিকি মানুষ দেবীপক্ষে তাই উদ্বেলিত হয় তাদের আনন্দের অন্তর্লোকের সম্পূর্ণটুকু বিকিয়ে দিয়ে। বোধন থেকে বিসর্জন। দেবী উসবে পরিসমাপ্তি ভাবা গেলেও আসলে বিজয়া আবার চলে আসে আনুষ্ঠানিকতার আরেক সূচনাকে বরণ করে। পূজা আসলে নির্দিষ্ট কতক মানুষের আচার ও নিষ্ঠার বিষয়াদি হলেও উসবে মেতে ওঠে সবাই। যেন তোমার আনন্দ আমারই সাধনার ফল। আমার আরাধ্য সাধনায় মৈত্রী, সাম্য, ভ্রাতৃত্বের মৌলিক বাণী তোমার মনে উদ্বেলিত হোক। সর্বজনীন পূজায় সবাই আমরা মানুষ। এখানে ব্রিটিশের বিভাজিত জাতিসত্তার বিভক্ত রেখা সাময়িক সময়ের জন্য কলঙ্কমুক্ত হলে সার্থকতা তো এ মানুষেরই। জন্মসূত্রের ধর্মকে আঁকড়ে ধরে আমাদের বিবেকবৃত্ত যখন সীমাবদ্ধ, তখন সর্বজনীন উসব সে বৃত্তকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মুক্ত করে দেয়। ভাবনার কুণ্ডলীতে পরিশ্রুত বিবেক ভাবতে শেখায় সবাই আমরা এক সৃষ্টিকুলের বাসিন্দা। আমাদের বর্ণ, আমাদের রক্ত, জ্ঞান, বিবেক, বুদ্ধি, সুনীতি, আমাদের শরীর ও আত্মা সবই সবার জন্য স্বাগতিক ও অভিন্ন চেতনার সর্বলোকহিত।

 

গৌতম কুমার রায়: প্রাবন্ধিক ও পরিবেশব্যক্তিত্ব

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন