ইউনিটপ্রতি সৌরবিদ্যুতের ক্রয়মূল্য দেশে প্রায় ১১ টাকা

সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে

ছবি : সংগৃহীত

দেশে জ্বালানি সংকট দীর্ঘদিনের। ডলার সংকটে জ্বালানি আমদানি ব্যবস্থাও ভঙ্গুরপ্রায়। পর্যাপ্ত গ্যাসের অভাবে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে এসেছে। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ হতে পারে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বিশেষ করে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহারে মনোযোগী হওয়া। তবে এক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো দেশে সৌরবিদ্যুতের ক্রয়মূল্য প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বেশি।

বণিক বার্তার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এখানে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয়ে চুক্তি হচ্ছে ৯ থেকে ১০ সেন্টে। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর সর্বনিম্ন দাম পড়ছে ১০ টাকা ৭৫ পয়সা। তবে বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি ভিন্ন হওয়ায় দামে কিছুটা তারতম্য দেখা যায়, যা কিলোওয়াটপ্রতি সর্বনিম্ন ১০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১৩ টাকাও পড়ছে। 

এদিকে ভারতে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সোলার এনার্জি করপোরেশন অব ইন্ডিয়ার (এসইসিআই) আহ্বান করা দুই হাজার মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের দরপত্রে অংশ নিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ পায় ছয় কোম্পানি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের দাম অনুমোদন হয় ৩ সেন্টে, যা ভারতীয় মুদ্রায় ২ রুপি ৬০ পয়সা। ডলারের বিনিময় হার ১১৯ টাকা ৪৮ পয়সা হিসাবে ওই বিদ্যুতের ট্যারিফ বাংলাদেশী মুদ্রায় দাঁড়ায় ৩ টাকা ৫৮ পয়সা। এছাড়া দেশটিতে সাম্প্রতিক কালে অনুমোদন দেয়া অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও ট্যারিফ নির্ধারণ হয়েছে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা ৩ থেকে সাড়ে ৪ সেন্টের মধ্যে।

আবার পাকিস্তান আমদানিনির্ভর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপর চাপ কমাতে বেসরকারি খাতে সৌরবিদ্যুতের ট্যারিফ কমিয়ে আনতে চলতি বছরেই প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে। এজন্য বেঞ্চমার্ক হিসেবে সৌরবিদ্যুতে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা প্রস্তাব করা হয় ৫ সেন্ট। এছাড়া দেশটিতে ৫০০ থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে ক্রয়চুক্তি হয়েছে সর্বোচ্চ ৭ সেন্ট থেকে সর্বনিম্ন সাড়ে ৩ সেন্টের কিছু বেশিতে। ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশী টাকার হিসাবে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের সর্বনিম্ন দাম পড়েছে ৩ টাকা ৮২ পয়সা। জানা যায়, প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার সৃষ্টি, প্রণোদনা ও আমদানিনির্ভর জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসতে সৌরবিদ্যুতের খরচ সামনের দিনগুলোয় আরো কমাতে চায় পাকিস্তান।

বর্তমানে সৌরশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে শীর্ষস্থানে রয়েছে চীন। বিশেষজ্ঞদের মতে, সৌরবিদ্যুতে সক্ষমতা, প্রযুক্তি, জনবল ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর চেয়ে বহু গুণ এগিয়ে চীন। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৬ লাখ ১০ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ সক্ষমতা তৈরি করেছে দেশটি, যা বিশ্বে মোট সৌর সক্ষমতার ৪২ শতাংশ। সৌর প্রযুক্তির বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রকেও পেছনে ফেলেছে দেশটি। সৌরবিদ্যুতে প্রযুক্তি ও এ খাতের কাঁচামাল উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনায় প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়ছে গড়ে সাড়ে ৪ সেন্ট, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৫ টাকা ৩৮ পয়সার মতো।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের দাম বেশি হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এগুলোর অন্যতম হলো সূর্যের তাপের ভিন্নতা, সৌরবিদ্যুতে শুল্ক-করছাড়, জমির দাম ও সংস্থান এবং বিদ্যুতের সঞ্চালন অবকাঠামো সংকট। প্রতিবেশী দেশ ভারত এসব সুবিধায় বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। যে কারণে সেখানে সৌরবিদ্যুতের দাম কমে এসেছে। তাদের মতে, বাংলাদেশে এসব সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে সৌরবিদ্যুতের দাম কমিয়ে আনা সম্ভব।

অন্তর্বর্তী সরকারের এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া এ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্ভাবিত তিন শূন্য নীতির একটি হলো ‘শূন্য কার্বন নিঃসরণ’। সুতরাং আশা রাখি, তিনি জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে ক্রমেই বের হয়ে আসার ব্যবস্থা নেবেন। খাতসংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বেশকিছু নীতি এবং সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা গেলে বাংলাদেশেও কম মূল্যে সৌরবিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করা সম্ভব। 

এর জন্য শুরুতেই সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ এবং ক্রয় চুক্তির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করার দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। ভারতের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া এক্ষেত্রে অনুসরণীয় হতে পারে। ভারতে সরকারি কোম্পানিগুলো সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে দরপত্র আহ্বান করে থাকে। যেখানে দরপত্র চূড়ান্ত পর্যায়ে বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের সর্বনিম্ন মূল্যকে প্রাধান্য দেয়া হয়। একই সঙ্গে দরপত্রে কোথায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে, গ্রিড লাইন পর্যন্ত পৌঁছাতে ইউনিটপ্রতি কত অর্থ খরচ হবে তা বিবেচনা ও বিশ্লেষণ করে দরপত্র চূড়ান্ত করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তার কেন্দ্র নির্মাণে প্রকল্প ব্যয়, বিশেষত জমির দাম, অবকাঠামো নির্মাণ, পরিচালন ব্যয় এবং নির্দিষ্ট সময় হিসাব করে বিদ্যুৎ ক্রয়ে সরকারকে প্রস্তাব দেয়। বিশেষ বিধানের আওতায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট একটি কোম্পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির প্রস্তাব দেয়। ফলে এখানে প্রতিযোগিতার কোনো সুযোগ থাকে না। প্রস্তাবকারী কোম্পানির চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলো অনুমোদিত হয়, যে কারণে সৌরবিদ্যুতের দাম বেশি পড়ে। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করতে হলে বিদ্যুতের বিশেষ আইন বা বিধানকে উঠিয়ে দিতে হবে। কারণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরির ক্ষেত্রে এ বিশেষ বিধান বা আইনটি প্রতিবন্ধক।

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ (সিইআর) অনুযায়ী, দেশে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমাতে হলে জমির সংস্থান সরকারের করতে হবে। একই সঙ্গে সৌরবিদ্যুতে ট্রান্সমিশন অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। কারণ যেসব সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে সেখান থেকে ট্রান্সমিশন লাইনের দূরত্ব বেশি হওয়ায় এ অবকাঠামো গড়ে তুলতে ব্যয় হচ্ছে যা বিদ্যুতের উৎপাদন খরচের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে যুক্ত হচ্ছে। মৌলিক কিছু খরচ কমানো গেলে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব।

তবে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জমির বিকল্পও আছে। গত বছর ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে বিভিন্ন ভবনের ছাদ ব্যবহার করে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ শুরু হয়েছে। এটি তেমন জনপ্রিয়তা না পেলেও ছাদ ব্যবহার করে ২ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব। আর এটি করা গেলে বছরে ১১ হাজার ৩২ কোটি টাকা (১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) সাশ্রয় করতে পারবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সুতরাং জমির পরিবর্তে বড় ভবনগুলোর ছাদ ব্যবহার করে ব্যয় সাশ্রয় করা যেতে পারে। এতে দামও যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা যেতে পারে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ প্রাপ্তির অংশ হিসেবে সৌরবিদ্যুতের একটি রোডম্যাপ তৈরি করা হয় ২০২১ সালে। ইউএনডিপির অর্থায়নে তৈরি করা এ রোডম্যাপের একটি খসড়া বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়। সেখানে বলা হয়, দেশের কোন অঞ্চলগুলোয় সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা গেলে খরচ কম হবে, পাশাপাশি কোন এলাকাগুলো সৌরবিদ্যুতের সবচেয়ে সম্ভাবনাপূর্ণ। যদিও এ পরিকল্পনা এখনো অনুমোদন দেয়া হয়নি। সুতরাং এ পরিকল্পনাগুলো যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা সরকারের করতে হবে। মোট কথা, সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমাতে সরকারের টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন