ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা

আর পচন নয়, সুস্থ-সবল জাতি হিসেবে দাঁড়াতে চাই

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল ঢাকার একটি হোটেলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন ছবি: পিআইডি

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘বাংলাদেশে যে পচন ধরেছিল, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান ছাড়া সেই পচন থেকে মুক্তির কোনো উপায় ছিল না। ছাত্রদের আন্দোলন হঠাৎ করে সেই অবস্থা বদলে দিয়েছে। আর কোনো পচন নয়, আমরা সুস্থ-সবল জাতি হিসেবে দাঁড়াতে চাই।’

গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে ‘ন্যাশনাল বিজনেস ডায়ালগ’ শীর্ষক সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ইউনূস এসব কথা বলেন। ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশ (আইসিসিবি) এ সংলাপ আয়োজন করে। সহযোগী আয়োজক ছিল ১৫টি সংগঠন—এফবিসিসিআই, ডিসিসিআই, এমসিসিআই, সিসিসিআই, এফআইসিসিআই, বিসিআই, বিএবি, বিআইএ, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, বিএপিআই, বিএপিএলসি, বেসিস ও এলএফএমইএবি। এতে বক্তব্য দেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে বক্তব্য দেন ব্যবসায়ী মীর নাসির হোসেন।

ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা যে বড় কিছু করতে পারি, তার প্রমাণ হলো ব্যবসায়ীরা। বিরাট দুঃসাহস নিয়ে আপনারা উদ্যোক্তা হয়েছেন। বাংলাদেশীদের কাছে শিল্পপতি হওয়া দুঃস্বপ্ন ছিল, কিন্তু আপনারা সেটা করতে পেরেছেন। আপনারা বিশ্বমানের উদ্যোক্তা। যুবকরা যে সুযোগ এনে দিয়েছে তা কাজে লাগিয়ে আপনারা স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবেন।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা কোনো কল্পকাহিনী নয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনারা মনস্থির করে এগিয়ে এলে খুব দ্রুতগতিতে আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।’

ব্যবসায়ীদের সামাজিক ব্যবসা চালুর আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনার গ্রাম, উপজেলা কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের এলাকায় সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলুন। বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও পরিবেশ উন্নয়নে সামাজিক ব্যবসা করা যেতে পারে। আপনি বিনিয়োগ করবেন মুনাফার জন্য নয়, অন্যের সহায়তা বা সুবিধার জন্য।’

দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বিষয় তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেন মীর নাসির হোসেন। তিনি বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময় থেকেই দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি বড় শূন্যতা তৈরি হয়েছে। ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। শিল্প পুলিশের সীমিত উপস্থিতি এবং থানা পুলিশের কার্যক্রম পুরোদমে চালু না হওয়ায় পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা প্রত্যক্ষভাবে কর্মসংস্থান কমাবে। আমরা অবিলম্বে সব শিল্পাঞ্চলে যৌথ বাহিনীর অধিকতর উপস্থিতি সার্বক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করার জন্য জোরালোভাবে আবেদন জানাচ্ছি।’

বীমা শিল্প সংস্কারের পাশাপাশি আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতায় গুরুত্বারোপ করেন মীর নাসির হোসেন। জ্বালানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সব শিল্প খাতে উৎপাদন ও সেবা চালু রাখতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি নিশ্চিত করলে দেশের অর্থনীতি সচল থাকবে। কয়লা, গ্যাস ও জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নাবায়নযোগ্য জ্বালানি তথা সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রাধিকার দেয়ার জন্য আবেদন জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে নিজস্ব গ্যাস ও কয়লা আহরণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার বিশেষ অনুরোধ করছি।’

মীর নাসির বলেন, ‘একটি সুকৌশলী, কুচক্রী মহল সমাজ ও অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ অশুভ গোষ্ঠীকে প্রতিহত করতে হবে। ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন গণ-আন্দোলনের ফলস্বরূপ উদ্ভূত “নতুন বাংলাদেশ”এবং অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারে ব্যবসায়ীদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে।’

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘বৈশ্বিক মূল্যায়নে আমাদের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান শীর্ষ জায়গায় স্থান করে নিয়েছে। এর মানে হলো সত্যিকারে উদ্যমী হলে এবং নিষ্ঠাবান হলে আমরাও পারি সেটা আপনারা দেখিয়ে দিয়েছেন। তবে সমস্যা হলো শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোয় মানের দিক থেকে অনেক ফারাক আছে, সেটা আমরা গবেষণায়ও দেখেছি।’

তিনি বলেন, ‘এলডিসি থেকে উত্তরণের পর ভবিষ্যতে বিশ্ববাজারে আমরা অনেক বেশি প্রতিযোগিতার মুখে পড়ব। এরই মধ্যে আমরা বিশ্ববাজারে অনেক বেশি প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছি। আঞ্চলিকভাবে ও দ্বিপক্ষীয়ভাবে অনেক বাণিজ্যিক চুক্তি হবে, আমাদের সেগুলোর অংশীদার হতে হবে। যেসব উদ্যোক্তা পিছিয়ে পড়েছেন, তাদের আরো এগিয়ে যেতে হবে, নইলে উঠে যেতে হবে—এটাই হলো বাস্তবতা।’

তিনি আরো বলেন, ‘যখন আমরা দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় চুক্তিতে যাব, তখন টিকে থাকতে হলে আমাদের উৎপাদনশীলতা আরো বাড়াতে হবে, শ্রমিকদের দক্ষতা আরো বাড়াতে হবে এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে যেতে হবে। স্বল্প মজুরি, স্বল্প দক্ষ বা অদক্ষ শ্রমিকের রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর করে আমরা শিল্পায়নের পরবর্তী ধাপে যেতে পারব না।’

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘কিছু ব্যবসায়ী, শিল্পপতি গত সরকারের আনুকূল্যে নানা দুর্নীতির মাধ্যমে রাতারাতি বিলিয়নেয়ার হয়ে গেছেন। আপনারা দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছেন। আমরা আর অর্থনৈতিক মানচিত্রে বিলিয়নেয়ারদের তালিকায় নাম লেখাতে অত বেশি উৎসাহী নই। এছাড়া বাজার অর্থনীতির অপব্যাখ্যা দিয়ে বিলিয়নেয়ার বানানোতেও কোনো কৃতিত্ব নাই। আপনারা ছোট থেকে ধীরে ধীরে যেভাবে বড় উদ্যোক্তা হয়েছেন, সেটাই আমাদের কাম্য।’ 

সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা বর্তমানে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, যেগুলো বিগত ১৫-১৬ বছরে তৈরি হয়েছে। এটা মূলত লিগ্যাসি প্রবলেম। সেটা সারাতে সময় লাগবে। তবে আমরা বেশি সময় নেব না, স্বল্প সময়ে মূল যেসব সমস্যা ছিল, সেগুলো সমাধান করব। আমাদের যে অর্থনীতির গাড়ি, তা ধীর হয়ে গিয়েছিল, আমরা তা সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।’ 

তিনি বলেন, ‘আগের সরকার নীতির বিরুদ্ধে যা যা করেছে, তা আমরা চেষ্টা করছি ঠিক করার। আমার কথা হলো, সবাই ব্যাংক থেকে টাকা নেবে? পৃথিবীর কোনো দেশেই ব্যাংকনির্ভর ফাইন্যান্সিং ইন্ডাস্ট্রি হয় না।’

সালেহউদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা অনেক দিক নিয়ে কথা বলেছেন। আরো অনেক ব্যাপার আছে। আমরা সব বিষয় সুরাহার চেষ্টা করছি। আমাদের মূল লক্ষ্য ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান।’

ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা বলছি না যে আপনারা মুনাফা করবেন না। কিন্তু অ্যাবনরমাল প্রফিট করা যাবে না। মূল্যস্ফীতির দিকেও আমরা নজর দিচ্ছি। ১০ টাকার বেগুন আমরা ১০০ টাকায় কেন খাব। এসব জায়গায় ক্ষমতাশীলদের যোগসূত্র আছে।’

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘যে কয়টা দিন সরকারে থাকি, আমরা একসঙ্গে কাজ করতে চাই। যেন বলে যেতে পারি, এ দেশ আমাদের একটা সুযোগ দিয়েছিল, আমরা সে সুযোগ সদ্ব্যবহার করেছি।’ 

ছাত্র-জনতার আন্দোলন প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, ‘এটা সাধারণ কোনো আন্দোলন ছিল না। যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের অনেকে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় শেষ বিদায় নিয়ে এসেছেন। তারা মনস্থির করেছিলেন, যে উদ্দেশ্যে রাস্তায় নেমেছেন, সে উদ্দেশ্য পূরণে তারা প্রাণ দিতে তৈরি আছেন।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘সংস্কার কেবল সরকারের ওপর ছেড়ে দেবেন না। আসুন সবাই মিলে সংস্কার করি। যেখানে ভুল দেখবেন, আত্মজিজ্ঞাসা করবেন সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। ছেলেদের আত্মাহুতির দিকে তাকিয়ে ভুল পথ পরিহার করুন।’

ড. ইউনূস বলেন, ‘আমাদের মেয়াদকালে আমরা শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে চাই। আমরা এখনো জেনেভা কনভেনশনে যোগ দিতে পারিনি। আমাদের সাহস দিন, এগিয়ে আসুন, আমরা সবাই মিলে আইএলও কনভেনশনে স্বাক্ষর করি।’

তিনি শ্রমিকদের যা প্রাপ্য, মালিকদের তাতে শরিক হওয়ার আহ্বান জানান। পোশাকপণ্য রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থানের বিষয় উল্লেখ করে তিনি এক্ষেত্রে প্রথম স্থানে যেতে ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান। 

বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনায় অনেক বাধা রয়ে গেছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘ব্যবসায় বাধার কোনো সীমা নেই। ব্যবসা করা এক মহা সংগ্রাম। তবে আমরা এসব বাধা পেরিয়ে যেতে আজ একযোগে এক পরিবারের সদস্য হিসেবে কাজ করে যাব।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন