আলোকপাত

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে প্রভাবিত করছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখা দরকার

ড. মোহাম্মদ তারেক

ছবি : বণিক বার্তা

কভিডের সময় থেকে এখন পর্যন্ত আমরা একটি বৈশ্বিক অস্থির পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সে অনুসারে আমাদের মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। অর্থনীতির কিছু মূলনীতি রয়েছে। প্রথমত, টাকা প্রবৃদ্ধি সৃষ্টি করতে পারে না, টাকা দীর্ঘমেয়াদে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকে। এটি একটি প্রতিষ্ঠিত বিষয় এবং মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি বিশেষজ্ঞ সব অর্থনীতিবিদ এটি স্বীকার করে নিয়েছেন। উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে চাহিদা ও সরবরাহ এই দুটি সমষ্টিগত শক্তি রয়েছে। সুদের হার পরিবর্তন করা হলে সেটি শুধু সমষ্টিগত চাহিদা পরিবর্তন করতে পারে কিন্তু সমষ্টিগত সরবরাহকে প্রভাবিত করতে পারে না। উন্নয়নের জন্য সমষ্টিগত সরবরাহ বাড়াতে হবে। অবকাঠামোতে বিনিয়োগের মাধ্যমে মানুষের জীবন মান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে রাজস্বনীতি এক্ষেত্রে সমষ্টিগত সরবরাহকে প্রভাবিত করতে পারে।

মুদ্রানীতি নিয়ে আলোচনায় আজকের প্যানেল চেয়ার (ড. আতিউর রহমান) একটি শব্দবন্ধ উল্লেখ করেছেন, ‘ডেভেলপমেন্টাল সেন্ট্রাল ব্যাংক’। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে কোনো ‘ডেভেলপমেন্টাল সেন্ট্রাল ব্যাংক’-এর কথা শুনিনি। আমি শুধু জানি সেন্ট্রাল ব্যাংকের (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) কথা এবং এ ব্যাংকের দুটি মৌলিক দায়িত্ব আছে—এক. মুদ্রার মান সংরক্ষণ ও দুই. আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। পাশাপাশি আরেকটি মূল কাজ হলো ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা। আজকের প্যানেল আলোচনার প্রধান অতিথি ও প্যানেলিস্টদের কাছে আমার প্রশ্ন, বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ মৌলিক দায়িত্বগুলো ঠিকভাবে পালন করছে কিনা। আমরা কি স্থানীয় ও বৈশ্বিকভাবে টাকার মূল্যমান ও আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছি কিংবা প্রথাগত মুদ্রানীতির যে বৈশিষ্ট্য, ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সেটি করেছি? 

এক্ষেত্রে আমি সবাইকে দেশের অর্থনীতির একটি সূচকের দিকে নজর দেয়ার অনুরোধ করব। সেটি হচ্ছে জিডিপির অনুপাতে এম টু বা ব্রড মানির (ব্যাপক মুদ্রা) পরিমাণ। এটিকে অর্থনীতির আর্থিক গভীরতা (ফাইন্যান্সিয়াল ডিপেনিং) হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। স্বাধীনতার পর এর পরিমাণ ছিল জিডিপির ১০ থেকে ১২ শতাংশ। এর পর থেকে এটি বাড়তে বাড়তে ২০১৪ সালে জিডিপির ৬৪ শতাংশে দাঁড়ায়। এরপর এক বছরের মধ্যে এটি ১০ শতাংশ কমে যায় এবং তখন থেকে এটি ৫৪-৫৯ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে। নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে এ অনুপাত ন্যূনতম ৭০ শতাংশ থাকতে হবে। মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে ১৫০ শতাংশ এবং উচ্চ আয়ের দেশ হতে হলে এ অনুপাত ১৭০ শতাংশ হতে হবে। কিন্তু আমরা এখন কোন অবস্থানে আছি? 

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এ পদের একজন যথাযোগ্য ব্যক্তি। একসঙ্গে কাজ করার সুবাদে তার সক্ষমতা সম্পর্কে আমার সম্যক ধারণা আছে। যে কারণে আমার উপদেশ ছিল সংকট যতই বিচলিত করুক না কেন, তার এ পদে থাকা উচিত। আমার ধারণা, যত দিন বর্তমান গভর্নর দায়িত্বে থাকবেন, দেশ ও দেশের আর্থিক ক্ষতি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। 

এবার রাজস্ব খাতের আলোচনায় যাওয়া যাক। উল্লেখ্য, বর্তমান গভর্নর অর্থ বিভাগে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। আমারও প্রায় ১৫ বছর কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে। ওইসময় থেকে বাংলাদেশের জিডিপির অনুপাতে ব্যয়ের পরিমাণ বর্তমানে ১৫-১৬ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রবৃদ্ধি ঘটেনি। ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ৩৩ শতাংশ। দেশটি তাদের জিডিপির ২৭ শতাংশ মোবিলাইজ করে থাকে। তাই আমরা যদি আমাদের সম্পদ মোবিলাইজ করতে না পারি তাহলে সঠিক রাজস্বনীতি প্রণয়ন করা কঠিন হবে। বর্তমানে ৩ টাকার মধ্যে ১ টাকা বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যয় হচ্ছে। এক্ষেত্রে ৩ টাকার মধ্যে ১ টাকাই ঋণ করতে হচ্ছে। আমার মতে, বর্তমান এ সংকটকালীন মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের অবিলম্বে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমাদের লেনদেন ভারসাম্যে (বিওপি) ইতিবাচক প্রভাব রাখতেও ব্যয়ের রাশ টেনে ধরতে হবে। এজন্য আমাদের বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৩ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে।

এবার সরাসরি চলে যাই রেভিনিউ মোবিলাইজেশন ইস্যুতে। আমি একটি মেটাফরের মাধ্যমে এ বিষয়ে আলোচনাটা নিতে চাই। প্রায় এক বছর আগে এক অর্থনীতিবিদের একটি আর্টিকেল পড়েছিলাম। সেখানে বলা হয়, শক্তিশালী বেসরকারি খাত ও ব্যবসায়িক গ্রুপ ব্যতীত কোনো দেশই উন্নত হতে পারবে না। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও প্রবৃদ্ধির জন্য আমাদের তাদেরকে প্রয়োজন। তবে এক্ষেত্রে একটি সমস্যা আছে। সেটি হচ্ছে, যদি এসব ব্যক্তি নীতিনির্ধারক হয়ে যান তাহলে সবকিছুই নিচের দিকে যাবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি গ্রুপ সবকিছুকেই প্রভাবিত করছে। সময় এসেছে রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের তা শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণে আনার। নীতিনির্ধারকরা যদি নীতি প্রণয়নের বিষয়টি নিজেদের হাতে না নেন তাহলে আমি মনে করি, চলমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না।

প্যানেল আলোচকদের অনেকেই বলেছেন প্রবৃদ্ধি কতটা প্রয়োজনীয়। কোনো সন্দেহ নেই যে এটি প্রয়োজন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে সবসময়ই কি এটি প্রয়োজনীয়। বাংলাদেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতির পেছনে যদি প্রবৃদ্ধির দায় থাকে তাহলেও কি এটি প্রয়োজনীয়? আমাদেরকে এভাবেও কিন্তু দেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলেন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলেন কেউ কিন্তু সেভাবে দেখছে না। আমি মনে করি, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগটি আরো শক্তিশালী করা উচিত যাতে এ ধরনের ইস্যুতে গবেষণা বাড়ানো যায়।

বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রবৃদ্ধি অবশ্যই মূল্যস্ফীতিকে প্রভাবিত করবে। এর পেছনে একেবারে সহজ কারণ হলো সম্পদের দিক থেকে বাংলাদেশ একেবারে দরিদ্র (রিসোর্স-পুওর)। বাংলাদেশ একটি আমদানিনির্ভর দেশ। এজন্য আপনার প্রবৃদ্ধি যত বেশি হবে আপনি তত অন্য দেশের সরবরাহের ওপর নির্ভর করবেন। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চাহিদার ব্যাপ্তি বাড়ছে কিন্তু সরবরাহ নেই। এমন পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি হওয়াই তো স্বাভাবিক। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে প্রভাবিত করছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা যে মূল্যস্ফীতির ধকল পোহাচ্ছি এর পেছনে কারণ খুঁজেছি কি? 

রিসোর্স মোবিলাইজেশনের আলাপে আসা যাক। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সময় আমি যখন অর্থ সচিব ছিলাম তখন আমরা বিভিন্ন কনসেপ্ট নোট প্রস্তুত করতাম। বেশির ভাগ কনসেপ্ট নোটই সরকার এখন পলিসি আকারে কার্যকর করছে। আমরা যেমন রেভিনিউ মোবিলাইজেশন নিয়ে একটি কনসেপ্ট নোট প্রস্তুত করেছিলাম। ওই কনসেপ্ট নোটে দেয়া সেই সাজেশনগুলো এখনো আমার মনে আছে। একটি সাজেশন ছিল, করনীতি ও কর প্রশাসনকে একে অন্য থেকে আলাদা করতে হবে। দুটো একসঙ্গে চলতে পারে না এবং চলা উচিত নয়। দ্বিতীয় যে সাজেশনটি ছিল, করনীতি কার্যকরের সময়েও কর আহরণ বিভাগটি কর মূল্যায়ন বা কর নিরীক্ষণ বিভাগ থেকে আলাদা থাকতে হবে। এতে স্বার্থের সংঘাত এড়ানো সম্ভব হবে। 

যাদের ফল দেয়ার সক্ষমতা নেই তাদের দায়িত্ব দিলে কর আহরণ বাড়বে না। আমরা দেখছি সরকারের কর রাজস্ব আহরণ কমছে। আমি যখন অর্থ সচিব ছিলাম তখন কর-জিডিপির হার ছিল ১২ শতাংশ। কিন্তু তা কমতে কমতে বর্তমানে জিডিপির ৮ শতাংশের নিচে নেমেছে। 

আমরা যদি রাজস্ব খাতের সংস্কার না করি এবং স্ট্যাটাস ক্যু (স্থিতাবস্থা) চলতে দিই তাহলে আমাদের কর আহরণ আশানুরূপ বাড়বে না। আজকের প্যানেল আলোচনার প্রধান অতিথি বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নরকে ধন্যবাদ দিতে চাই। অন্ততপক্ষে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ পলিসি ডিসিশন নিয়েছেন। সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাজারের কথা শুনেছেন। আমি মনে করি পলিসি নেয়ার ক্ষেত্রে প্রাজ্ঞতা প্রদর্শন করতে হবে, ফ্যাক্টসের ওপর ভিত্তি করে, বাজারের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে নিতে হবে। সর্বোপরি সরকারের লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে পলিসি গ্রহণ করতে হবে। 

আমি সবশেষে জোর দিয়ে বলতে চাই, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ছাড়া সরকারি ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভবপর নয়। আমি মনে করি, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় বাজেট ঘাটতি ৩ শতাংশ কিংবা তার নিচে নিয়ে আসা দরকার। 

ড. মোহাম্মদ তারেক: অর্থ মন্ত্রণাল‌য়ের অর্থ বিভা‌গের সা‌বেক সিনিয়র স‌চিব

[বণিক বার্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের যৌথ আয়োজনে দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রথম দিনে (৫ মে, ২০২৪) রাখা আলোচনায়।]

ভাষান্তর: সাবিদিন ইব্রাহিম ও সাবরিনা স্বর্ণা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন