স্বাধীনতার ৫৩ বছরে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ৩৩ বছর

অধ্যাপক আব্দুর রব

স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে একজন শিক্ষার্থীর স্বপ্ন বুনন শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। এ নতুন যাত্রাপথের ধাপে ধাপে থাকে মানসম্মত শিক্ষা, বিস্তৃত একাডেমিক পরিবেশ, শিক্ষক, গবেষণা, সহশিক্ষা কার্যক্রম, বন্ধু, আড্ডা, প্রাণোচ্ছল ক্যাম্পাস আর থাকে বুকভরা স্বপ্ন। দেশে তিন দশক সময় ধরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষা প্রসারে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। উচ্চশিক্ষার বর্ধিত চাহিদা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে মেটানো সম্ভব না হওয়ায় দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

স্বপ্নদ্রষ্টা অধ্যাপক ড. এম আলিমউল্যা মিয়ান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় প্রাথমিক পরিকল্পনা শুরু করেন ১৯৮০-এর দশকে, যা ১৯৮৯ সালে একটি কার্যপত্রে রূপ নেয় এবং ১৯৯১ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি) প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সাবেক পরিচালক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. এম আলিমউল্যা মিয়ান ১৯৮৯ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটি পরিদর্শনকালে বাংলাদেশের জন্য প্রথম Non-Government University Movement কার্যপত্রটি প্রণয়ন করেন। সেখানে তিনি প্রায় অর্ধশত শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা প্রশাসকের সঙ্গে এ বিষয়ে মতবিনিময় করেন। ক্যানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন পর্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা হলে বিশ্ববিদ্যালয়টি এ উদ্যোগে অংশগ্রহণ করার জন্য একটি Letter of Intent to Participate ইস্যু করেন। দেশে ফিরে এসে ড. এম আলিমউল্যা মিয়ান ১৯৮৯ সালের ২৭ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর আইইউবিএটি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাব জমা দেন। ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আইইউবিএটি যাত্রা শুরু করে।

যেসব কারণে বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশ ঘটেছিল সেগুলোর মধ্যে দুটি কারণ প্রণিধানযোগ্য: (১) উচ্চশিক্ষার বর্ধিত চাহিদা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষে মেটানো সম্ভব হচ্ছিল না এবং (২) দ্রুতবর্ধনশীল চাহিদা পূরণে একাধিক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সরকারের পক্ষে বাজেটে বরাদ্দ দেয়া সম্ভব না হওয়া। এসব কারণ বিবেচনায় উচ্চশিক্ষার চাহিদা পূরণে সরকারের প্রচেষ্টার পরিপূরক ভূমিকা পালন করতে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯২ পাস করে। অবশ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হওয়ার আগেই ড. মিয়ান ও দেশের স্বনামধন্য শিক্ষাবিদরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস কাজ করেছিলেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করে। এতে ডিগ্রি প্রোগ্রাম চার বছরে সম্পন্ন করতে হয়। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চাকরির বাজারে চাহিদা রয়েছে এমন সব বিষয় পড়িয়ে থাকে।

১৯৯৩ সাল অবধি বেসরকারি খাতে যে ভালো মানের উচ্চশিক্ষা প্রদান করা সম্ভব তা হাতেগোনা মাত্র অল্প কিছু লোক বিশ্বাস করত। বেসরকারি খাতকে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব প্রদান ঝুঁকিপূর্ণ বলে অনেকের আশঙ্কা রয়ে যায়। কিন্তু ১৯৯৬ সালে সরকার অনুমোদিত প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের গ্র্যাজুয়েটরা পাস করার পর পরই তুলনামূলকভাবে বেশি বেতনে চাকরি পেয়ে যাওয়ায় এ আশঙ্কা অমূলক বলে প্রমাণিত হয়। ইউজিসি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে যেকোনো বিষয়ে তথ্য চাওয়ার অধিকারী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে উল্লেখিত আবশ্যকীয় শর্তাদি যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে কিনা, তা নির্ধারণে ইউজিসি যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র-বেতন ও অন্যান্য ফি এবং শিক্ষকদের সম্মানী কাঠামো নির্ধারণের স্বাধীনতা রয়েছে। আয় ও ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ইউজিসি প্রণীত ছকে নিরীক্ষাকৃত বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন অবশ্যই শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিতে দাখিল করতে হয়। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে দ্রুত বিকাশমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিকাশের সূত্র ধরে উচ্চ শিক্ষার্থে শিক্ষার্থীদের বিদেশে যাওয়ার হার কমেছে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এভাবে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণায় উচ্চ মান অর্জনে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। ভবিষ্যতে দেশে বিশ্বমানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদার প্রসার ঘটবে। উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান জাতীয় চাহিদা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাদ দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। একটা সময় ছিল যখন যেসব শিক্ষার্থী সাধারণত কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারত না, তারাই মূলত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতো। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েও নিজের পছন্দমতো বিষয় পায়নি বলেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পছন্দমতো বিষয়ে ভর্তি হয়। আবার অনেকে মানসম্পন্ন শিক্ষা অনুকূল পরিবেশের কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান যথেষ্ট ভালো। তাছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ সেশন জটের কোনো সম্ভাবনাও থাকে না, ফলে নির্দিষ্ট সময়ে পড়া শেষ করা যায়। পাশাপাশি মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিয়ে থাকে নানা ধরনের বৃত্তির সুবিধা। ফলে শিক্ষার্থীরা কম খরচে তাদের উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করতে পারে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে, যার কারণে শিক্ষার্থীরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। 

আন্তর্জাতিক রÅvকিংয়ে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সফলতা উচ্চশিক্ষা বিস্তারে বড় ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক আকারে ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে। এতে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে তথ্য ও প্রযুক্তির মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার কোর্স কারিকুলাম দেখে বাংলাদেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা আসছে। বর্তমানে ২৬টির বেশি দেশের শিক্ষার্থী বাংলাদেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছেন। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশ, যেমন আমেরিকা, কানাডা, চীন ও জাপান থেকেও শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে আসছেন। এতে একদিকে যেমন বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হারও বাড়ছে।

দেশে বর্তমানে শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। ভবিষ্যতে আরো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে। শিক্ষার মান আরো বাড়বে। এতে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গমনের প্রবণতা হ্রাসের পাশাপাশি মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় ও মেধা পাচার রোধ করা সম্ভব হয়। এমনকি অনেক বিদেশী শিক্ষার্থীও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়তে বাংলাদেশে আসছে। এছাড়া দেশে ও বিদেশে বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নতুন উদ্যোক্তা ও পেশাজীবী তৈরিসহ বিশাল জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তর করার মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে এবং অবদান রাখছে। আর তা শুরু হয়েছিল আইইউবিএটি প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে।

লেখক: উপাচার্য, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন