বিশ্লেষণ

উন্নতি দেখাতে গিয়ে কৃত্রিম পরিসংখ্যান অর্থনীতির ক্ষতির কারণ হতে পারে

কায়সুল খান

সম্প্রতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫২ বছর উদযাপনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের মানুষের গড় মাথাপিছু জিডিপি নিয়ে প্রবল আলোচনা চলছে। লক্ষণীয় যে সার্কভুক্ত প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের অর্থনীতিকে মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে বাংলাদেশের অগ্রগতি পরিমাপ করা হচ্ছে। ব্রিটিশ ভারত থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর অপশাসন, পক্ষপাতমূলক আচরণ এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের নীতিকে চ্যালেঞ্জ করে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাস আমরা কমবেশি সবাই জানি। কৃষি, বাণিজ্য, শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সেবার মানে একসময় বাংলাদেশের চেয়ে প্রবলভাবে এগিয়ে থাকা রাষ্ট্র দুটিকে নির্দিষ্ট কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সাফল্যের সঙ্গে পেছনে ফেলার ঘটনা অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। তবে একই সঙ্গে এটিও নজরে রাখা উচিত যে নিজেদের উন্নতির চিত্র উপস্থাপন করতে গিয়ে কৃত্রিম ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পরিসংখ্যানের অপব্যবহার যেন না হয়। সেটি দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হতে পারে। 

জিডিপি অর্থনীতির একটি কঠিন পারিভাষিক শব্দ। দৈনিক পত্রিকার পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে সরলভাবে বলা যায়, নির্দিষ্ট কোনো সময় বা অর্থবছরে বাংলাদেশে আমাদের শ্রমিক-কর্মচারী এবং সেবাদানকারী নানা পেশার মানুষ কাজের মাধ্যমে যা কিছু দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন করে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছে দেয়, সেগুলোর অর্থমূল্য অর্থাৎ টাকার অংকে যে দাম হয় তাকে জিডিপি বলে। এই জিডিপিকে দেশের মোট জনসংখ্যা এবং কর্মক্ষম নাগরিকের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে যথাক্রমে জিডিপি পার ক্যাপিটা এবং জিডিপি পার ওয়ার্ক ফোর্স পাওয়া যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কর্মক্ষম ব্যক্তির ওপর পরিবারের অন্যান্য সদস্যের নির্ভরশীলতা বুঝতে জিডিপি পার ওয়ার্ক ফোর্স জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জিডিপি-ভিত্তিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখা জরুরি। দ্রব্য বা সেবা অবশ্যই দেশের ভৌগোলিক সীমার মাঝে উৎপাদিত হতে হবে এবং রফতানীকৃত দ্রব্যের মূল্য থেকে আমদানীকৃত দ্রব্যের মূল্যমানকে বিয়োগ দিয়ে যে নিট রফতানি থাকবে কেবল সেটিই জিডিপির অংশ হিসেবে বিবেচ্য হবে। 

জিডিপি কি আসলেই মানুষের জীবনযাত্রার মানকে বর্ণনা করতে সক্ষম? তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় উপায়েই এ প্রশ্নের নিঃশর্ত উত্তর মেলানো কঠিন। কেননা আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্ফীতি, বাজারে দ্রব্যের জোগান, আমদানি-রফতানির ভারসাম্য, ক্রেতার রুচি ও পছন্দ, ক্রয়ক্ষমতা এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য ব্যবহৃত বিশেষ ও নির্দিষ্ট মুদ্রার মানের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রার মূল্যমান ইত্যাদি নাগরিকের ক্রয়ক্ষমতা কিংবা অর্থনৈতিক দ্রব্য ভোগের নিরিখে ভালো থাকার প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। একজন মানুষের আয় যত বেশিই হোক না কেন, ব্যয় যদি সামঞ্জস্যপূর্ণ কিংবা আয়ের চেয়ে কম না হয় তবে জীবনযাত্রার মানে বাস্তবিক অর্থে উন্নতি ঘটে না। কেননা শুধু ভোগ্যপণ্যের সংখ্যার বিস্তৃতি ঘটলেও জীবন থেকে অভাব দূরীভূত হয় না। আমরা জানি, পৃথিবীতে যাবতীয় অর্থনৈতিক সমস্যার মূলে রয়েছে সীমাহীন অভাববোধের বিপরীতে সীমিত সম্পদ থাকার চিরস্থায়ী দুর্বলতা। 

আমরা যদি সাম্প্রতিক সময়ের মূল্যস্ফীতির দিকে নজর দিই সেক্ষেত্রে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে বাংলাদেশে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ২৯, ৯ দশমিক ৩৭ ও ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। প্রায় দুই অংক ছুঁই ছুঁই এ মুদ্রাস্ফীতি বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যদিও সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পরিপত্রে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছিল, কিন্তু সাফল্যের টালিখাতা কী অর্জিত হয়েছে তা তো উপর্যুক্ত পরিসংখ্যানেই সুস্পষ্ট। উচ্চ হারে মুদ্রাস্ফীতি জারি থাকায় গড় আয় বাড়ার পরও বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। ফলে বাস্তবে দারিদ্র্য বাড়ছে। 

জিডিপির একটি দুর্বলতা হলো, এ পরিসংখ্যান দিয়ে কোনো দেশের অর্থনীতিতে ধনবৈষম্যের আসল প্রমাণ প্রকাশ পায় না। কেননা জিডিপি দিয়ে কোনো দেশের অর্থনীতির বাস্তবিক অবস্থা পরিমাপের ক্ষেত্রে আউটলায়ার অর্থাৎ অস্বাভাবিক প্রভাবকগুলো বাস্তবিক ফলাফল নির্ধারণে ব্যাপক প্রভাব রাখার ক্ষমতা রাখে। দারিদ্র্য নিরসন ইস্যুতে কাজ করা অক্সফামের ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাত্র ১ শতাংশ ধনী ব্যক্তির হাতে বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদের ১৬ দশমিক ৩ শতাংশের মালিকানা রয়েছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে সম্পদের বৈষম্য বাড়ার যে প্রবণতা দৃশ্যমান হয় তাতে গত দুই বছরে উপর্যুক্ত ১ শতাংশ ধনিক শ্রেণী কর্তৃক আরো বেশি পরিমাণ জাতীয় সম্পদ করায়ত্ত হয়ে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

দ্রব্যের চাহিদার প্রেক্ষাপট থেকে বাংলাদেশকে নিয়ে স্টাডি করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বিলাসদ্রব্যের চাহিদা কয়েক বছর ধরে প্রবলভাবে বাড়ছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ৬১০ মিলিয়ন ইউএস ডলারের বিলাসদ্রব্য বিক্রি হয়। ২০২০ সালে কভিড-১৯-এর সময় সেটি ৫০৯ মিলিয়নে নেমে এলেও ২০২১ থেকে সেই ক্রম আবার ঊর্ধ্বমুখী। ২০২২ সালে যেটি ছিল ৮৫৬ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশী জনগণ বিলাসদ্রব্যের পেছনে ব্যয় করেছে ৮৯৯ মিলিয়ন ডলার। পারিবারিক আয় ও ব্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে করা গবেষণায় প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২২ সালে বাংলাদেশের অন্তত ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ নাগরিক দারিদ্র্যসীমায় অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং ৫ দশমিক ৬ শতাংশ নাগরিকের অবস্থান ছিল তীব্র দারিদ্র্যসীমার তালিকায়। 

সার্কভুক্ত দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে তুলনা করতে তিনটি দেশের জনগণের ক্রয়ক্ষমতা সূচকের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জিডিপি-ভিত্তিক ক্রয়ক্ষমতা ৮ হাজার ৬৭০ ডলার হলেও ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা যথাক্রমে ৯ হাজার ১৮০ ও ৬ হাজার ৭৭০ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা বিবেচনায় না নিলেও ক্রয়ক্ষমতা সূচকে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে বেশ এগিয়ে আছে তবে ভারতের চেয়ে পেছনে। কিন্তু বিস্মৃত হওয়া অনুচিত যে পাকিস্তান রাষ্ট্র কর্তৃক অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হওয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনার অন্যতম কারণ ছিল। তাই অর্থনীতির যেকোনো সূচকে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে থাকা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তির কারণ হতে পারে না।

বাংলাদেশের মানুষের আয় বৃদ্ধি পেলেও জীবন মানের কতটা উন্নতি হয়েছে সেটি পরীক্ষা করতে আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং গড় আয়ুর ওপর লক্ষ করা যেতে পারে। শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বিনিয়োগ জিডিপির ২ শতাংশের নিচে, যা ইউনেস্কো নির্ধারিত মানদণ্ডের এক-তৃতীয়াংশও নয়। অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের বিনিয়োগ জিডিপির ৩ শতাংশের কিছু বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশী জনগণের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৪ বছর এবং নারীরা পুরুষ অপেক্ষা সামান্য দীর্ঘ জীবন পায়। বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী যেহেতু গৃহ অভ্যন্তরে জীবনযাপন করে এবং মূলত পুরুষ শ্রেণী আয়-রোজগারের উদ্দেশে বাইরে যায়, তাই আমাদের কর্মক্ষম শ্রেণীর কর্মক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক কোনো চাপের প্রভাব পুরুষের কাঙ্ক্ষিত আয়ুর ওপর প্রভাব ফেলছে কিনা সেটি নিয়ে গবেষণা হওয়া জরুরি। প্রাসঙ্গিকভাবে জানিয়ে রাখা ভালো যে ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে নাগরিকের কাঙ্ক্ষিত গড় আয়ু যথাক্রমে ৭২ ও ৬৯ বছর। একই সঙ্গে বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের নানা আপত্তির হেতু অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নাগরিকের জীবনযাত্রার মানের ওপর তীব্রভাবে প্রভাব ফেলে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে কখনো পাঁচ বছর একটানা রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকার প্রমাণ মেলে না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত হন তাদের আন্তরিকতা থাকলে বিরোধীদের প্রবল প্রতিরোধ কিংবা ক্ষমতাসীনের তীব্র ক্ষমতার লোভ, যে কারণই হোক না কেন নাগরিকের ভালো থাকা তথা রাজনৈতিক পরিবেশের স্থিতিশীলতা বরাবরই বিরল ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে রাজনীতি ও অর্থনীতি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। রাজনৈতিক পরিবেশের বিশ্লেষণ করলেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতিকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব। প্রশ্ন হলো, আমরা সততার সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্টাডি করার মতো সৎ সাহস এবং যোগ্যতা রাখি কি?

কায়সুল খান: শিক্ষার্থী ও গবেষক

নোভা ইউনিভার্সিটি অব লিসবন, পর্তুগাল

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন