আলোকপাত

পাট থেকে তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের উত্থানের গল্প

ড. জাইদি সাত্তার

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের শিল্প খাত বলতে ছিল পাট শিল্প। বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী খাত হিসেবে গুরুত্বের কারণে পাটকে বলা হতো সোনালি আঁশ। একদিকে পাট শিল্পের পতনের সঙ্গে সঙ্গে নাটকীয়ভাবে উত্থান হয় তৈরি পোশাক শিল্পের (আরএমজি)। শুরুর দিকে কেউই ভাবেনি আরএমজিতে বাংলাদেশ এত দূর যাবে এবং বিশ্বের শীর্ষ তিন রফতানিকারকের জায়গায় চলে যাবে। 

পাট শিল্পের সবচেয়ে ইতিবাচক দিকটি ছিল আমাদের দেশে এর ব্যাপক ফলন হয়। অর্থাৎ এ শিল্পের কাঁচামাল দেশেই পাওয়া যায়। আমাদের জুট মিলগুলোও ছিল অনেক বড়। আদমজী জুট মিলস পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাট কারখানা ছিল। ১৯৮০ সাল নাগাদ শতকরা ৭০ ভাগ রফতানি ছিল পাট ও পাটজাত দ্রব্য (জুট, র জুট ও জুট গুডস)। কিন্তু নব্বইয়ের দশক আসতে আসতে সেটা নেমে ৪০ শতাংশে এসে গেল। আশির দশক থেকে তৈরি পোশাক শিল্পের আবির্ভাব হলো। এখানে দক্ষিণ কোরীয় কোম্পানি দাইয়ুর একটা বড় অবদান ছিল। সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশে আমরা তুলা উৎপাদন করি না। টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিও এত বড় ছিল না। সে সময় বরং ভারত ও পাকিস্তান অনেক এগিয়ে ছিল। সে হিসেবে তাদেরই তো পোশাক শিল্পের রফতানিতে বড় হওয়ার কথা। বাংলাদেশ কী করে পারল? সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার যে কোম্পানি দাইয়ু গ্রুপ তারা দেখিয়ে দিল আমরা তৈরি পোশাকে ভালো করতে পারি। 

আমাদের তখন প্রায় ৪০ শতাংশ পণ্যের ওপর ১০০ শতাংশের বেশি শুল্ক ছিল। ওই অবস্থায় রফতানি করা মুশকিল ছিল। কারণ তখন বিশেষ করে পোশাক শিল্পে শতকরা ৯০ ভাগ কাঁচামাল কাপড়, ইয়ার্ন ও অ্যাকসেসরিজ—সব আমদানি করতে হতো। কিন্তু সে অবস্থায় আমরা কী করে রফতানি করতে পারলাম। প্রধান কারণ হচ্ছে পোশাক শিল্প হচ্ছে শ্রমঘন শিল্প। টেক্সটাইলের প্রক্রিয়ায় যে শেষ ধাপ, সেটা হচ্ছে কাপড় বানানো বা তৈরি করা, সেটি শ্রমঘন শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। 

শ্রমঘন শিল্পে তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। দক্ষিণ কোরীয় কোম্পানি বুঝল বাংলাদেশে সস্তায় শ্রমিক পাওয়া যাবে। এদিকে ১৯৭৪ সালে মাল্টি ফাইবার অ্যারেঞ্জমেন্ট (এমএফএ) হলো। উন্নত বিশ্ব অনুভব করল উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে নিজেদের আমদানি সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেহেতু ইইউ আমদানি সীমিতকরণ প্রত্যাখ্যান করে, রফতানি বাড়তে থাকে। পরে জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্রেড (জিএটিটি) উরুগুয়ে রাউন্ডে টেক্সটাইল বাণিজ্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এখতিয়ারে আসে। সবশেষে এগ্রিমেন্ট অন টেক্সটাইল অ্যান্ড ক্লদিং এমএফএর অধীন কোটা পর্যায়ক্রমে বিলুপ্ত করার পথ খুলে দেয়। 

দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুরের মতো দেশ প্রচুর পোশাক রফতানি করত। সে সময় যেসব দেশ রফতানি করতে পারছিল না, তাদের কোটা দিল এমএফএ। একটা বাজারের ব্যবস্থা হলো, কিন্তু রফতানি করতে হলে তো প্রস্তুত করতে হবে। সেসব বাজারে প্রতিযোগিতামূলকভাবে রফতানি করতে হবে। সেই পথটা দেখাল দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু কোম্পানি। তারা বাংলাদেশকে বোঝাল, তোমরা এত শুল্ক দিয়ে কাঁচামাল আমদানি করে পোশাক শিল্পের রফতানি করতে পারবে না। এটাকে যদি ডিউটি ফ্রি (শুল্ক মুক্ত) আমদানির ব্যবস্থা করা যায় তখন ভালো ফল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এগিয়ে এলেন নুরুল কাদের খান নামে এক জাঁদরেল আমলা। সরকারি চাকরি ছেড়ে তিনি দেশ গার্মেন্টস চালু করলেন। তিনি তখন বুদ্ধিটা সরকারকে দেন, বাংলাদেশ ব্যাংক, রাজস্ব বোর্ড, অর্থ মন্ত্রণালয়ে কথা বলেন। যেহেতু তিনি প্রভাবশালী সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা ছিলেন, তার কথা তারা শুনে ডিউটি ফ্রি আমদানির ব্যবস্থা করেন। 

সেই ডিউটি ফ্রি আমদানির ব্যবস্থার ফলে আমাদের যে তুলনামূলক সুবিধা সেটা শ্রমঘন শিল্পে ব্যবহার করতে পারি। এ সুবিধার কারণে ডিউটি ফ্রি কাঁচামাল আমদানির সুযোগ তৈরি হয়। এখন ডিউটি ফ্রি কাঁচামাল আমদানিতে একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে। আমাদের কাঁচামাল আমদানিতে ১০০ শতাংশ শুল্ক দিতে হয় যেখানে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশে শুল্কমুক্ত আমদানির সুবিধা ছিল। এতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা চ্যালেঞ্জিং ছিল। তখন বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা ভালো একটা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন; ব্যাক টু ব্যাক এলসির ব্যবস্থা। তখন প্রচুর আমদানি করতে হতো, এর মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ ছিল কাঁচামাল। আমদানির পেমেন্ট রফতানি আয়ের মাধ্যমে করা হতো। তখন খুব কম বিনিয়োগে এ শিল্পগুলো চালু করা যেত। সেটাও বাংলাদেশের জন্য সুবিধা ছিল। কারণ বাংলাদেশে প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করার মতো শিল্পপতি অত ছিল না। এভাবেই তৈরি পোশাক শিল্প গড়ে উঠল। ধীরে ধীরে দেখা গেল, ২০০০ সালে তৈরি পোশাক খাতে আমাদের রফতানি ৭০ শতাংশ হয়ে গেল। এখন তো ৮২-৮৪ শতাংশ। একদিকে পাটে রফতানি কেন্দ্রীভূত ছিল, সেখান থেকে সরে আসা হলো। এখন শিল্পজাতীয় পণ্যে আমরা ভালো অবস্থানে এসেছি। এখানে রফতানি কেন্দ্রীভূত হলো। তবে এ গার্মেন্টস ছাড়া অন্যান্য পণ্য রফতানিতে ভালো সাড়া ফেলতে পারছি না। 

তৈরি পোশাক শিল্পের পর আরেকটি সম্ভাবনাময় শিল্প ছিল জুতা শিল্প। আন্তর্জাতিকভাবে এ শিল্পের যে স্ট্রাকচার (কাঠামো) তা আরএমজির সঙ্গে মিলে। এখানে বড় বড় রফতানিকারক আছেন, কোম্পানি আছে। যেমন নাইকি, অ্যাডিডাস, রিবোকের মতো কোম্পানি, যারা বড় অংকের পণ্য বিক্রি করে। কিন্তু তাদের ব্যাপারটা হচ্ছে, নিজেদের কোনো কারখানা নেই। ওরা কী করে? ওরা চীন ও ভিয়েতনামের মতো জায়গায় যায়। বাংলাদেশেও আসে। এরা গার্মেন্টের মতোই বায়ার। তারা জুতোর ডিজাইন নিয়ে আমাদের এখানে আসে, চুক্তি করে এবং অর্ডার দেয়। এভাবে বিভিন্ন দেশের কারখানায় তৈরি জুতাই যায় ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন বাজারে। 

বাংলাদেশে কিন্তু পোশাক শিল্পের পর জুতা দ্বিতীয় বৃহৎ শিল্প হওয়া উচিত ছিল। কেন হচ্ছে না সেটা তার কারণ অনুসন্ধান করা দরকার। গার্মেন্ট ছাড়া অন্যান্য শিল্পে কেন আমাদের রফতানি বাড়ছে না? রফতানির বৈচিত্র্যায়ণ কেন হচ্ছে না? আমরা অনেকদিন ধরে বলে এসেছি, এখন আমরা গবেষণা করে এটি দেখিয়ে দিয়েছি আমাদের যে শুল্ক ব্যবস্থা আছে, এ শুল্ক ব্যবস্থা এবং যেটাকে বলি সংরক্ষণমূলক। উচ্চ বাণিজ্য শুল্কের কারণে স্থানীয় বাজারে বিক্রি অনেক লাভজনক। যেমন বাংলাদেশের বাজারে যদি জুতার দাম হয় ১ হাজার টাকা তা রফতানিতে দাঁড়ায় ৫০০ টাকা। এমনটা হলে জুতা কোম্পানি কি রফতানি করবে না দেশী বাজারে বিক্রি করবে? এটি একটা বিষয়, কারণ বাজার ‍দুটো আছে। একটা হচ্ছে রফতানি বাজার, আরেকটি হচ্ছে দেশীয় বাজার। যেদিকে মুনাফার হার বেশি হবে, সেদিকেই সে ধাবিত হবে। এখানে আমাদের যে শুল্ক সংরক্ষণ নীতি চলে এসেছে, সে নীতিটা এমন যে বিক্রি করলে মুনাফা বেশি থাকে, এগুলো আর রফতানি হচ্ছে না। সুতরাং, গার্মেন্টের বাইরে অন্যান্য শিল্পকে দাঁড়াতে হলেও বাণিজ্যনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। শতভাগ রফতানিমুখী হওয়ায় তৈরি পোশাক শিল্পের পথে তেমন বাধা নেই। গার্মেন্ট-বহির্ভূত শিল্পে নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। আমরা প্রতি বছর ১৫শ থেকে ১৬শ পণ্য রফতানি করে থাকি। কিন্তু তাদের রফতানি ভ্যালু খুবই কম। ১ মিলিয়ন ডলারেরও কম রফতানি করে এমন কোম্পানি প্রচুর। সেখানে রফতানি বাড়ছে না তার প্রধান কারণ হচ্ছে আমাদের শুল্ক সংরক্ষণ নীতি। এর ফলে দেশীয় বাজারে মুনাফার হার অনেক বেশি থাকে। বাংলাদেশের সাধারণ ভোক্তারা কিন্তু অনেক বেশি দামে সেসব পণ্য কিনছে, বিশেষ করে ভোগ্যপণ্য। বেশি দামটা হিসাবও করা যায় যে আমরা আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় কত বেশি দামে জিনিসপত্র কিনছি। আমাদের সাধারণ ধারণা, বিদেশী পণ্য মানেই ওটার দাম বেশি। কিন্তু দাম আসলে বেশি না, দাম বেশি পড়ে শুল্কের কারণে। আপনি যদি জুতার ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন তাহলে জুতার প্রকৃত দাম ৫০০ টাকা হলেও তা ১ হাজার টাকায় বিক্রি হবে। এ কারণেই আমরা যতই চেষ্টা করছি না কেন রফতানিতে বৈচিত্র্য আনতে পারছি না। রফতানি করার মতো আমাদের বহু পণ্য আছে। প্লাস্টিক পণ্য আছে, কৃষিজাত পণ্য আছে, ইলেকট্রিক্যাল গুডস আছে। এখন তো মোবাইল ফোন টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিনও তৈরি হচ্ছে। 

জুতা শিল্পের দ্বিতীয় বৃহৎ রফতানিমুখী শিল্প খাত না হয়ে ওঠার কারণ হচ্ছে, রফতানিতে আমাদের একটা নিরীহ ব্যবস্থা ধরে রাখা। বিদ্যমান ব্যবস্থায় রফতানি করলে মুনাফার হার বেশি হয় না। দেশীয় বাজারে বিক্রি করলে যে লাভ হয় রফতানিতে তা হয় না। কিন্তু রফতানি বাজারে প্রবেশ করলেই আমাদের জুতা শিল্প বড় হওয়ার সুযোগ তৈরি হতো এবং এতে তৈরি পোশাক খাতের মতো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো। প্রথমত কথা হলো, বাণিজ্য শুল্ক দিয়ে দেশীয় বাজারকে লাভজনক করে রাখার ব্যবস্থাটা ভালো নয়। এতে রফতানি করার প্রণোদনা হারান উৎপাদকরা। দ্বিতীয়ত, দেশীয় বাজার আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অনেক ছোট। এখানে শিল্পের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত শুধু মুনাফা করা নয়। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। রফতানিমুখী শিল্পে যেমন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়, দেশীয় শিল্পে এ রকম কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা যায় না। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার অনেক বড় হয়েছে। এখন তা ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের তুলনায় দেখলে বেশ বড়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজার হচ্ছে ১০০ ট্রিলিয়ন ডলারের। আমাদের তাই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের লক্ষ্য নিয়েই এগোনো উচিত। এতে যেমন অসংখ্য কর্মসংস্থান হবে তেমনি বড় হবে আমাদের অর্থনীতির আকার। 

ড. জাইদি সাত্তার: চেয়ারম্যান

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)

অনুলিখন: তৌফিকুল ইসলাম ও অনি আতিকুর রহমান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন