২০২২-২৩ অর্থবছর

জ্বালানি তেলের উচ্চদামে বিপিসির কর-পূর্ববর্তী মুনাফা ৬২৯৬ কোটি টাকা

আবু তাহের

অস্থিতিশীলতা কাটিয়ে ২০২২ পঞ্জিকাবর্ষের মাঝামাঝি নিম্নমুখী হয়ে ওঠে জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার। যদিও আগস্টে দেশের বাজারে রেকর্ড মাত্রায় বাড়ানো হয় ডিজেল-অকটেন-পেট্রলসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম। এর ধারাবাহিকতায় গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) জ্বালানি তেল বিক্রি বাবদ আয় বেড়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি)। যাবতীয় পরিচালন ও আর্থিক ব্যয় বাদ দিয়ে গত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির কর-পূর্ববর্তী মোট মুনাফা হয়েছে ৬ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। আর কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এ সময় সরকারি কোষাগারে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট, লভ্যাংশ, আয়করসহ বিভিন্ন খাতে মোট ১৫ হাজার ৪৯২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা দিয়েছে বিপিসি। 

বিপিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে সংস্থাটি জ্বালানি তেল বিক্রি করেছে ৭৩ লাখ ৪৬ হাজার টন। মোট আয় হয়েছে ৭৯ হাজার ১৮৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এ সময় জ্বালানি তেল আমদানি ও প্রক্রিয়াজাতসহ সংস্থাটির বিক্রীত পণ্যের ব্যয় (কস্ট অব গুড সোল্ড) ছিল ৭৩ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। সে অনুযায়ী গত অর্থবছরে সংস্থাটির মোট লাভ হয়েছে ৬ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। এর সঙ্গে অন্যান্য আয় যোগ করে এবং তা থেকে পরিচালন ও আর্থিক অন্যান্য ব্যয় বাদ দিয়ে বিপিসির কর-পূর্ববর্তী মুনাফা দাঁড়ায় ৬ হাজার ২৯৬ কোটি টাকায়।

এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে বিপিসির জ্বালানি তেল বিক্রি থেকে আয় ছিল প্রায় ৫৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। আর বিক্রীত পণ্যের ব্যয় ছিল ৫৭ হাজার ১৩ কোটি টাকা। ওই সময় সংস্থাটির মোট লোকসান হয়েছিল ৩ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। সে সময় সংস্থাটির কর-পূর্ববর্তী লোকসান ছিল ২ হাজার ২২২ কোটি টাকা। আর কর-পরবর্তী নিট লোকসান হয়েছিল ২ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা।

ওই অর্থবছরে মোট ৬৯ লাখ ১৫ হাজার টন জ্বালানি পণ্য বিক্রি করেছিল বিপিসি। বিক্রির পরিমাণ ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৭৩ লাখ ৪৬ হাজার টন। সে অনুযায়ী গত অর্থবছরে বিপিসির জ্বালানি পণ্য বিক্রি বেড়েছে ৪ লাখ ৩১ হাজার টন।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিপিসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্যের কারণে বিপিসি গত অর্থবছরের প্রথমার্ধে লোকসানে ছিল। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় সংস্থাটি তার লোকসান কাটিয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য আগের মতো অব্যাহত থাকলে বিপিসি লোকসান করত। তবে দাম কমায় ওই অর্থবছরে লাভে ফেরে।’

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের ৫ আগস্ট বিশেষ আইনের আওতায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। সেই সময় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। আর অকটেনের দাম ৮৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা আর পেট্রলের দাম ৮৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩০ টাকা করা হয়। 

যদিও পরে কিছুটা কমিয়ে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১০৯ টাকা, অকটেনের দাম ১৩০ এবং পেট্রলের দাম ১২৫ টাকা নির্ধারণ করে জ্বালানি বিভাগ, যা এখনো কার্যকর রয়েছে। সে সময় বিপিসির পক্ষ থেকে জানানো হয় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে সংস্থাটির। ওই লোকসান কমাতে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল বলে মনে করে বিপিসি।

প্রতিষ্ঠানটির জ্বালানি তেল আমদানির চিত্র থেকে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ১৫ লাখ ৫১ হাজার টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করেছে বিপিসি। এর মধ্যে ৬ লাখ ৮২ হাজার টন মারবান ক্রুড ও ৮ লাখ ৬৯ হাজার টন অ্যারাবিয়ান ক্রুড। গত অর্থবছরে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ সংস্থাটির ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা।

এছাড়া সংস্থাটি এ সময় প্রায় ৪০ লাখ ৩৬ হাজার টন ডিজেল আমদানি হয়েছে, প্রায় ৩ লাখ ৩৭ হাজার টন মোগ্যাস, ৪ লাখ ৭৮ হাজার টন জেট ফুয়েল, প্রায় ৪ লাখ ৩৬ হাজার টন ফার্নেস অয়েল ও ৩০ হাজার টন মেরিন ফুয়েল আমদানি করেছে। সব মিলিয়ে সংস্থাটি এ সময় মোট পরিশোধিত জ্বালানি আমদানি করেছে প্রায় ৫৩ লাখ ১৭ হাজার টন। এ পরিমাণ পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে বিপিসির খরচ হয়েছে ৫১ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। 

বিপিসি বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংস্থাটি মোট ৬৮ লাখ ৬৭ হাজার টন পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি করেছিল, যার মূল্য ছিল ৬২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা।

দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদার মাত্র ৮ শতাংশ পূরণ হয় স্থানীয় উৎস থেকে। বাকি চাহিদার পুরোটাই পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। বিপিসি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে দুটি দেশ থেকে। এ দুই দেশের সরবরাহকারী দুই প্রতিষ্ঠান হলো সৌদি আরবভিত্তিক সৌদি আরামকো ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি লিমিটেড। এর বাইরে আটটি দেশ থেকে জিটুজি চুক্তির মাধ্যমে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। কুয়েতভিত্তিক কুয়েত পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (কেপিসি), মালয়েশিয়ার পেটকো ট্রেডিং লাবুয়ান কোম্পানি লিমিটেড (পিটিএলসিএল), চীনের পেট্রোচায়না পিটিই লিমিটেড, ইন্দোনেশিয়ার পিটি বুমি সিয়াক পুসাকু (বিএসপি), চীনের ইউনিপেক পিটিই লিমিটেড, থাইল্যান্ডের পিটিটি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং বা পিটিই লিমিটেড ও ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) এখন বিপিসিকে পরিশোধিত জ্বালানি তেল সরবরাহ করছে। ভোক্তা পর্যায়ে পেট্রোলিয়াম পণ্যের মধ্যে এখন ডিজেলের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি পরিবহন খাতেও জ্বালানি হিসেবে পণ্যটির ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। এইচএফও বা ফার্নেস অয়েল ব্যবহার হচ্ছে শিল্প ও পরিবহন খাতে।

জ্বালানি তেল বিক্রিতে মুনাফার বিষয়টি নিয়ে বিপিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের মুখবন্ধে বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ বলেন, ‘‌রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে জ্বালানি তেলের অতি উচ্চমূল্য কাটিয়ে সব ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের কারণে দেশ এ সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন