অভিমত

কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে কি?

মো. বশিরুল ইসলাম

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘মহেশ’। সেখানে আমরা দেখেছি, গ্রামের জমিদার ও পুরোহিতদের অত্যাচারে গরিব চাষী গফুর মেয়ে আমিনার হাত ধরে রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে যাত্রা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভূমি থেকে উৎখাত হওয়ার পর কৃষকের এই যে করুণ অবস্থা, তা থেকে এ দেশ আজও কি মুক্ত হতে পেরেছে?

এ রকম প্রশ্ন দিয়ে লেখা শুরু করা হয়তোবা অবাস্তব মনে হচ্ছে। কারণ দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দীর্ঘদিন ধরে প্রচার হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো চলতি বছর মৌসুমের শুরুতে অর্থাৎ মার্চে কৃষকরা প্রতি কেজি আলু বিক্রি করেছেন ১০-১২ টাকায়। সে কৃষককে বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু কিনতে হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকায়। শুধু আলু নয়, সব কৃষিপণ্যেই একই অবস্থা। শুধু উন্নতি হচ্ছে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের। আসলে সোনার বাংলায় সোনার ফসল ফলিয়েও কৃষকের ভাগ্যের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হচ্ছে না। কোনো রকমে খেয়েপরে বেঁচে আছেন কৃষক। যেমনটা হয়েছিল মহেশ গল্পে গফুর মিয়ার। এসব কথা বলার কারণ হচ্ছে, ১ অগ্রহায়ণ, জাতীয় কৃষি দিবস পালিত হলো। দিনটি শুধুই কৃষকদের জন্য ছিল। তাদেরকে ও তাদের কাজকে সম্মানের জন্য এ আয়োজন করা হলেও কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে কি?

হাজারো দিবসের মধ্যে একটি দিবস নির্ধারিত হয়েছে, যাতে দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষের সম্পৃক্ততা রয়েছে। মনে আছে, ২০০৮ সালে যখন বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট, বাংলাদেশে দুই দফা বন্যা এবং সিডরের মতো বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে চালের সরবরাহ কমে গিয়েছিল এবং মূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ অর্থ দিয়েও চাল কিনতে পারেনি। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারত চাল রফতানির ক্ষেত্রেও নজিরবিহীন টালবাহানা শুরু করে দিয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের জাতীয় নেতাদের বোধোদয় হয়। তারা বুঝতে পারেন জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কৃষিকে গুরুত্ব দেয়ার বিকল্প নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১ অগ্রহায়ণকে জাতীয় কৃষি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। তারপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতা নেয়ার পর ২০০৯ সালে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ১ অগ্রহায়ণ পালিত হয় জাতীয় কৃষি দিবস হিসেবে।

কৃষি দিবস পালনের ক্ষেত্রে এখন প্রশ্ন আসতে পারে, যে কৃষকের জন্য এ দিবস পালন করা হয় তাদের ভাগ্য কি আজও পরিবর্তন হয়েছে। কারণ আমাদের দেশে সিংহভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অথচ বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের অবস্থা দিন দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। কৃষকের বর্তমান দুর্দশা মৌসুমি নয়; তা অব্যাহত থাকে সারা বছর। কেননা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কৃষক তার কষ্টার্জিত ফসলের ন্যায্য দাম পান না এবং বছরজুড়ে সীমাহীন বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। কৃষকের সংকট নিয়ে সারা বছরই ঘুরে-ফিরে এসব কথা বলে আসছি। কোনো উন্নতি হচ্ছে না। বরং বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কৃষকের ফসল উৎপাদনের উপকরণের দাম বেড়ে গেছে। ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম বাড়লেও প্রকৃত কৃষক উৎপাদন খরচই তুলতে পারছেন না। এখানে লাভের অংশ চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে। প্রতি বছর লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে কৃষক ন্যূনতমভাবে বেঁচে থাকার জন্য নতুন করে কাজ শুরু করেন।

আমি নিজেও একজন কৃষক পরিবারের ছেলে। ফসল ফলাতে গিয়ে একজন কৃষকের কী রকম শ্রম ও অর্থের প্রয়োজন হয় তা আমার জানা। এ দেশের কৃষকরা হরতাল করতে পারেন না, তারা দুর্বল কণ্ঠ নিয়ে তাদের ন্যায্যমূল্য ও ন্যায্য অধিকারের আন্দোলনও জানেন না। কৃষির ওপর নির্ভরশীল এ দেশে কৃষকের ভাগ্য নিয়ে এ খেলা আর কত দিন চলবে—এ প্রশ্ন নীতিনির্ধারকদের কাছেই রইল। 

ফসল উৎপাদনে বিশ্বের সেরা দশে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের বড় বড় আয়তনের দেশকে পেছনে ফেলে ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনের তালিকায় শীর্ষ দশে অবস্থান করে নিয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এ খবর দেশের জন্য যেমন সুখবর তেমনি এ ধারা অব্যাহত রাখতে কৃষককে ভর্তুকি এবং পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের ওপর জোর দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য কৃষক-গবেষক-সম্প্রসারণ কর্মী-ব্যবসায়ীদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন জরুরি।

করোনা মহামারীর রেশ কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এখন চলছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ। দেশে চলছে বিরোধী দলগুলোর অবরোধ। যা সারা বিশ্বের তথা দেশের খাদ্যশৃঙ্খলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তবে এমন অবস্থাতেও থেমে থাকেননি দেশের কৃষকরা। সবকিছু উপেক্ষা করেই ছুটে চলছেন ফসলের মাঠে। ফলাচ্ছেন সোনার ফসল। তাদের এ হাড়ভাঙা শ্রমের কারণেই আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্বের ৯৪তম দেশ হলেও এফএওর হিসাবে দেখা যায়, প্রাথমিক কৃষিপণ্য শুধু ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৪তম। শীর্ষে রয়েছে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। জনবহুল এ দেশে যত বেশি ফসল উৎপাদন হয়, তত আমাদের প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। এ পরিস্থিতিতে উৎপাদন আরো বাড়াতে হবে। এজন্য কৃষককে আরো বেশি সহায়তা দিতে হবে। তারা যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সেটার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।

দেশে কৃষি ও কৃষককে কেন্দ্র করে প্রতিটি বড় রাজনৈতিক দলের কৃষক সংগঠন রয়েছে। এ সংগঠন কৃষককে কেন্দ্র করে গঠন করা হলেও রাজনীতির মূলধারা থেকে প্রান্তে ঠেলে দেয়া হয় কৃষি ও কৃষকের স্বার্থকে। বরং দলীয় স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত থাকে এ সংগঠনগুলো। যদিও করোনাকালীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কৃষি ও সমবায় বিষয়ক উপকমিটি, কৃষক লীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সংগঠন কৃষককে ধান কাটায় সহযোগিতা করেছে, যা প্রশংসনীয়। আসলে আশির দশকে খেতমজুর আন্দোলনের পর কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। আজও কৃষক ন্যায্যমূল্য না পেয়ে জমিতে আগুন দিচ্ছেন। দুধ পানিতে ফেলে দিচ্ছেন। সবজি রাস্তায় ফেলে প্রতিবাদ করছেন। এভাবে অধিকারহীন কৃষকরা আজ অসংগঠিত, অসহায় ও ভাষাহীন।

কৃষিতে উন্নতি করতে হলে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কৃষকের অভিযোগ শুনে পরবর্তী সময়ে তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হলে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের সরাসরি বড় বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নির্দিষ্ট এলাকাভিত্তিক কৃষক সংগঠন তৈরি করে গ্রুপ মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে তা করা যেতে পারে। বর্তমানে কৃষি বিভাগ এনএটিপি-২ প্রকল্পের আওতায় কিছুটা করে যাচ্ছে। মাঠপর্যায়ে কৃষি বিভাগের কর্মীরা উৎপাদন বাড়ানোর পেছনে যে শ্রম ও সময় ব্যয় করেন, এর কিছুটা সময় যদি ফসল বিক্রিতে সহায়তা করতে পারতেন, তবে কৃষক কিছুটা লাভবান হতেন। এছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পের প্রশিক্ষণে স্থানীয় ব্যবসায়ীকে অন্তর্ভুক্ত করে আধুনিক বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর ধারণা দেয়া যেতে পারে। 

কৃষকের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করা, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের বৃহৎ বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, মিডিয়ায় বাজার তথ্য সম্প্রচার করা, পণ্য পরিবহনকালীন চাঁদা বন্ধ করা, প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণ পণ্য সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন, ইউনিয়ন পর্যায়ে বিপণন সেবা চালু করা, উপজেলা পর্যায়ে মিনি হিমাগার স্থাপন এবং জেলা পর্যায়ে কৃষক বাজার বা প্রক্রিয়াজাত কারখানা স্থাপন করা গেলে কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির সংকট দূর হবে বলে আশা করা যায়। এর জন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন হবে। আবার যেহেতু মৌসুমে জোগান বেশি থাকলে কৃষিপণ্যের দামও কমে যায়, কিন্তু অমৌসুমে উৎপাদিত পণ্যে কৃষক ভালো দাম পান। তাই কৃষককে অমৌসুমে ফসল উৎপাদনের ওপর বেশি জোর দিতে হবে।

সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান ও গম সংগ্রহ করে থাকে। এটি কৃষককে ন্যায্যমূল্য দেয়ার একটি প্রচেষ্টা মাত্র। ভারতের কেরালা রাজ্যে আনারস বিক্রির ওপর রাজ্য সরকার একটি নির্দিষ্ট দাম নির্ধারণ করে দেয়। ফলে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়কেই সন্তুষ্ট থাকতে দেখা যায়। সেখানে কেরালা পাইনঅ্যাপল সিটি নামে একটি বৃহৎ মার্কেট রয়েছে। এটি ‘কৃষক বাজার’ ধারণার আদলে গড়া। সব আনারসচাষী সরাসরি সেখানে এসে চুক্তিভিত্তিক আনারস বিক্রি করেন। সেখান থেকে পুরো ভারতসহ প্রতিবেশী রাষ্ট্রে সংগঠনের মাধ্যমে আনারস সরবরাহ করা হয়। সেখানে দ্য পাইনঅ্যাপল ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন কেরালা নামে একটি শক্তিশালী কৃষক সংগঠন রয়েছে, যার সদস্য সংখ্যা প্রায় এক হাজার। সংগঠনকে শক্তিশালীকরণের পেছনে রাজ্য সরকারের যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। শক্তিশালী কৃষক সংগঠনের মাধ্যমে ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণের এটি একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে।

মো. বশিরুল ইসলাম: উপপরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন