দেশের প্রথম আন্ডারপাস-নির্ভর রেলপথ দোহাজারী-কক্সবাজার

মোহাম্মদ সুবক্তগীন

চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজার পর্যন্ত প্রায় ১০১ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়াল গেজ রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পটির মাধ্যমে কক্সবাজারের সঙ্গে রেলপথে প্রথমবারের মতো সারা দেশকে সংযোগ করা হয়েছে। এ মহাযজ্ঞের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ সুবক্তগীন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুজিত সাহা

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথটি কেন দেশের অন্যান্য রেলপথের থেকে আলাদা?

প্রথমত, এ রেলপথ কোনো একটি নতুন জেলাকে (কক্সবাজার) সংযুক্ত করল। পর্যটন নগরীকে সংযুক্ত করার জন্য এটাই কোনো বড় একটি প্রকল্প। আমাদের দেশে যেখানে-সেখানে অবৈধ রেল ক্রসিং বানিয়ে যানবাহন কিংবা মানুষ পারাপার হয়। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও থাকে বেশি। পর্যাপ্ত গেটম্যান না থাকা এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার না করায় রেল দুর্ঘটনার সিংহভাগই রেল ক্রসিংকেন্দ্রিক। এ সংকট দূর করতে নবনির্মিত দোহাজারী-কক্সবাজার ১০০ কিলোমিটার রেলপথের একটি বড় অংশেই নির্মাণ করা হয়েছে আন্ডারপাস। অর্থাৎ সুড়ঙ্গপথ দিয়ে ট্রেন চলাচল করায় দুর্ঘটনা ঝুঁকি শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। তাছাড়া এসব ক্রসিংয়ে গেটকিপার নিয়োগের প্রয়োজন না থাকায় রেলের বিপুল পরিমাণ অর্থও সাশ্রয় হবে। এসব কারণেই রেলপথটি অন্যান্য পথ থেকে আলাদা।

রেলপথটি নির্মাণে কী কী চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়েছে?

সংরক্ষিত বনাঞ্চল দিয়ে এ রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে বনের বেশকিছু গাছ আমাদের কাটতে হয়েছে। এছাড়া হাতির চলাচলের পথ শনাক্ত করাসহ তাদের চলাচলের পথে লাগাতে হচ্ছে সাত লাখ গাছ। এরই মধ্যে পাঁচ লাখ গাছ আমরা লাগিয়েছি। অনেক গাছ এখন বড় হয়েছে। এছাড়া কয়েকদিন আগে লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, চকরিয়ায় সম্প্রতি বন্যার কারণে রেলপথের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, সেগুলো সংস্কারেও আমাদের কাজ করতে হয়েছে। কভিড-১৯-এর সময় রেলপথ নির্মাণকাজ নিয়ে নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাদের। তবে আমরা চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজের মাধ্যমে সফলতা দেখাতে পেরেছি।


সংরক্ষিত বনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে কীভাবে কাজ করা হয়েছে এবং হাতি চলাচলে কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে রেলওয়ে?

রেলপথটি দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিভিন্ন সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও পাহাড়ের মধ্য দিয়ে নির্মাণ করতে হয়েছে। প্রকল্পটির শুরুর দিক থেকেই পরিবেশের যাতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হয় বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করেছি। এছাড়া সংরক্ষিত এ বনাঞ্চল বা পাহাড়ে বন্যহাতিসহ অন্যান্য যে বন্যপ্রাণী আছে এরা যাতে অবাধে বনের একপাশ থেকে অন্যপাশে বিচরণ করতে পারে, সেজন্য আন্ডারপাস ও ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। আবার হাতি যে ধরনের খাবার খায়, তাদের চলাচল পথে সে ধরনের গাছ লাগানো হয়েছে; আমরা যেভাবে আন্ডারপাস বা ওভারপাস নির্মাণ করেছি হাতি যাতে সেদিকেই যাতায়াত করে। গহিন জঙ্গলে দীর্ঘদিন সিসিটিভি ক্যামেরা মনিটারিং করেই রেলপথ ও সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। আমাদের জানামতে, এশিয়ায় শুধু হাতির জন্য এমন আন্ডারপাস বা ওভারপাস আগে কোথাও নির্মাণ করা হয়নি।

কক্সবাজারে অত্যাধুনিক রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণের উদ্দেশ্য কী?

কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনকে বেশ আধুনিক ও সৃজনশীলভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। দেশের অন্যান্য রেলওয়ে স্টেশন কোথাও একতলা বা দোতলা, যেখানে কেবল অপারেশনাল কাজগুলো করা হয় বা কিছু টোলঘর কিংবা দোকান নির্মাণ করা হয়। কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনে অপারেশনাল কাজের পাশাপাশি লিফট, এস্কেলেটর, ফুডকোর্ট, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, শপিংমল, আবাসিক, যাত্রীদের জন্য লকারের ব্যবস্থা থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক কাজের জন্য আলাদাভাবে সাজানো হয়েছে ছয়তলা ভবনটি। এজন্যই সেটি দেশের আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন।

আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও বাণিজ্যে রেলপথটি কীভাবে ভূমিকা রাখবে বলে আপনি মনে করেন?

মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে দেশের পণ্য পরিবহনে এ রেলপথ বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। চকরিয়া থেকে বাইপাসের মাধ্যমে আরেকটি রেললাইন নির্মাণ করা হবে। দেশে বেশির ভাগ পণ্য পরিবহন মূলত সড়কপথে হলেও এ অঞ্চলের সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ রেলপথেই সবচেয়ে সহজ ও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। কেননা এ অঞ্চলের সড়কপথ এতটা যুগোপযোগীভাবে গড়ে তোলা হয়নি, যার কারণে ট্রেনে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে অঞ্চলটি হয়ে উঠবে ব্যবসায়িক হাব। এতে পণ্যবাহী ট্রেনের চাহিদাও দিন দিন বাড়বে। তাছাড়া রেলের ভাড়া কম এবং যাতায়াতের সময়সীমা সড়ক থেকে কম হওয়ায় যাত্রীরাও ট্রেনমুখী হবেন। শুরুর দিকে এ রুটে ট্রেন ৫০-৬০ কিলোমিটার গতিতে চললেও পরবর্তী সময়ে গতিসীমা আরো বাড়ানো হবে। তখন ২ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার যাতায়াত করা যাবে।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন