আলোকপাত

শুধু অবকাঠামো নয়, মানবসম্পদ উন্নয়নও জরুরি

ড. মো. সিরাজুল ইসলাম

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাম্প্রতিক সময়ে একটি অনুষ্ঠানে দেশের অর্থনীতি নিয়ে পর্যালোচনা করতে গিয়ে কিছু বক্তব্য প্রদান করেছেন, যা এখন ভাইরাল। তার একটি হচ্ছে মানবসম্পদ উন্নয়ন ব্যতীত সুদৃশ্য এ অবকাঠামোগুলো কঙ্কালসদৃশ। কথাটির গুরুত্ব প্রণিধানযোগ্য। দেশে এখন যে দু-চারজন দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ববান বুদ্ধিজীবী আছেন ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ তাদেরই একজন। সরকারকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য সৎ উদ্দেশ্যেই তিনি এ উপদেশ দিয়েছেন বলে আমার ধারণা। এটা অবশ্যই অনস্বীকার্য যে গত দেড় দশকে এ সরকারের আমলে দেশের অবকাঠামোগত যে উন্নয়ন হয়েছে তা স্বাধীনতা-পরবর্তী পর্যায়ে সবচেয়ে বড় অর্জন। এটি দেশের চিত্র বদলে দিচ্ছে। তবে এর ফলকে টেকসই করতে আরো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রয়োজন। 

নিঃসন্দেহে কঙ্কাল দেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি ছাড়া আপনি দাঁড়াতে পারবেন না। কিন্তু রক্ত-মাংস ছাড়া একটি কঙ্কাল মৃত মানুষেরই প্রতীক। তেমনি একটি দেশের উন্নয়নের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন অবশ্যই প্রয়োজনীয়। তবে জনগণের ট্যাক্সের টাকা কিংবা ঋণ—বহু কষ্ট করে এই যে অবকাঠামো, পরবর্তী সময়ে এর সঠিক ব্যবহারের জন্য সৎ ও দক্ষ জনশক্তি যদি তৈরি করা না হয় তাহলে তা বেহাল কিংবা মৃতপ্রায় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। সাম্প্রতিক সময়ে একটি টিভি প্রতিবেদন দেখছিলাম। গত এক দশকে রেলের অবকাঠামো উন্নয়নের পেছনে খরচ করা হয়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। কিন্তু সেবার মান বাড়েনি! সেই অপেশাদার আচরণে অভ্যস্ত টিটি, ড্রাইভার, অলস স্টেশনমাস্টার, সিগনালম্যান, অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারী। বেড়েছে দুর্ঘটনা। অনেকগুলো দৃষ্টিনন্দন সুদৃশ্য রেল স্টেশন করা হয়েছে। তেমনি একটি নতুন রেল স্টেশনে একবার ঢুকে দ্বিধায় পড়লাম, এটা কি রেল স্টেশন নাকি ময়লার ভাগাড়? রেলের এ করুণ চিত্রের সাক্ষী হয়ে টিভিতে হররোজ প্রচারিত হচ্ছে ‘রুচি’ ডালের একটি বিজ্ঞাপন—ট্রেন আসতে আরো সাড়ে ৪ ঘণ্টা দেরি! 

সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত, নগর যোগাযোগে নতুন দিগন্ত, মেট্রোরেল নিয়েও তাই ভাবনা হচ্ছে। অথচ উন্নত দেশে, যেমন জাপানে রেল চলে সেকেন্ডের কাঁটা মেপে। খোদ জাপানিরা, আধুনিকতম জাপানি প্রযুক্তিতে বানিয়ে দিয়ে গেছে এ মেট্রোরেল। একই স্থাপনা, একই প্রযুক্তি—তবে পার্থক্যটা কোথায়? এর কারণ ‘‌মানুষ’-এর যোগ্যতার হেরফের—তার জ্ঞান, শিক্ষা, সময়ানুবর্তিতা ও কর্মদক্ষতার বিস্তর পার্থক্য! নিপ্পন-কোয়েই বানিয়েছে এ মেট্রোরেল। কোম্পানিটির বাংলাদেশ শাখার প্রায় সর্বোচ্চ পদে আছেন একজন বাংলাদেশী প্রকৌশলী। দেখা হলেই বলেন, ‘মেট্রোরেলে উঠেছেন? তাড়াতাড়ি একবার চড়েন, দেখেন কী জিনিস বানিয়ে দিয়ে গেছি।’ পাঁচ বছর পর এটা চলবে কিনা সন্দেহ তার, তাই তাড়াতাড়ি দেখে নেয়ার পরামর্শ।

শুধু রেলওয়ে কেন, বাংলাদেশের প্রায় সবক’টি সরকারি সেবাদানকারী সংস্থা নিয়েই জনগণের মনে ধারণা মোটামুটি একই রকম—বিমান, বিআরটিসি, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, গ্যাস কিংবা পানি। এটা ঠিক যে মোটের ওপর তারা জনগণকে কিছুটা সার্ভিস যে দিচ্ছেন না তা নয়, কিন্তু আশানুরূপ নয়। গ্রাহকদের প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হয়—দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার অভিযোগ হরহামেশাই। দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো পাওয়ার পর তাদের স্বভাবের পরিবর্তন হবে বলে কেউ বিশ্বাস করে না। বিমানবন্দর নিয়েও একই শঙ্কা। বিশ্বের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন আরেকটি স্থাপনা। বানিয়ে দিয়ে গেছে আবারো সেই নিপ্পন-কোয়েই। কিন্তু যদি সেই লাগেজ-কাটা পার্টি, অলস গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার, দুর্নীতিবাজ কাস্টমস আর ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা—তাহলে জনগণ কি সেই সেবা পাবে? 

এরপর বড় প্রশ্ন হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়নে যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে, শিক্ষা তথা মানবসম্পদ উন্নয়নে সে প্রচেষ্টা বা সমগুরুত্ব দিয়ে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে কিনা? যেহেতু আমি দেশের একজন করদাতা, সরকারের ব্যয়িত অর্থের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন করতেই পারি। কেননা আমাদের মতো করদাতাদের অর্থেই এগুলো হচ্ছে। সরকারের টাকা বলে কিছু নেই। 

একটি দেশের জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ কী? তেলের খনি, সোনার খনি কিংবা হীরা নিঃসন্দেহে মূল্যবান। কিন্তু সবচেয়ে বড় সম্পদ জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ একটি দক্ষ জনশক্তি। উন্নত বিশ্বের তালিকায় যে দেশগুলো অন্তর্ভুক্ত তাদের সবাই যে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, তেমনটি কিন্তু না। উন্নত বিশ্বের দুটি দেশ সিঙ্গাপুর ও জাপানে পড়াশোনার স্বার্থে লম্বা সময় অবস্থানের সুযোগ আমার হয়েছিল। তাদের কারোরই কোনো উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। কোনো প্রকার প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়াই, জাপানের পক্ষে বিশ্বের সর্ববৃহৎ একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার পেছনে অন্যতম চালিকাশক্তি হচ্ছে এর দক্ষ জনশক্তি আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে চরম উৎকর্ষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া দেশটি কঠোর পরিশ্রম, সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার আর সর্বোচ্চ কারিগরি দক্ষতার বদৌলতে আজ উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হতে পেরেছে।

একইভাবে বাংলাদেশের প্রায় সমান সময়ে, অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে স্বাধীন হয়েও সিঙ্গাপুর এরই মধ্যে বিশ্বের একটি অন্যতম ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ১৯৬৫ সালে দেশটি যখন মালয়েশিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে তখন এটি বড়জোর একটি জেলেপল্লীর মতোই ছিল। তার আজকের এ অবস্থানে আসার পেছনে যে প্রচেষ্টাগুলো কাজ করেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শিক্ষার বিস্তার এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে চরম উৎকর্ষ সাধন। সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী ড. লি কিউআন তার প্রায় তিরিশ বছরের শাসনামলে যে বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন তা হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদহীন সিঙ্গাপুরের প্রতিটি নাগরিককে সম্পদে পরিণত করা। প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব পর্যায়ের সর্বোচ্চ মানের শিক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে তিনি এটি সম্ভব করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ষাটের দশকেও প্রায় অজ্ঞাত একটি বিশ্ববিদ্যালয় ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের পেছনে তিনি প্রায় বিলিয়ন ডলার খরচের মাধ্যমে নব্বইয়ের দশকের মধ্যেই এটিকে একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বর্তমানে পৃথিবীর প্রথম ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এটি একটি। আর এ দক্ষ জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে শ্রমনির্ভর স্বল্প আয়ের শিল্পের পরিবর্তে মেধানির্ভর অধিক আয়ের শিল্প বিস্তারের মাধ্যমে তিনি দ্রুততর গতিতে অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। 

জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি আসলে ঠিক এ মুহূর্তের একটি বহুল আলোচিত বিষয়। আভিধানিক অর্থে ‘‌জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি’ বা কে-ইকোনমির (নলেজ ইকোনমি) সংজ্ঞা মোটামুটি এ রকম: যে অর্থনীতিতে কায়িক বা শারীরিক পরিশ্রমের চেয়ে মেধা বা জ্ঞানের ব্যবহার বেশি হয়ে থাকে। অর্থাৎ কৃষি ও শ্রমিকনির্ভর অর্থনীতি বা পি-ইকোনমির (প্রোডাকশন ইকোনমি) ঠিক উল্টোটা। যেমন একজন প্রকৌশলী যখন বিমান বা কম্পিউটার বানাচ্ছেন, উঁচু দালান কিংবা সেতুর নকশা করছেন কিংবা সফটওয়্যার তৈরি করছেন। জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি সম্ভব। যেমন আপনি যে বিমানটি ১০০০ কোটি টাকায় কিনেছেন, বস্তুত এর যে কাঁচামাল যথা লোহা, তামা, অ্যালুমিনিয়াম এ সবকিছুর বাজারমূল্য হয়তো ১০০ কোটি টাকার মতো। আর তাহলে মেধার মূল্য বাকি ৯০০ কোটি টাকা! অন্যদিকে, গার্মেন্টস শিল্পে ১০০ কোটি টাকার কাঁচামাল, যেমন সুতা থেকে কাপড় এবং টি-শার্ট তৈরি করে আপনি বড়জোর ২০০ কোটি টাকা আয় করতে পারেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আপনার কাজের দ্বারা পণ্যটিতে ভ্যালু অ্যাডিশনের পরিমাণের ক্ষেত্রে এ দুটি শিল্পের বিস্তর ফারাক! 

কিন্তু আফসোসের বিষয় যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একমাত্র সম্বল, এই কম মেধানির্ভর তথা শ্রমনির্ভর গার্মেন্টস শিল্পের ঊর্ধ্বতন পদগুলোও দখল করে আছে বিদেশীরা—শ্রীলংকান, ভারতীয়, চায়নিজ কিংবা কোরিয়ান। আইটি সেক্টরে তো কথাই নেই, ভারতীয়দের দাপট। খবরে দেখেছিলাম প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের অর্থ প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে বাইরে চলে যায় এভাবে বিদেশীদের বেতন বাবদ। ৪০ বছরের গার্মেন্টস শিল্পের ইতিহাস বাংলাদেশের। এতদিনেও আমরা এ শিল্পে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে ব্যর্থ। শুধুই শ্রমিকের কাজ করছি। একটি মাত্র টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় আছে বুটেক্স। সেটিকে আধুনিকায়নের কোনো উদ্যোগ সরকার কখনো নিয়েছে কিনা। এ খাতে গবেষণার জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে কিনা কখনো? বরং বাস্তবে যা দেখেছি, তা হচ্ছে বুটেক্স থেকে পাস করে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ক্ষমতা আর অর্থবিত্তে সরকারি প্রশাসন অনেক আকর্ষণীয়। 

ঊনবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ মানবসম্পদই হবে একটি দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। শুধু অর্থবিত্ত আর বড় অবকাঠামো থাকলেই বিশ্বে নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব নয়, যদি না জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে উৎকর্ষ সাধন সম্ভব হয়। অবকাঠামোর ভিত্তি স্থাপনের পর তাই সরকারের উচিত মানবসম্পদ উন্নয়নে মনোযোগী হওয়া।

ড. মো. সিরাজুল ইসলাম: অধ্যাপক, সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও পরিচালক, সেন্টার ফর ইনফ্রাস্ট্রাকচার রিসার্চ অ্যান্ড সার্ভিসেস (সিআইআরএস), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন