বিশ্ব পর্যটন দিবস

টেকসই ও সবুজ পর্যটন উন্নয়নে বিনিয়োগ

ড. সন্তোষ কুমার দেব

জীবন-জীবিকার অন্বেষণে ক্লান্ত-অবসন্ন মানুষগুলোর কাজের সৃজনশীলতা বৃদ্ধির জন্য অবসর ও খানিকটা বিশ্রাম প্রয়োজন হয়। এ অবসর সময়ে বিনোদন উপভোগ করার জন্য তারা ছুটে যায় প্রকৃতির কোলে। প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধের সান্নিধ্যে এসে জুড়ায় তাপিত জীবনের সব ক্লান্তি। তখনই পর্যটক মন খুঁজে বেড়ায় প্রশান্তির বিভিন্ন পর্যটন গন্তব্য।

ভ্রমণপিপাসু মানুষ পৃথিবীর অজানাকে জানতে, নান্দনিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে এবং সর্বদা নতুন কিছু দেখতে ও আবিষ্কার করতে অনুসন্ধিৎসু মনের সহজাত তাড়নায় ঘুরে বেড়ায় পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মহাবিশ্বের সৌন্দর্য-রোমাঞ্চিত মুক্তাঙ্গনে। জীবন-জীবিকার অন্বেষণে ক্লান্ত-অবসন্ন মানুষের অবসর ও খানিকটা বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। এ অবসর সময়ে বিনোদন উপভোগ করার জন্য তারা ছুটে যায় প্রকৃতির কোলে। প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধের সান্নিধ্যে এসে জুড়ায় তাপিত জীবনের সব ক্লান্তি। তখনই পর্যটক মন খুঁজে পায় প্রশান্তির দ্বার। বিচিত্র এ পৃথিবী ও লীলাবতী প্রকৃতি অপার সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে প্রতিনিয়ত মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।

পর্যটন শিল্পের অমিত সম্ভাবনার সমৃদ্ধ দেশ বাংলাদেশ। সুজলা-সুফলা, শস্য শ্যামলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি বাংলাদেশ। দিগন্তজোড়া সবুজের সমারোহ, শ্যামল-শোভন বন, উঁচু-নিচু পাহাড়, চা বাগান, সমুদ্রসৈকত, দেশজোড়া রুপালি নদীর বিস্তার, বিভিন্ন ঋতুতে রঙ আর অপরূপ রূপের বর্ণিল শোভা সৌন্দর্য মহিমায় পৃথিবীর অনন্য।

পর্যটক আকর্ষণের অন্যতম প্রধান উপাদান হচ্ছে প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও পৌরাণিক নিদর্শনগুলো। পর্যটন উন্নয়নের জন্য যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন, আবাসন সুবিধা, স্থানীয় প্রসিদ্ধ খাবারের সুব্যবস্থা, পর্যটন নিরাপত্তা ও চিত্তবিনোদনের সব শ্রেণীর উপকরণ পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেই সঙ্গে ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান কিংবা তীর্থস্থানে দর্শনার্থীর গমনাগমন কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্পের বিকাশ হচ্ছে।

এ বছর ২০২৩ সালে বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘পর্যটন ও পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ’। পরিবেশবান্ধব পর্যটনের জন্য যেসব আবাসন তৈরি করা হচ্ছে সেগুলোকে জ্বালানি দক্ষ করে গড়ে তোলা, সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করা, পানি ব্যবস্থাপনা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা, প্রকৃতিকে নির্ভর করে পর্যটন আকর্ষণ তৈরি করা। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার ক্ষেত্রে পর্যটন খাতের বিনিয়োগের ভূমিকা অনন্য। পরিবেশবান্ধব পর্যটন উন্নয়নে বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে সমন্বিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও একটি সমাজকে টেকসই উন্নয়নের দিকে ধাবিত করে।

সবুজ পর্যটনে মূলত প্রকৃতির প্রতি সম্মান ও পরিবেশ রক্ষা করে পর্যটন উন্নয়নকে প্রাধান্য দেয়া হয়। সবুজ পর্যটনের পূর্বশর্ত অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক সম্প্রীতি, পরিবেশগত মান রক্ষা ও সংরক্ষণের প্রতিফলন হিসেবে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য ধ্বংস না করা এবং প্রকৃতি রক্ষা স্বীকৃত। এক্ষেত্রে পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে পর্যটনসংশ্লিষ্ট সবাইকে একত্রে কাজ করা দরকার। 

অপরূপ সৌন্দর্যের পর্যটন আকর্ষণ সাগরকন্যা কুয়াকাটা। একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যাওয়ায় পর্যটকদের কাছে এ পর্যটন কেন্দ্র অধিক প্রিয়। এছাড়া সমুদ্রের অসীম জলরাশি, সমুদ্রবক্ষে জেলেদের মাছ ধরার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, সমুদ্রপাড় ঘেঁষা বন-বনানী, কুয়াকাটাকে পর্যটক-দর্শনার্থীর কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতু চালুর পর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত ঘিরে হোটেল, মোটেল ও রেস্তোরাঁসহ নানাবিধ অবকাঠামো উন্নয়নের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। সাগরকন্যাকে কেন্দ্র করে পর্যটনকেন্দ্রিক বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা।

বিশ্ব পর্যটন সংস্থার সূত্র অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্পের অবদান ৮.৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং জিডিপিতে অবদান ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। এ খাতে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মানুষ কর্মরত। এখন সমগ্র বিশ্বে ১৫০ কোটি পর্যটক অর্থাৎ প্রতি সাতজনে একজন পর্যটক। কভিড-১৯ মহামারীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ পর্যটন শিল্প। পর্যটন শিল্পে প্রায় ১২০ মিলিয়ন মানুষ চাকরি হারিয়েছে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে ৪ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপিতে অবদান হ্রাস পেয়েছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে পর্যটন খাতের জিডিপিতে অবদান ছিল ৪ দশমিক ৪ শতাংশ কিন্তু কভিড-১৯ মহামারীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ খাত। করোনা মহামারীর প্রভাব হ্রাস পাওয়ার পর থেকে পর্যটন শিল্প ধীরে ধীরে পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি, মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান তৈরি ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য ১৯৭২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন গঠিত হয়। সমুদ্রের অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধির জন্য ১৯৭৪ সালে সমুদ্রসীমা আইন প্রণয়ন হয়, যার মূল লক্ষ্য টেকসই ও সবুজ পর্যটন বিনির্মাণ। ২০১০ সালে পর্যটন প্রমোশনের জন্য বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড গঠিত হয় এবং পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশ প্রতিষ্ঠিত হয়।

করোনা-পরবর্তী অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য অন্যতম মজবুত অর্থনীতির দেশ অস্ট্রেলিয়া পর্যটন প্রসারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। সেই সঙ্গে বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধিকল্পে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের অন্যতম মাধ্যম ইনস্টাগ্রামে ‘আই লাভ অস্ট্রেলিয়া’ পেজের স্পনসরের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণ এবং ফরেন ডিরেক্ট ইনভেসস্টমেন্টে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। পৃথিবীর অন্যতম স্মার্ট পর্যটন নগরী হেলসিংকি (ফিনল্যান্ড) ইউরোপিয়ান পর্যটকদের পাশাপাশি নর্থ আমেরিকান পর্যটকদের আকর্ষণে স্মার্ট ট্যুরিজমের অন্যতম উপাদান ইন্টারনেট অব থিঙ্কস; আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-নির্ভর রোবট সার্ভিস চালু করেছে। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্ট আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বেজড রোবট দিয়ে এয়ারপোর্ট ক্লিনিং ও এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি সিস্টেম অনেক উন্নত এবং স্মার্ট সেবা প্রদান করছে, যা টেকসই পর্যটন উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। 

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে পরিবেশবান্ধব পর্যটন বাস্তবায়নে পেপারলেস সোসাইটি বিনির্মাণে অন্যতম অনুষঙ্গ স্মার্ট ট্যুরিজম। স্মার্ট ট্যুরিজম ও স্মার্ট সিটি উন্নয়নে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা অনেক বেশি মনোযোগী। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে ট্যুরিজম ব্যবসায় ও প্রতিষ্ঠানে অটোমশন, যন্ত্রনির্ভরতা অনেক বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অব থিংস, ক্লাউড কম্পিউটিং, বিগ ডাটা, রোবোটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ও ওয়্যারলেস টেকনোলজি ব্যবহার বৃদ্ধির প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করতে হবে। পর্যটনের নতুন ধারণা পিপিসিপির (পাবলিক-প্রাইভেট কমিউনিটি পার্টনারশিপ) ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। 

বর্তমানে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের উপাদানগুলোর মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, ওয়েবসাইট, বিগ ডেটা ও কনটেন্ট মার্কেটিংয়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে বিধায় পর্যটন ব্র্যান্ডিং ও প্রমোশনের ক্ষেত্রে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নর্থ আমেরিকা ও এশিয়া মহাদেশের দেশগুলো সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের (ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব) ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করছে, অতএব উন্নত বিশ্বের মতো পর্যটন প্রমোশনে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের ওপর দেশে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। ট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান দ্রুততার সঙ্গে সম্পূর্ণ করে পর্যটনসংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের কাছে আগামী ২০৪০ সাল নাগাদ পর্যটনের অভীষ্ট লক্ষ্য সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।

ড. সন্তোষ কুমার দেব: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান 

ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন