অভিমত

কর্তাদের গাফিলতিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে টাকা ফেরত যাচ্ছে

মাছুম বিল্লাহ

এটি অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়েছে যে কোনো প্রকল্পে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় প্রায় প্রতি বছরই প্রকল্পের এসব অর্থ মন্ত্রণালয়ে ফেরত চলে যায় আর জন্ম দিয়ে যায় অনেক প্রশ্নের। সম্প্রতি শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এ বছরও যেসব প্রজেক্টে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল অনেক প্রজেক্টেই সেই অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করতে পারেনি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ঘটনাটি শিক্ষা খাতেই ঘটেছে। শিক্ষা খাত অন্যান্য খাতের চেয়ে এমনিতেই পিছিয়ে আছে। তার মধ্যে প্রকল্পের অর্থ ব্যয় করতে না পারা আরো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দেশের শিক্ষা খাতে কি তাহলে উপযুক্ত লোকবল নেই? যদি না থেকে থাকে তাহলে কী করা?

শিক্ষার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ‘অদক্ষতা’ এবং ‘গাফিলতি’ই মূলত উল্লিখিত কারণের জন্য দায়ী। তার সঙ্গে রয়েছে প্রকল্প দলিলসংক্রান্ত জটিলতা। এটিও একটি বড় কারণ। এ জটিলতা বোধ হয় আমরা ইচ্ছামতোই তৈরি করি, এর পেছনে কার কী লাভ সেটিও বোধ হয় দেখা প্রয়োজন। দেখা যায়, শিক্ষার সাতটি প্রকল্পে প্রায় সাড়ে পাঁচশ কোটি টাকা অব্যয়িত থেকে গেছে সম্প্রতি শেষ হওয়া অর্থবছরে। এভাবে শিক্ষা বিভাগের ৭৩টি প্রকল্পের ১৩শ কোটি টাকা ব্যয় হয়নি। এ কেমন প্রশাসন আমাদের শিক্ষা বিভাগে? কারণ হিসেবে জানা যায় যে ৭৩টি প্রকল্পের মধ্যে অন্তত ২৩টিতে ‘পূর্ণকালীন’ প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও সংস্থাপ্রধানরা পিডির দায়িত্ব ধরে রেখেছেন। এ কারণে অধীনস্থ কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। ফলে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে। আমাদের ভিসিরা আর কী চান? তারা রাজনীতি করেন, রাজনৈতিক বক্তৃতা দেন, রাজনীতির মাঠে থাকেন, আবার ভিসি পদ ছেড়ে রাজনৈতিক পদও ধরতে চান। তার ওপর এবার দেখা গেল, তারা প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ না দিয়ে নিজেরাই প্রকল্প পরিচালক হয়েছেন। তারা আর কত ধরনের সুনাম অর্জন করবেন?

জানা যায়, আগস্টের শেষ সপ্তাহে সব প্রকল্পের এক বছরের আর্থিক বিবরণী, বার্ষিক প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান এবং বরাদ্দকৃত টাকা অব্যয়িত থাকার কারণ জানতে চান মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিব। শিক্ষামন্ত্রী যথাসময়ে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করতে না পারায় সভায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন, করারই কথা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে, বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাস্তবায়ন হওয়া প্রকল্পের তথ্য নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে না। ইউজিসি বারবার চিঠি দিয়েও তথ্য পাচ্ছে না। আবার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের পিডির কর্তৃত্ব ধরে রাখার কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে বলে সভায় অভিযোগ করা হয়। এ বিষয়ে ইউজিসি সচিবের বক্তব্য হলো, ৫০ কোটি টাকার বেশি হলে ওই প্রকল্পের জন্য পূর্ণকালীন পিডি থাকতে হয়। কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পের জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার দু-একটি ক্ষেত্রে উপাচার্যরাও আলাদা পিডি নিয়োগ না দিয়ে নিজেরাই প্রকল্প চালাতে থাকেন। এ কারণে প্রকল্পগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পিডি নিয়োগের জন্য ন্যূনতম তিনজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ বা কর্মকর্তার একটি প্যানেল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হয়। এই প্যানেল থেকে একজনকে পিডি নিয়োগ দেয় শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি। এটিও ঠিকমতো করা হয়নি।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামো নির্মাণকাজ ২০১৮ সালে নির্ধারিত ‘‌রেট’ বা বাজারদর অনুযায়ী হচ্ছে জানিয়ে ইউজিসি সচিব জানান, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল—এ সময়ে প্রায় সব ধরনের নির্মাণসামগ্রীর দাম ২০-২৫ শতাংশ বেড়েছে। এ কারণে অনেক ঠিকাদার কাজ নিয়েও তা সারেন্ডার করছেন। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কিছু করার থাকছে না। এটি একটি যৌক্তিক কারণ, কিন্তু উপাচার্য কাম পিডিদের সেখানে কিছু করার থাকবে না, তারা কোনো পদক্ষেপ নেবেন না? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাস্তবায়ন হওয়া কলেজ এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে বিদায়ী অর্থবছরে ২৬০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। এর মধ্যে ১৩০ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয় হয়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ প্রকল্পে ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) ১৩২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। এর মধ্যে ১২৮ কোটি ২১ লাখ টাকাই অব্যয়িত রয়েছে। এস্টাবলিশমেন্ট অব ইন্টিগ্রেটেড এডুকেশনাল ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (আইইআইএমএস) প্রকল্পে বিদায়ী অর্থবছরে আরডিপিতে ২০৫ কোটি ২৮ লাখ টাকার বরাদ্দ ছিল। এর মধ্যে ১২৩ কোটি ৯৫ টাকাই ব্যয় হয়নি। ঢাকার কেরানীগঞ্জে ১৮৮ একর জমিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। ২০১৮ সালে ৩ অক্টোবর সেখানে জমির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। একই বছরে ৯ অক্টোবর নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নের জন্য প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। ২০২০ সালের অক্টোবরে এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার কথা ছিল। করোনা মহামারীসহ নানা কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায়। সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ২০২৩ সালে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ’ শীর্ষক স্থাপনা আইন পাস হয়। তখন থেকে অস্থায়ীভাবে চলছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। চট্টগ্রামে স্থাপন হওয়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫টি বিভাগে প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিক্ষার্থীর একাডেমিক সুবিধাসহ দেড় হাজার শিক্ষার্থীর আবাসিক সুবিধা দেয়া সম্ভব হবে। এ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৯৬৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। চট্টগ্রামের চর রাঙ্গামাটিয়ার হামিদচর এলাকায় প্রায় ১০০ একর জমিতে ‘গ্রিন ফিল্ড প্রজেক্ট’ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন হচ্ছে। প্রকল্পের বাস্তবায়ন ২০২১ সালের মধ্যে প্রথম পর্যায় এবং ২০২৫ সালের মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায় শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে, এ গতিতে সবকিছু চলতে থাকলে কখন সেটি শেষ হবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

মোট প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৫০ কোটি টাকা বা তার অধিক অর্থ ব্যয় না করা প্রকল্প ছয়টি। এর মধ্যে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন, ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন’ প্রকল্পে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরএডিপিতে বরাদ্দ ছিল ২৫০ কোটি টাকা । এর মধ্যে অব্যয়িত রয়েছে ১৫৯ কোটি টাকা। শিক্ষামন্ত্রীর সই করা মন্ত্রণালয়ের এক সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, ২০২২ সালের জুলাই থেকে গত জুন পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের আরএডিপি বরাদ্দের ৭১ দশমিক ৪০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। এ সময় আরএডিপি বাস্তবায়নের জাতীয় অগ্রগতি ছিল ৮৪ দশমিক ১৬ শতাংশ, যা জুন ২০২৩ পর্যন্ত জাতীয় অগ্রগতির চেয়ে অনেকটাই কম।

২৩টি প্রকল্পে পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক না থাকা এবং বড় বড় প্রকল্পে পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক না থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন আশানুরূপ হচ্ছে না। রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের পিডি উপাচার্য নিজেই। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরে ধীরে অগ্রগতির জন্য পিডিরা অর্থ ব্যয়ে তার ওপর অর্পিত আর্থিক ক্ষমতা প্রয়োগ না করা, করতে না পারাও অন্যতম কারণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী, প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য উপাচার্য কর্তৃক একাধিক কমিটি গঠন করা হয়। এসব কমিটিতে পিডিরা সভাপতি হিসেবে থাকলেও উপাচার্যের অনুমোদন ব্যতিরেকে প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ের কোনো ক্ষমতা পিডিদের থাকে না। প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ে এ ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। উপাচার্যের অনুমোদন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু ভিসিরা সেগুলোয় কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন তা এখন সামনে চলে এসেছে। আর একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে—ব্যয়ের সক্ষমতা বিচার না করে অর্থ বরাদ্দ দেয়া। তাছাড়া মাঠপর্যায়ের প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা না করেই প্রকল্প প্রণয়ন/সংশোধন করায় প্রকল্প/সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদনে বিলম্ব হয়ে থাকে। আবার প্রকল্পের ক্ষেত্রে অর্থছাড়ে বিলম্ব এবং বাস্তবায়নকাজ সময়মতো করা সম্ভব হয় না। জানা গেছে, শিক্ষার মোট প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৩৩টির মেয়াদ গত জুনে উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হয়নি। এ কারণে ৩৩টি প্রকল্পের মধ্যে ১২টির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। আরো ১৯টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। মেয়াদ বৃদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত এসব প্রকল্পের বিপরীতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দকৃত অর্থছাড় না করার নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এখানে আরো দু-একটি বিষয় লক্ষণীয়, প্রকল্পের অর্থ ফেরত যাওয়ার ঘটনা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেই ঘটেছে। প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিকে ঘটেনি। উচ্চশিক্ষায় দেশের সবচেয়ে উচ্চশিক্ষিতরাই এসব বিষয় ডিল করেন, তাদের সক্ষমতা আমাদের আবারো অবাক করল। এখানে শুধু সক্ষমতা নয়, কাজের প্রতি কমিটমেন্ট, আন্তরিকতা এবং জবাবদিহিতা—এর কোনো কিছুই এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেই যেন সব ঘটনা ঘটে চলছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক কর্মকর্তারা তাহলে কোন উদাহরণ অনুসরণ করবেন? আর একটি বিষয়, পিডি হওয়ার মতো উপযুক্ত লোক পাওয়া যাচ্ছে না—বিষয়টি কি সত্যিই তাই, নাকি উপাচার্যরা নিজেদের দখলেই রাখতে চেয়েছেন সবকিছু, নাকি রাজনৈতিক কোনো বিষয় এখানে জড়িত আছে—সেটিও দেখতে হবে। আমরা জানি যে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেই আমাদের সবাইকে কাজ করতে হয়। সেখানে কাজে বিলম্ব হওয়া এবং অর্থ ফেরত যাওয়ার বিষয় কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু এত বড় আকারে সেটি হবে এবং সেটির বড় কারণ হিসেবে পিডি না থাকার বিষয়টিও সামনে এসেছে। প্রকল্প গ্রহণের সময় সংশ্লিষ্টদের এসব বিষয়ে আরো বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। 

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন