জি২০ সম্মেলন

গণতন্ত্র শক্তিশালী না হলে গ্লোবাল সাউথ কখনই দাঁড়াতে পারবে না

মুহা. রুহুল আমীন

ইন্দোনেশিয়ার বালিতে গত বছর জি২০ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর এক বছর বাদে ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হলো এবারের সম্মেলন। এ দুটো ভেন্যুতে সম্মেলন আয়োজনের গুণগত পার্থক্য লক্ষণীয়। এমন একটি সময়ে নয়াদিল্লিতে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যখন সারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা ও ঝুঁকি, নিরাপত্তাগত হুমকি, পরাশক্তিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, দক্ষিণ এশিয়াকে ঘিরে পরাশক্তিদের তৎপরতা চলছে। এমন সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর অর্থনৈতিক ফোরাম জি২০ সম্মেলন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।

নয়াদিল্লিতে এ সম্মেলনের আগেই ভারতের নীতিনির্ধারকরা যেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তাতে তারা চেয়েছেন গ্লোবাল সাউথ বা দক্ষিণ গোলার্ধের একটা নেতৃত্বের জায়গায় চলে যেতে। আমরা জানি, ভারত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে (ন্যাম) নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে ছিল। সেই পঞ্চাশের দশক থেকে অদ্যাবধি ন্যামকে তারা নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। এখন ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদের প্রত্যাশী। যখন ভারত খুব জোরালোভাবে এ দাবি উচ্চারণ করছে, সে সময়ে ভারতের তৃতীয় বিশ্ব বা গ্লোবাল সাউথের সমর্থন প্রয়োজন। নয়াদিল্লিতে জি২০ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গ্লোবাল সাউথের বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তাগত ও পরিবেশগত নানা সুবিধার লক্ষ্য ও অধিকার রক্ষায় ভারত যদি ভূমিকা রাখতে পারে, তাহলে এটি ভারতকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদের অন্তর্ভুক্তকরণসহ দক্ষিণ এশিয়াসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভারতের নেতৃত্ব খুব শক্তিশালী পর্যায়ে চলে যাবে। সম্মেলন উপলক্ষে ভারতের প্রস্তুতি দেখে সেটিই মনে হয়েছে। 

দ্বিতীয় যে কারণে সম্মেলনটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ভারত দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তি। পরাশক্তি হিসেবে ভারতের মর্যাদা হলো ঐতিহাসিকভাবে ভারতের একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি আছে। আমরা যখন ভারতের কথা বলি, পাক-ভারত উপমহাদেশের কথা বলি, তখন ভারতের কথাই চলে আসে। ভারতের ঐতিহ্যের ইতিহাস আছে, সে ইতিহাসকে ভারত উপস্থাপন করছে। ইতিহাস, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ যত কিছুই বলা হোক না কেন আমি মনে করি, এক্ষেত্রে ধর্ম হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী নিয়ামক। এ অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত হয়েছে। জি২০ উপলক্ষে নয়াদিল্লির মণ্ডপ নতুন করে সাজানো হয়। সেখানে বিশ্বনেতারা আপ্যায়িত হন এবং সেখানেই অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ভারত তার ঐতিহ্যগত আদর্শ এতে বিশ্বের কাছে পরিচিত করতে চেয়েছে, শুধু তাই নয়; এটি বাহ্যিক কারণ, নেপথ্য কারণ হচ্ছে ভারত চেয়েছে তাদের সংস্কৃতির আন্তর্জাতিকীকরণ। যাতে সারা বিশ্বে ভারতের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্ভ্রম চলে আসে। যা বিশ্বনেতৃত্বের আসনে ভারতের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করবে। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলি, যুক্তরাষ্ট্রের যে স্বাধীনতা, সাম্য, মর্যাদা, বহুত্ববাদ এটির প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান আছে বলেই সুপারপাওয়ার হিসেবে দেশটির বিশ্বব্যাপী গ্লোবাল ক্রেডিবিলিটি বা বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা। ভারত এভাবে নিজ সংস্কৃতিকে ধারণ করে বৈশ্বিক নেতৃত্বের জায়গায় পৌঁছার জন্য বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেতে চাইছে। সেজন্যই মণ্ডপটাকে বেছে নেয়া হয়। 

জি২০ সম্মেলনে মূল প্রতিপাদ্য ছিল ওয়ান আর্থ, ওয়ান ফ্যামিলি, ওয়ান ফিউচার (এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ)। এই যে পৃথিবী যাকে পরিবার বলা হচ্ছে, এতদিন আমরা জানতাম গ্লোবাল ভিলেজ, গ্রামের সঙ্গে তুলনা করা হতো। কিন্তু এবারের জি২০ সম্মেলনে পরিবারের কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ খুব কাছাকাছি, পৃথিবীর দেশ, জাতি, মানুষগুলো যেন একই পরিবারের সদস্য। আমরা এতই ধ্বংসের ‍মুখে যাচ্ছি, আমাদের এটা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের আত্মিক বন্ধন শক্তিশালী করতে হবে। এজন্য মূল প্রতিপাদ্য হলো পরিবেশকে শান্ত রাখা। পরিবেশ যদি ঠিক না করা যায়, তাহলে আমরা আপন হতে পারব না। কাজেই সেটিকে ফোকাস দেয়ার লক্ষ্যে, আমার মনে হয় এটি দার্শনিক ব্যাখ্যা। যে কারণে পাশে নদী আছে এমন নৈসর্গিক জায়গায় সম্মেলন আয়োজন করেছে ভারত। তৃতীয়ত ইংরেজরা চলে যাওয়ার আগে ভারতের মোগল সাম্রাজ্যের নিদর্শন হিসেবে যে লালকেল্লা রয়েছে, সেটিও সম্মেলনস্থলের কাছাকাছি ছিল। ইতিহাসের এ ঐতিহ্যকে ভারত তুলে ধরতে চেয়েছে। 

এখন সম্মেলনের অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিকে আলোকপাত করা যাক। এক্ষেত্রে সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয়টি ব্যাখ্যা করা দরকার। আমরা জানি, পৃথিবীর ৮৫ শতাংশ অর্থনীতি জি২০ সদস্যদেশগুলোর করায়ত্তে রয়েছে। ১৯টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিলে এই জি২০। ৭৫ শতাংশ বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য তাদের অধীনে। এ বৈশ্বিক প্রভাবকে বাদ দিয়ে পৃথিবী কল্পনা করা যায় না। এ দেশগুলোর ভেতর আবার অনেক মেরুকরণ রয়েছে। আমরা এরই মধ্যে দেখেছি চীন ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট আসেননি। রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী যারা, তারা এলে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হতো। তার মানে এসব বৃহৎ শক্তির ভেতর অনেক ফাঁকফোকর রয়ে গেছে। ফলে সম্মেলনের প্রতিপাদ্য অনুযায়ী এক পৃথিবীর যে এজেন্ডা সেটি বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে এটি এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা যখন ইকোলজিক্যাল ইমব্যালান্সের কথা বলছি, পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচার স্বপ্ন দেখছি, সে সময়ে জি২০ পৃথিবীর জন্য গাইডলাইন হতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিশ্বনেতাদের বিভাজনের কারণে সেটি সম্ভব নয়। তার পরও এতগুলো চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও জি২০ সম্মেলনে যদি কিছু অর্জন করা যায়। এটিকে আমরা প্রশ্নবোধক রেখেই আশাবাদী হতে পারি। 

এরই মধ্যে ভারত যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে তা গুরুত্বপূর্ণ এবং জি২০ সম্মেলনের এ সিদ্ধান্তের আলোকে পৃথিবীর অর্থনীতি যদি ঢেলে সাজানো যায় তাহলে ভালোই হয়। তা আগামীর পৃথিবীর জন্য সুখবর হতে পারে। যেমন ঋণ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, আইএমএফকে জি২০ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে অনুরোধ করা হয়েছে। ঋণের ফাঁদে পড়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো জর্জরিত হচ্ছে, যেমন আমরা মেগা প্রজেক্টগুলোর জন্য ঋণ নিয়েছি। আফ্রিকার অনেক দেশই নিয়েছে। আফ্রো এশিয়া, লাতিন আমেরিকার দেশগুলো ঋণ নিয়ে তাদের উন্নয়ন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করছে। এ ঋণগুলো শোধ করতে গিয়ে তারা ফাঁদে পড়ে গেছে। আমরা জানি, চীনের বেশ দুর্নাম হয়েছে, চীনের যে ক্রেডিট ডিপ্লোমেসি (ঋণ কূটনীতি), এটিকে বৈশ্বিকভাবে সমালোচনা করা হচ্ছে। চীনের শীর্ষ নেতা সম্মেলনে এলেন না, তার অন্যতম একটি কারণ হতে পারে এ অবস্থার মুখোমুখি হতে চাননি। সে কারণে হয়তো চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সম্মেলনে আসেননি। 

যে ঋণের ভারে গ্লোবাল সাউথ জর্জরিত হচ্ছে, এ ঋণ থেকে গ্লোবাল সাউথকে কীভাবে মুক্তি দেয়া যাবে, তা নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে। সেখানে ভারতের নেতৃত্বেই বলা হয়েছে যে দরিদ্র এবং ঋণ শোধ করতে পারছে না এমন অপারগ দেশগুলোর জন্য একটি বিশেষ নীতি গ্রহণ করা হোক। সেটি বাস্তবায়ন হলে এ চেতনাকে ধারণ করে ভবিষ্যতে জি২০-এর সদস্যরাষ্ট্রগুলোর নেতাদের তত্ত্বাবধানে ঋণ পরিশোধ কার্যক্রমকে যদি সহজ করা হয়, তাহলে এ সম্মেলনের অন্যতম লক্ষ্য সামনে অর্জিত হবে। পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার বিষয়টি আগেই বলেছি, জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত সম্মেলনে নেয়া হয়েছে। এটি যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে তা অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ হবে। 

আঞ্চলিক ও বিশ্ব রাজনীতির নানা দোলাচলের মধ্যেই জি২০ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হলো। ভারত হলো গণতন্ত্রের ক্ল্যাসিক উদাহরণ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেখানে গিয়েছেন। সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য বিরল সম্মান নিয়ে এসেছেন। বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যও অর্জিত হয়েছে। এগুলো বিশ্বের দরবারে ধরে রাখা প্রয়োজন। এদিকে এ সম্মেলনের সাইডলাইনে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিনটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ, এখন এগুলোর বাস্তবায়ন দেখার বিষয়, তাহলে এ সম্মেলনের তাৎপর্য ফুটে উঠবে। এদিকে এ সম্মেলনের সার্বিক ফলাফল হিসেবে ঋণ কূটনীতির পাশাপাশি ভারত যদি দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ পায়, তাহলে এটি আমাদের জন্য অনেক সম্মানজনক হবে। আর এমন এক সময়ে সম্মেলনটি আয়োজন হয়েছে, যখন আমরা ইঙ্গিত পেয়েছি, জো বাইডেন তাতে সমর্থন দেবে। আরেকটি দিক থেকে এ সম্মেলনের তাৎপর্য ছিল, সেটি হচ্ছে জি২০ কিন্তু জি২১ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়নকে যদি এর সদস্য করা হয়, তাহলে বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতির জন্য এটি ইউটার্ন হিসেবে ভূমিকা রাখবে। আমরা সিল্করুটের কথা জানি, মসলা বণিকরা যে পথ ধরে চলাচল করেছে। দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা হয়ে ইউরোপে চলে গিয়েছিল। এ পুরো এরিয়ায় রেলপথ তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, এটিকে বলা হলো স্পাইস রুট। এটি বাস্তবায়ন হলে ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এ চারটি মহাদেশ সংযুক্ত হবে। এখানে পৃথিবীর ৮০ শতাংশ সংযুক্ত হতে পারবে। এতে অত্র এলাকার শিক্ষা, দীক্ষা, বাণিজ্য, অর্থনীতি সবকিছুই একটি শক্তিশালী অবস্থানের দিকে এগোবে। 

এগুলো সম্মেলনের ইতিবাচক দিক। তবে জি২০ সম্মেলনের নেতিবাচক দিকগুলোও রয়েছে। আমরা সম্মেলনে যত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি, তার বাস্তবায়ন খুবই কঠিন। এর প্রধান কারণ হলো বৃহৎ শক্তির ভেতরে যে অনৈক্য, এজেন্ডা বাস্তবায়নে তাদের যে বিপরীতমুখী স্বার্থচিন্তা, এটি জি২০-এর নেতিবাচক দিক। দক্ষিণ এশিয়াসহ পৃথিবীর সব দেশেই বৃহৎ শক্তিগুলোর আলাদা এজেন্ডা রয়েছে। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, আমরা কিন্তু গ্লোবাল সাউথ। ভারতকে ভুললে চলবে না, ভারতও গ্লোবাল সাউথের অংশ। আমরা একসময় বৃহৎ শক্তির কলোনি ছিলাম। এ শক্তি এখনো আমাদের কলোনি মনে করে। কাজেই তাদের সঙ্গে যদি একসঙ্গে বসে কাজ করতে হয়, তাহলে ইতিহাসকে ভুললে চলবে না। আমি যখন পশ্চিমা দেশে পড়াশোনা করেছি, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হতো। কিন্তু আমরা একসময় তাদের কলোনি ছিলাম, এ মাইন্ডসেট তাদের এখনো আছে। এক্ষেত্রে আমাদের গ্লোবাল সাউথে অত্যন্ত সতর্কভাবে অগ্রসর হতে হবে। যখন তারা কর্তৃত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা পালন করতে আসবে, তখন নিরাপদ দূরত্বে থেকে অংশগ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত চীন ও রাশিয়া, এ দুটি রাষ্ট্রই যেহেতু প্রেসিডেন্টকে পাঠায়নি, কারণ হচ্ছে এজেন্ডার ক্ষেত্রে তারা একমত না। দ্বিতীয়ত ব্রিকস, ভারতও ব্রিকসের সদস্য। কিছুদিন আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকসের সম্মেলন হলো। তারাও আন্তর্জাতিক রুটস সিল্করুটকে এগিয়ে নিতে চাইছে, এর বাণিজ্য সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চাইছে। তাহলে জি২০ এবং ব্রিকস এদের যে বৈশ্বিক উদ্দেশ্য তা কিন্তু সবার সমান। সবারই অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য রয়েছে। এটা কিন্তু খুবই ট্র্যাজেডি, ব্রিকস এবং জি২০-এর ভেতরকার দ্বন্দ্ব। যারা ব্রিকসে আছে তারা জি২০-এও আছে (ভারত, রাশিয়া, চীন)। অন্যদিকে তাদের স্বার্থের দ্বন্দ্বও আছে। এটি খুব জটিল রসায়ন, এ জটিলতাগুলো কাটিয়ে জি২০-এর কার্যক্রম বেগবান ও লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন করা যাবে, তা নির্ভর করছে বৃহৎ শক্তিগুলো কীভাবে তাদের পররাষ্ট্রনীতি দাঁড় করাবে। গ্লোবাল সাউথ থেকে অত্যন্ত সতর্কভাবে তাদের সঙ্গে ইন্টার‍্যাক্ট (সংযোগ) করতে হবে। মনে রাখতে হবে অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক ইস্যুতে তাদের অন্তর্ভুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু ইন্টারফেয়ার (হস্তক্ষেপ) বা অতিরিক্ত নাক গলানো যেন না হয়, তার জন্য আমাদের মেরুদণ্ড শক্ত করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে নেয়া যেতে পারে সিঙ্গাপুরের নাম। আমরা যদি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে পারি, তাহলে দরকষাকষি করতে পারব। না হলে গ্লোবাল সাউথ কোনোদিনই উঠে দাঁড়াতে পারবে না। তৃতীয় বিষয় হচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতিতে রাজনীতি ও অর্থনীতির সংযুক্তি দেখি। এখন ভারত যদি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হয়, আমরাও সেটি চাইব। তাহলে ভারত গ্ণোবাল সাউথের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে চলে যাবে। দক্ষিণ গোলার্ধের  দেশগুলোর মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠা হলে কলোনিয়াল শক্তিগুলো অতিরিক্ত খবরদারি করতে পারবে না। তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে একচ্ছত্র আধিপত্য আর দেখাতে পারবে না। সেদিক থেকে ভারতের নীতিনির্ধারকরা কতটুকু প্রস্তুত আছে, তা স্পষ্ট নয়। তবে ভারতের মূল্যবোধের সঙ্গে অন্যদের মূল্যবোধের অনেক সাংঘর্ষিক ব্যাপার রয়েছে। যেমন পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের শুধু সীমানার দ্বন্দ্ব না, মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব রয়েছে। কাশ্মীর নিয়ে তাদের দ্বন্দ্ব রয়েছে। আবার আফগানিস্তানের খুব প্রিয় বন্ধু ছিল ভারত, দেশটি আফগানিস্তানের উন্নয়নের জন্য প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করতে চাইত। যুক্তরাষ্ট্র সেখান থেকে চলে আসার পর ভারতকেও সেখান থেকে পাততারি ঘোটাতে হয়েছে। এখন প্রশ্ন, আফগানিস্তান, পাকিস্তানকে কীভাবে মোকাবিলা করবে ভারত? আবার ব্রিকসের সদস্যপদ কেন পেল না বাংলাদেশ, এক্ষেত্রে ভারতের সবুজ সংকেত না পাওয়ার বিষয়টিও গণমাধ্যমে এসেছে। এরপর প্রতিবেশী দেশ হিসেবে চীনের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্ব আছে, কিন্তু যখন বৃহত্তর আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ক্যানভাসে চিন্তা করা হবে, তখন চীনের সঙ্গে তার দূরত্বটা কমিয়ে আনতে হবে। এভাবে ভারতের যদি গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্ব দিতে হয়, তাহলে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব আছে, এ দ্বন্দ্ব কমিয়ে ভারতকে উদার মন নিয়ে আসতে হবে। আমি প্রত্যাশা করব, ভারত সে নেতৃত্ব গ্রহণ করুক। সাম্য, মৈত্রী, মর্যাদার ভিত্তিতে ভারত যেমন চলছে, গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্বে ভারত যেন সে জায়গায় আসে। এজন্য জি২০ সম্মেলনের মাধ্যমে গ্লোবাল সাউথের কণ্ঠ হিসেবে ভারতের যে আবির্ভাব, সেটিকে ধরে রাখতে হবে।  

মুহা. রুহুল আমীন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

শ্রুতলিখন: তৌফিকুল ইসলাম 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন