ডাক্তারদের সমন্বয়ের কারণে বিদেশী শিক্ষার্থী বাড়ছে

স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের কারণে বাংলাদেশে বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এসব মেডিকেল কলেজ থেকে প্রতি বছরই অনেক ডাক্তার বের হচ্ছেন। একসময় দেশের সামর্থ্যবানরা সামান্য শারীরিক সমস্যা হলেই বিদেশে চিকিৎসা করাতে যেত। সে প্রবণতাও এখন কমে গেছে। বাংলাদেশে মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় এখানে পড়তে আসছেন বিদেশী শিক্ষার্থীরাও। দেশের চিকিৎসা শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. শামসুজ্জামান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাব্বির আরিফ মোস্তফা

চল্লিশের দশকে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে এ অঞ্চলে চিকিৎসা শিক্ষার কার্যক্রম শুরু হয়। সে হিসেবে দেশে চিকিৎসা শিক্ষার ইতিহাস ৮০ বছরের। বাংলাদেশে চিকিৎসা শিক্ষার উৎকর্ষ কতটুকু অর্জিত হয়েছে?

আমি সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গিয়েছি দুই-তিন বছর আগে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি মনে করি, স্বাস্থ্য খাতে অনেক উন্নতি হয়েছে। একটা উন্নতির কথা যদি প্রথমে বলি, স্বাধীনতার আগে কোনো চিকিৎসক গেজেটেড অফিসার হিসেবে চাকরি করতে পারতেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম চিকিৎসকদের গেজেটেড অফিসার করেন। এর পর থেকে আমার মনে হয় চিকিৎসা খাতে এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে আমূল পরিবর্তন হয়েছে বা হচ্ছে। আমি আমূল পরিবর্তনের কিছু দিকনির্দেশনা দিতে চাই। আগে সরকারি মেডিকেল কলেজ ছিল আটটি, এখন অনেক হয়ে গেছে। পাশাপাশি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অনেক হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য খাতে বেসরকারি বিনিয়োগের কারণে অনেক হাসপাতাল হয়েছে। এসব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে অনেক ডাক্তার বের হচ্ছেন। অনেকেই প্রায় দোরগাড়ায় চিকিৎসা পাচ্ছেন। আমূল পরিবর্তনের আর একটি প্যারামিটার হচ্ছে, একসময় আমাদের দেশের যারা ধনিক শ্রেণী তারা অল্পতেই কিছু সমস্যা হলেই বাংলাদেশের বাইরে চিকিৎসা করাতে যেত। দেশের বাইরে যাওয়ার এ প্রবণতা ধীরে ধীরে কমে গেছে। এটা কমে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরো কমে যাবে। এই কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে দেশের বাইরে গিয়ে যে চিকিৎসা পাবে, যে প্রযুক্তির ব্যবহার পাবে, বাংলাদেশে তা ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হচ্ছে। এসব থেকে বলা যায়, আমাদের দেশে চিকিৎসা খাতে আমূল পরিবর্তন হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো পরিবর্তন হবে।

বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে অনেক বিদেশী শিক্ষার্থী রয়েছেন। সব শিক্ষার মধ্যে চিকিৎসা শিক্ষার জন্যই এ দেশে বিদেশীরা আসছেন। এর কারণ কী?

শুধু চিকিৎসা শিক্ষা নয়, বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা নিতে বিদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা আসছেন। তুলনামূলক আপনাদের দৃষ্টিতে বা আমাদের দৃষ্টিতে চিকিৎসা শিক্ষা নিতে বেশি শিক্ষার্থী আসছে—এ কথা সত্য। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। আমি এখানে তিন বছরে অধ্যক্ষ হিসেবে যা দেখলাম, আমি সরকারি মেডিকেল কলেজের প্রফেসর ছিলাম। সেখানে বিদেশী শিক্ষার্থী ছিল। অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গ্লোবালাইজেশন। এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের বন্ধত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। আমাদের দেশের তুলনায় পাশের দেশ নেপাল বা ভুটানে মেডিকেল কলেজ কম। সেখানেও ভালো শিক্ষার্থী আছে, তারা মেডিকেলে লেখাপড়া করতে চায়। তারা তখন পাশের দেশে চলে আসতে চায়। এটা একটা কারণ। আর একটা কারণ, ওদের দেশে লেখাপড়ার খরচ আমাদের চেয়ে বেশি। ভারত, ভুটান, মালদ্বীপ ও নেপাল থেকে সচরাচর শিক্ষার্থীরা এখানে আসে। তাদের এখানে আসার একটি কারণ হতে পারে, পাশাপাশি দেশ হওয়ায় তাদের কৃষ্টি-কালাচারের সঙ্গে আমাদের কৃষ্টি-কালচারের কিছুটা  মিল আছে। আর একটা কারণ হতে পারে নিরাপত্তা। সত্যি কথা বলতে দেশী ও বিদেশী যেসব শিক্ষার্থী বেসরকারি মেডিকেল কলেজে লেখাপড়া করছে, আমরা তাদের নিরাপত্তা বেষ্টণীতে রাখতে পারছি। স্থানীয় প্রশাসন সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখে। তাদের চলাফেরার দিকে খেয়াল রাখে। পাশাপাশি আমরা বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে টিম করেছি সার্বক্ষণিক তাদের খোঁজখবর রাখার জন্য। এগুলো ধীরে ধীরে তাদের দেশে প্রচার হচ্ছে। ফলে তারা আমাদের দেশে লেখাপড়া করার জন্য বিশেষ করে শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে উঠছে। সংস্কৃতির পাশাপাশি আর একটি কারণ রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ একটি ভালো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ। সারা দেশের মানুষ চেনে। লেখাপড়া করার জন্য এখানে ভারত, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলংকা থেকে শিক্ষার্থীরা আসছে। তারা নিরাপদে হোস্টেলে থাকছে। ভালো পরিবেশে তাদের পছন্দের খাবারও খেতে পারছে। আর একটা জিনিস তারা এসে দুই-এক মাসের মধ্যে বাংলা ভাষাও রপ্ত করতে পারে। ফলে তাদের চলাফেরায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এসব কারণে তারা বাংলাদেশে লেখাপড়া করার জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছে। আর একটা কথা না বললেই নয়, মেডিকেলে যারা লেখাপড়া করছে তারা রেজাল্টও ভালো করছে। রেজাল্ট ভালো করার পেছনে লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রযুক্তির দরকার আছে। আর প্রযুক্তি চালাতে গেলে ভালো শিক্ষকের দরকার আছে। ভালো মানের ডাক্তারের দরকার। আমরা ভালো মানের প্রযুক্তি, ভালো মানের শিক্ষক এবং ভালো মানের ডাক্তারের সমন্বয় করতে পেরেছি বলে শিক্ষার্থীরা ভালো রেজাল্ট করতে পারছে। এসব কারণে আমাদের দেশে শিক্ষা গ্রহণে বিশেষ করে মেডিকেল শিক্ষার জন্য বিদেশী শিক্ষার্থীদের আসক্তি দিন দিন বাড়ছে।

আপনার কলেজে এমবিবিএস কোর্সের কোন শিক্ষাবর্ষ থেকে বিদেশীরা ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান? বর্তমানে তাদের সংখ্যা কত?

আমাদের মেডিকেল কলেজটি যাত্রা শুরু করেছে ১৫ বছর হলো। এখন ১৫তম ব্যাচ চলছে। পঞ্চম ব্যাচ শুরু হয় ২০১২-১৩ সেশনে। তখন বিদেশী শিক্ষার্থী ছিল ১৬ জন। ষষ্ঠ ব্যাচে বিদেশী ভর্তি হয়েছে ৪০ জন। সপ্তম ব্যাচে ৪৭ জন, অষ্টম ব্যাচে ৪২ জন, নবম ব্যাচে ৬৩ জন, দশম ব্যাচে ৫৮ জন, ১১তম ব্যাচে ৬০ জন, ১২তম ব্যাচে ৪৬ জন, ১৩তম ব্যাচে ২৬ জন, ১৪তম ব্যাচে ৫৫ জন এবং ১৫তম ব্যাচে ৬০ জন বিদেশী শিক্ষার্থী রয়েছেন।

কোন কোন দেশের শিক্ষার্থীরা বেশি রয়েছেন এই কলেজে?

সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী আছেন ভারতের। দেশটি থেকে ২৭৮ জন শিক্ষার্থী এখানে ভর্তি হয়েছেন। তারপরে নেপাল। সেখান থেকে এসেছেন ২২৬ জন শিক্ষার্থী। এরপর ভুটান থেকে এসেছেন ১০ জন, মালদ্বীপ থেকে এসেছেন তিনজন। বর্তমানে আমাদের বিদেশী শিক্ষার্থী আছে ৫১৭ জন। এর মধ্যে ছেলে ২৯৬ জন ও মেয়ে ২২১ জন। ছেলে আর মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। এর কারণ হচ্ছে নিরাপত্তা পায় বলে বাবারা মেয়েদের এখানে লেখাপড়া করতে পাঠায়। মাঝখানে তিন-চার বছর করোনার কারণে শিক্ষার্থী ভর্তি কম হয়েছিল।

সার্কভুক্ত দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য কি বিশেষ কোনো সুবিধা রয়েছে?

বিশেষ সুবিধা সার্কভুক্ত দেশগুলো এমনিতে বেশি পেয়েছে। আঞ্চলিকতার কারণে তারা সহজে বাংলা ভাষা রপ্ত করতে পারে। খুব দ্রুত আমাদের কালচার এবং খাবারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। দ্রুত আমাদের পোশাকের সঙ্গে তারা মানিয়ে নেয় নিজে নিজে। তবে সার্কভুক্ত দেশকে আমরা চেষ্টা করি একটু বেশি সুবিধা দেয়ার।

ডিগ্রি অর্জনের পর বাংলাদেশে পেশাজীবন শুরু করতে তাদের মধ্যে আগ্রহ কেমন?

তারা যদি আগ্রহ প্রকাশ করে তাও থাকতে পারে না। নিজের কারণে হোক বাবা-মায়ের কারণে হোক অথবা জায়গার কারণে হোক তাদের দেশে পরীক্ষা দেয়, তারপর কর্মজীবনে চলে যায়। এজন্য আমার মনে হয় এ দেশে তারা থাকতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। আগ্রহ প্রকাশ করলেও এই সিস্টেমে তারা এখানে থাকতে পারবে না।

দেশী আর বিদেশী শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব কেমন দেখতে পাচ্ছেন? সাংস্কৃতিক বিনিময়ই বা কেমন হচ্ছে?

ওদের ভাব বিনিময় পোশাক দিয়ে হবে, কথাবার্তা দিয়ে হবে, ভাষা দিয়ে হবে। কালচারাল শো দিয়ে হবে। আমরা যখন ক্লাস নিতে যাই দেখি বিদেশী শিক্ষার্থী স্থানীয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসে থাকেন। সম্পর্ক ভালো দেখি তারা যখন একসঙ্গে হলে বসেন। সম্পর্ক ভালো দেখি যখন ক্যান্টিনে দেশী-বিদেশী শিক্ষার্থী একসঙ্গে বসে খান। আমরা কালচারাল শোর আয়োজন করি। ওরা (বিদেশী শিক্ষার্থী) শতভাগ সহায়তা করেন। ওদের দেশের নাচ পরিবেশন করেন, দেশীয় সংস্কৃতি তুলে ধরেন। দেশীয় পোশাক পরে নৃত্য করেন। এসব দেখে বোঝা যায় ওরা শতভাগ একাত্মতা প্রকাশ করে এ দেশে চলাচল করছেন।

বিদেশী শিক্ষার্থীদের আরো আগ্রহী করে তুলতে এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষার প্রসার ঘটাতে অধিকতর কী কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?

সরকারি পর্যায়ে একটা পদক্ষেপ নেয়া হয়ে গেছে। সরকার ঘোষণা করেছে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ বা শতকরা ৫০ ভাগ বিদেশী শিক্ষার্থী নিতে পারবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ। এ সুযোগ সরকারই করে দিয়েছে। তাদের আমরা আরো আকৃষ্ট করার জন্য মাঝে মাঝে হেলথ ফেয়ার করি। হেলথ ফেয়ারে আমাদের কী আছে কী নেই তা দেখায়। শুনে অবাক হবেন, একজন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার ছয় মাস বা এক বছর আগে তার বাবা-মা এ কলেজে ভিজিট করতে আসেন। আমাদের হোস্টেলে উঠে খাওয়া-দাওয়া করেন। এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরিও করেন। রংপুরে চার-পাঁচদিন ঘুরেফিরে ছয় মাস পর সন্তানকে নিয়ে আসেন। তার মানে তারা এসে দেখে যান এখানে কী সুবিধা আছে কী নেই। যেহেতু আমরা এটি জানি, তাই এ বিষয়ে কীভাবে আরো সুবিধা বাড়ানো যায় এ ব্যাপারে সজাগ থাকি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন