প্রতিটি জেলায় আইভিএফ সেন্টার থাকা প্রয়োজন

গুণগত মান বজায় রেখে চিকিৎসাসেবা দিতে বদ্ধপরিকর ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল। প্রতিনিয়ত সেখানে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন সেবা ও প্রযুক্তি। এরই ধারাবাহিকতায় বেশ আস্থা অর্জন করেছে ল্যাবএইড ফার্টিলিটি সেন্টার। বন্ধ্যাত্ব, আইভিএফ চিকিৎসা এবং নিজেদের ফার্টিলিটি সেন্টারের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন ল্যাবএইড ফার্টিলিটি সেন্টারের গাইনি ও অবস বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট অধ্যাপক ডা. মরিয়ম ফারুকী স্বাতী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শর্মিলা কুণ্ডু

দেশেই বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় বেশ সাফল্যের সঙ্গে ভূমিকা রাখছে ল্যাবএইড। ল্যাবএইডের আইভিএফ সেবা সম্পর্কে আমাদের বিস্তারিত জানাবেন?

আমরা ২০০৭ সাল থেকেই বন্ধ্যাত্ব সমস্যায় ভুগছেন এমন দম্পতিদের চিকিৎসা দিচ্ছি। বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসার অনেকগুলো ধাপ রয়েছে। এর মধ্যে আইভিএফ হলো চূড়ান্ত চিকিৎসা। যাদের সন্তান হচ্ছে না তাদের নানা রকম চিকিৎসা দিয়ে সফলতা না পেলে তখন ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা টেস্টটিউব বেবি বা আইভিএফ চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করছি। শুরু থেকেই প্রতি বছর ৫০-৬০ জনকে এ চিকিৎসা আমরা দিয়ে থাকি। কারণ একজন রোগীকে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোন চিকিৎসাটি তার জন্য প্রযোজ্য হবে সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে কিছুদিন সময় লাগে। এতে মোটামুটি তিন সপ্তাহ প্রয়োজন হয়। এছাড়া চিকিৎসার জন্য সব ধরনের উপকরণ জোগাড় করার ক্ষেত্রেও একটা সময়ের প্রয়োজন পড়ে। এ চিকিৎসাটা ধাপে ধাপে দিতে হয়। আমরা এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত সফলতা পেয়েছি।

আইভিএফ চিকিৎসা নিয়ে অনেকের মধ্যেই এক ধরনের ভয় কাজ করে। ল্যাবএইডে চিকিৎসাসেবার গুণগত মান ঠিক রাখার জন্য আপনাদের প্রস্তুতি কেমন?

গুণগত মান বজায় রাখতে গেলে চিকিৎসার শুরু থেকেই কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। চিকিৎসার ধাপগুলো ঠিকভাবে অনুসরণ করা, চিকিৎসা সরঞ্জামের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা বা জীবাণুমুক্ত রাখা, আল্ট্রাসনোগ্রাফি বা সিমেন পর্যবেক্ষণসহ বিভিন্ন পরীক্ষার ধাপ সঠিকভাবে অনুসরণ করার ওপর আমরা জোর দিই। সর্বোপরি যখন আমরা আইভিএফ চিকিৎসাটা দিই তখন সেটা বিশেষায়িত ল্যাবরেটরি বা বিশেষায়িত সেন্টারে করে থাকি। সেখানে সর্বোচ্চ পরিচ্ছন্নতা এবং গুণগত মান দেখতে হয়। আমরা দুই থেকে তিন মাস পরপর আইভিএফ চিকিৎসার বিভিন্ন অপারেশন থিয়েটরের ভেতরে অথবা আইভিএফ ল্যাবে অথাবা অন্ট্রোলজির ল্যাবে সব সরঞ্জাম ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকি। প্রতি ছয় মাস পরপর বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারের মাধ্যমে সরঞ্জাম পরীক্ষা করি। এভাবে চিকিৎসার গুণগত মান বজায় রাখতে আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রাখি। 

বাংলাদেশে আইভিএফ সেবা শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর। কিন্তু এখনো এটি সেভাবে মানুষের কাছে পরিচিতি পায়নি। আইভিএফ চিকিৎসা পরিচালনার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাগুলো কী?

আমাদের দেশের জন্য আইভিএফ অনেক অ্যাডভান্স চিকিৎসা পদ্ধতি। যদিও উন্নত বিশ্বে এ চিকিৎসা বহু আগে থেকেই প্রচলিত। আমাদের এখানে অজ্ঞতার কারণে অনেক কুসংস্কার ছড়িয়ে পড়েছে। চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েও অনেকের নানা প্রশ্ন থাকে, কোথা থেকে কীভাবে ভ্রুণ তৈরি হবে, কেন বাইরে থেকে আসবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আইভিএফের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কুসংস্কারগুলো অনেক বড় বাধা। তাছাড়া এ চিকিৎসা সব জায়গায় যেমন পাওয়া যায় না তেমন এতে খরচও অনেক বেশি। এ চিকিৎসা যদি আরো বেশি হাতের নাগালে নেয়া যায়, খরচ নাগালের মধ্যে আনা যায়, কুসংস্কারের বিষয়ে মানুষকে বোঝানো যায় তবেই এ চিকিৎসা পদ্ধতি আমাদের দেশে এগিয়ে যাবে। যেমন একবার কোনো পরিবার যদি আইভিএফ করে, তাহলে পরেরবার আর তাদের আগ্রহ থাকে না শুধু খরচের কারণে। এছাড়া কীভাবে শুক্রাণু সংগ্রহ করা হয় এবং কীভাবে সেটিকে ভ্রুণে পরিণত করা হয় এসব বিষয়ে মানুষকে খোলামেলা জানানো প্রয়োজন। মানুষের আইভিএফ নিয়ে জ্ঞানগত প্রতিবন্ধকতা দূর করা গেলে কুসংস্কার দূর হয়ে যাবে। আমি মনে করি, এ সমস্যা সমাধানে ছোট ছোট বুকলেটের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো, সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন।

বর্তমানে প্রাকৃতিকভাবে সন্তান জন্মদানে অক্ষম দম্পতিদের মাঝে আইভিএফ পদ্ধতি গ্রহণের আগ্রহ কেমন?

সন্তান জন্ম দিতে পারছেন না এমন দম্পতিরাই আমাদের কাছে আসেন। তখন আমরা বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করি সমস্যাটি কার। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যেত যখন পুরুষের সমস্যা চিহ্নিত হতো, তখন আমরা বলে দিতাম সন্তান জন্ম দেয়া সম্ভব না। এখন প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে, আমরা অনেক কিছু জেনেছি, শিখেছি। তখন দেখা গেল এসব সমস্যারও চিকিৎসা রয়েছে। আমরা এখন পরামর্শ দিই দুজনকেই চিকিৎসকের কাছে আসতে। দুজনকেই সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সমস্যা চিহ্নিত করে এবং সমাধান বের করা হয়। তারপর চিকিৎসা শুরু করতে হয়।

বর্তমানে কি বাংলাদেশে বন্ধ্যাত্বের হার বাড়ছে? এর পেছনে কারণ কী?

আমাদের এখানে আমাকেই প্রতিদিন অনেক রোগী দেখতে হয়। আমি ছাড়াও দেশে অনেক ডাক্তার আছেন যাদের এমন সমস্যা নিয়ে কাজ করতে হয়। উনাদের কাছেও নিশ্চয়ই অনেক রোগী যান। যেমন ঢাকা মেডিকেল বা অন্য সেন্টারগুলোতেও ভিড় আছে। শুধু রাজধানী বা বড় শহরগুলো নয়, জেলা পর্যায়েও অনেক সেন্টার বা চিকিৎসক এ সমস্যা নিয়ে কাজ করেন। ফলে বলা যায় বন্ধ্যাত্ব ক্রমেই বাড়ছে। এ সংখ্যা বাড়ার নানা রকম কারণ রয়েছে। যেমন মেয়েরা অনেক দেরি করে বিয়ে করছে, সন্তান নিতে দেরি করছে, চাকরি করতে চান। এমন বেশকিছু পশ্চিমা প্রভাব আমাদের এখানে আসছে। একটা সময় ছিল বিয়ে হওয়ার দুই-এক বছরের মধ্যেই সন্তান নিয়ে নিত। কিন্তু এখন মেয়েরা ক্যারিয়ারের জন্য বেশ সময় নেয় সন্তান নেয়ার আগে। অনেকেই মনে করেন, ছেলেদের বয়স বাড়লে কোনো সমস্যা হয় না। এটি ভুল। অবশ্যই মেয়েদের বয়স বেড়ে যাওয়ার প্রভাব যেমন সন্তান জন্মদানের ওপর রয়েছে তেমন ছেলেদেরও বয়স বেড়ে যাওয়ার একটা প্রভাব রয়েছে। অনেক ছেলে দেশের বাইরে যাওয়া বা ক্যারিয়ারের জন্য নিজের একটি পরিবার তৈরিতে মনোযোগী হতে পারেন না। তখন বয়স বেড়ে যায়, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ওজন বেড়ে যায়। এছাড়া পরিবেশেরও প্রভাব কিন্তু রয়েছে। ধুলা, দূষণসহ নানা প্রভাব মানুষের শরীরে পড়ে যেটি প্রজনন স্বাস্থ্যকেও হুমকিতে ফেলে। খাবার এবং জীবনযাপন পদ্ধতিও এক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

আগে আইভিএফ সেবা নিতে দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা ছিল বেশি। এখন দেশেই মিলছে এ সেবা। আইভিএফ চিকিৎসায় বিদেশের সঙ্গে আমাদের দেশের তুলনা করলে বাংলাদেশের অবস্থানটা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

আশপাশের দেশের সঙ্গে আমাদের তফাত রয়েছে। ভারত, সিঙ্গাপুর, জাপান বা চীনে এ চিকিৎসা অনেক আগেই শুরু হয়েছে। আমরা শুরু করেছি অনেক দেরিতে। ফলে তারা এ চিকিৎসায় অনেক দিন ধরে চর্চা করছে এবং আমাদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছে। খরচের বিষয়ে পশ্চিমা দেশের সঙ্গে আমাদের তুলনা করছি না, তবে আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের খুব একটা পার্থক্য নেই। এছাড়া টেকনিক্যালি আমাদের এখানে অনেক দক্ষ চিকিৎসক তৈরি হয়েছেন। অন্য আনুষঙ্গিক জিনিস সহজে যদি পাওয়া যায় তাহলে খরচটা কমে আসে এবং চিকিৎসাটা সহজ হয়। যেমন কোনো একটি ওষুধ বিদেশ থেকে আসছে, হঠাৎ সেটি বন্ধ হয়ে গেলে সমস্যাটা দেখা দেয়। সেজন্য ওষুধসহ আনুষঙ্গিক জিনিস সহজে পাওয়া গেলে চিকিৎসক এবং যারা সেবাটি নেবেন উভয়ের জন্যই সুবিধা হবে।

এ চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে নীতিগত কোনো পরামর্শ কি আপনার রয়েছে?

বর্তমানে সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল ও বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ সেবা চালু রয়েছে। আমরা চাইব এ ধরনের ইনফার্টিলিটি সেন্টারগুলো নিয়ে সুনির্দিষ্ট একটা নীতি থাকা প্রয়োজন। প্রতিটি জেলায় যদি এ চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকে তাহলে সবাই আসবে। প্রথমে প্রাথমিক চিকিৎসাটা নেবে তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে। আমরা চাই প্রত্যেকটা হাসপাতালে ইনফার্টিলিটি সেন্টার থাকবে। এটিই আমার মনে হয়, সব জায়গায় যদি আমরা সেন্টার করি তাহলে সবার জন্য সুবিধা। আমার এখানে অনেক দূর থেকে রোগী আসে। বরিশাল, নোয়াখালী বা অন্য মফস্বল এলাকাগুলো থেকে আসে। যদি তাদের হাতের নাগালে প্রাথমিক চিকিৎসা থাকত তাহলে এখানে এসে তাদের অ্যাডভান্সড চিকিৎসাটা দেয়া যেত। ফলে আমি মনে করি প্রতিটি জেলায় একটি করে আইভিএফ সেন্টার থাকাটা প্রয়োজন। সেন্টার থাকা মানে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকবেন, আনুষঙ্গিক চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকবে এবং দক্ষ লোকবল থাকবে। ফলে চিকিৎসাটা সহজ এবং স্বল্প খরচে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে আসবে।

অনেকেই মনে করেন আইভিএফ সেন্টার মানেই টেস্টটিউব বেবি। সত্যিই কি তাই? আইভিএফ সেন্টার কি শুধু টেস্টটিউব বেবির চিকিৎসাই দেয় নাকি এখানে অন্য কোনো চিকিৎসা পদ্ধতিও রয়েছে?

ফার্টিলিটির একটি কার্ভ থাকে। এটি ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে সুস্থ স্বাভাবিক থাকে। ৩০ বছরের পর এটি ক্রমেই দুর্বল হতে থাকে। ফলে ৩০-এর পরই সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসে। এজন্য ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে সন্তান নিয়ে নেয়া সবচেয়ে ভালো। আইভিএফ সেন্টার থাকা মানে সেখানে শুধু টেস্টটিউব বেবির সব রকম ব্যবস্থা থাকবে তা কিন্তু নয়। এখানে মূলত বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসাটা পুরোপুরি থাকে। আইভিএফ সেন্টারে এলে টেস্টটিউব বেবিই নিতে হবে এমন নয়। ইনফার্টিলিটি সেন্টার মানে হলো যাদের সন্তান হচ্ছে না চিকিৎসার জন্য তারা আসবেন। এসে অন্তত কিছু না করুক সেবা প্রার্থীরা এসব বিষয় সম্পর্কে ভালো করে জানবেন এবং নিজেদের সমস্যা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য জেনে যাবেন। অনেক দম্পতিরই টেস্টটিউব বেবি পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদে কিছু চিকিৎসা নিয়ে তারা স্বাভাবিক পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম দিতে পারছেন। সেজন্য ডাক্তারের কাছে আসতে হবে এবং ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন