জন্মবার্ষিকী

তাজউদ্দীন আহমদ: কর্তব্যবোধ ও বাংলাদেশের নবজাগরণ

ড. কাজল রশীদ শাহীন

ইতিহাসের নায়কদের চিনে নিতে হয় প্রত্যেক জাতিকে। যে জাতি এ প্রশ্নে থাকে উদাসীন, সংশয়িত তার মাশুল দিতে হয় কড়ায়-গণ্ডায়। কেননা জাতির নির্মাণের প্রশ্নে, আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তার ইতিহাস ও ইতিহাসের নায়কদের চেনাটা জরুরি নয় কেবল, অপরিহার্য। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন আমাদের ইতিহাসের নায়কদের অন্যতম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনীষী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকালের প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীন বাংলাদেশেরও প্রথম প্রধানমন্ত্রী। যার সবটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে, বঙ্গবন্ধুর কাঙ্ক্ষিত চাওয়াকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। এ যেন হিন্দু পুরাণের ভরতের গল্প! যদিও তাতে অতিরঞ্জন নেই একরত্তি।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন স্থপতির স্বপ্ন বাস্তবায়নের কারিগর। স্বপ্নকে সফল ও সার্থক করে তোলার ধ্রুপদী এক শিল্পী, ’৭১-এর যুদ্ধদিনের নায়ক। তার প্রখর নীতিবোধ, আত্মত্যাগ, স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন অবস্থান, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে লক্ষ্যভেদী মনোভাব, দেশপ্রেম, জনদরদ ও মানব সংবেদী বুদ্ধিবৃত্তিক হৃদয়ের কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্ভব হয়েছিল। যার মধ্য দিয়ে কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসের যাত্রায় বাঙালি জাতি প্রথমবারের মতো একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিকের গর্ব ও গৌরবের অধিকারী হন।

খান সারওয়ার মুরশিদ ‘তাজউদ্দীন আহমদ আলোকের অনন্তধারা-প্রথম খণ্ড’ বইয়ে লিখেছেন, ‘আমার একটি কথা বিশেষভাবে মনে আছে, যে দিন ভারত আমাদেরকে স্বীকৃতি দিল, ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ভারত যখন যুদ্ধের জন্য তৈরি, সেদিন তাজউদ্দীন কিন্তু কেঁদে ফেলেছিলেন সাংবাদিকদের সামনে। তাজউদ্দীনের সাথে শেখ সাহেবের কী যে সম্পর্ক ছিল সেটা আমি বুঝতে পারিনি। সেদিন তাজউদ্দীন না কাঁদলে আমি খুশি হতাম হয়তো। সেদিন তাজউদ্দীন বললেন, ‘বাংলাদেশের আজ জন্ম হল। পৃথিবীর একটি প্রধান রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল। এবং এই রাষ্ট্রের যিনি সত্যিকার জনক তিনি এই দৃশ্যটি দেখবার জন্য উপস্থিত নেই। আজ তাঁর অনুপস্থিতি আমি অন্তরাত্মা দিয়ে উপলব্ধি করছি।’ তাজউদ্দীনের চোখ দিয়ে বেশ খানিকটা জল গড়িয়ে পড়ল। দেশে যুদ্ধ চলছে, এক অর্থে তাজউদ্দীন কিন্তু সেই যুদ্ধের জনকও।

তাই বলছিলাম, প্রধানমন্ত্রীর চোখ দিয়ে জল পড়বে কেন? জল যদি থাকে সেটা অনুভবে থাকবে। বুঝতে পারছি তার আন্তরিকতা, নেতার প্রতি তার আনুগত্য, ভালোবাসা। এটা পরিষ্কার, তাজউদ্দীন সৎ মানুষ ছিলেন, চোখের পানি চেয়ে রাখতে পারেননি।’

তাজউদ্দীনের লক্ষ্য ছিল একটাই—স্বাধীন বাংলাদেশ। আর স্বাধীন বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের বাংলাদেশ। আমাদের ভেবে দেখা জরুরি, কেন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ গঠন সম্ভবপর হলেও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশপ্রেম ও জাতি গঠনের সেই অগ্নিমন্ত্র থেকে ছিটকে পড়লাম আমরা। অথচ এ জাতির এই মানুষই তো সুচারুভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছে।

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় তাজউদ্দীনের অবদানের কথা বিভিন্নজনের লেখালেখিতে যেভাবে উঠে এসেছে তা যেন রূপকথাকেও হার মানায়। দিন-রাত পরিশ্রম করতেন। ঘুমাতেন মাত্র ৪ ঘণ্টা। কলকাতার থিয়েটার রোডের অফিস-সংলগ্ন একটা রুমেই রাত্রি যাপন করতেন। পরিবারের সঙ্গে দেখা করেননি যুদ্ধ চলাকালে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার ঘটনার পর ঢাকার ধানমন্ডির বাসা ছাড়েন। স্ত্রীকে একটা চিরকুট লিখে জানিয়েছিলেন, যুদ্ধ শেষ হলে দেখা হবে আর নির্দেশ দিয়েছিলেন সন্তানদের নিয়ে সাত কোটি জনতার সঙ্গে মিশে যেতে। সত্যিই যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে পরিবারের সঙ্গে দেখা করেননি তিনি। অথচ তারও ছিল একটা কোমল মন। যেমনটা সাক্ষ্য দেয় নিচের দুটো ঘটনায়।

এক. ১৯৭০ সালে নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড়ের সময় (ডিসেম্বরে ছিল নির্বাচন) অনেক মানুষ তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। এমন সময় তার বাড়ির জানালায় ঘূর্ণিঝড়ের কারণে একটা বুলবুলি পাখির মৃত্যু হয়। অন্ধকারে লুকিয়ে ক্রন্দনরত তাজউদ্দীন আহমদকে তার মেয়ে দেখে ফেলেন। ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে সারা দিন আন্দোলনরত তাজউদ্দীন মেয়েকে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বাসায় এত মানুষের জায়গা হলো, অথচ এ ছোট্ট বুলবুলি পাখিটার জায়গা হলো না ...।’

দুই. ১৯৭১ সালে যখন ভারতে বসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এবং দেশের শাসনকার্য নিয়ে ব্যস্ত তখনকার ঘটনা। আনিসুজ্জামান একদিন তাজউদ্দীন আহমদের কাছে যান। তিনি গিয়ে দেখলেন, তার চুল উষ্কখুষ্ক, চোখ লাল। বললেন, ‘আপনার শরীর খারাপ নাকি?’ তাজউদ্দীন সাহেব জবাব দিলেন, ‘গত রাতে শুতে যাওয়ার পর হঠাৎ ঝড়ে আমার ঘরের জানালার একটা অংশ খুলে গেল, তখন মনে হলো, এই ঝড়ে আমার ছেলেরা না খেয়ে, না ঘুমিয়ে যুদ্ধ করছে, আর আমি ঘুমাচ্ছি? আমি রাতে আর ঘুমাতে পারি নাই...।’

তাজউদ্দীন আহমদের প্রজ্ঞা ও মনীষায় মানুষের স্থান ছিল সর্বাগ্রে। মানুষকে তার প্রাপ্য অধিকার-শ্রদ্ধা ও সম্মান দেয়ার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা উদাহরণযোগ্য ও অনুসরণীয়। তার মানুষ নিয়ে ভাবনার বৃত্তজুড়ে ছিল দেশপ্রেম।

রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতি-সংস্কৃতি নীতি নিয়ে ছিল গভীর অনুধ্যান ও চিন্তার স্বাতন্ত্র্য। এমনকি বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রেও তিনি দেশপ্রেমকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন। বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রে তার সরাসরি যুক্তি ছিল—আমরা সাহায্য নেব তবে তা কোনোভাবেই ভিখারির মতো নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু সরাসরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, এ কারণে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়েও তার ছিল শক্তিশালী যুক্তি ও ভিন্ন কৌশল গ্রহণের পরামর্শ।

বাংলাদেশের নবজাগরণে তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা কতটা গভীর তা উত্তর প্রজন্মের কাছে পরিষ্কার হতো যদি পুরো ঘটনাকে নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে দেখার চেষ্টা জারি থাকত। বেঙ্গল রেনেসাঁর মতো ঢাকায় ১৯২১ সাল থেকে বাংলাদেশের নবজাগরণ শুরু হয় এবং তিনটা ধাপে সেটা ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পায়। প্রথম ধাপটি হলো ১৯২১ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত। দ্বিতীয় ধাপটি ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত এবং তৃতীয় ধাপটি হলো ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত। প্রথম ধাপে বেশ কয়েকজন এ নবজাগরণকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের নবজাগরণের প্রথম ধাপের নায়করা সংগঠিত হন ‘শিখা’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে মুসলিম সাহিত্য সমাজকে ভরকেন্দ্রে রেখে। দ্বিতীয় ধাপের নায়করা সংগঠিত হন ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে, বাংলা ভাষার ন্যায্য মর্যাদার প্রশ্নে। তৃতীয় ধাপের নায়করা সংগঠিত হন ছয় দফাকে সামনে রেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাস্তবায়নের আকাঙ্ক্ষায়।

তৃতীয় ধাপের নায়ক যারা ছিলেন তাদের প্রধান হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর ক্রান্তিকালে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে   বাংলাদেশের নবজাগরণের অবিসংবাদিত নায়ক হন তাজউদ্দীন আহমদ।

প্রশ্ন হলো, ঢাকায় কি বাংলাদেশের রেনেসাঁ বা নবজাগরণ সংঘটিত হয়েছিল? এ প্রসঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ে কী তর্ক, আলাপচর্চা, অনুসন্ধান, এষণা জারি রয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর যদি না হয়, তারপর সত্য হলো ঢাকায় বাংলাদেশের নবজাগরণ সংঘটিত হয়েছিল। বাংলাদেশের নবজাগরণের সার্থকতা হলো, এ জাগরণ একটি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে তুলনারহিত উদাহরণ।

বাংলাদেশের নবজাগরণ বা রেনেসাঁকে যদি ইতালীয় রেনেসাঁ ও বঙ্গীয় রেনেসাঁর আলোকে অন্বেষণ করা হয়, তাহলে এ রেনেসাঁ সম্পর্কেও সংশয় ও বিভ্রান্ত হওয়ার অবকাশ রয়েছে। বিদ্বৎসমাজ কেন, এ রেনেসাঁকে এখন পর্যন্ত শনাক্ত ও মূল্যায়ন করেনি, তা মস্ত বড় এক হেঁয়ালি বৈ অন্যকিছু নয়। ঢাকায় বিংশ শতকে সংঘটিত রেনেসাঁ বিশেষভাবে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। ইতালীয় রেনেসাঁ যেমন পুরো ইউরোপকে আলোড়িত করেছিল। বঙ্গীয় রেনেসাঁ কলকাতায় সংঘটিত হলেও তার ছোঁয়া লাগেনি তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশে। ভারতীয় ঐতিহাসিক সুশোভন সরকার বেঙ্গল রেনেসাঁর যে তিনটি দুর্বলতার কথা বলেছেন, তার মধ্যে এটিকে অন্যতম জ্ঞান করেছেন। বাংলাদেশের নবজাগরণের শক্তি হলো এটি ঢাকায় সংঘটিত হলেও তার ধাক্কা লাগে প্রথম পর্বে পুরো পূর্ববঙ্গে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বে তদানীন্তন পুরো পূর্ব পাকিস্তানে।

হাসান হাফিজুর রহমানের এক লেখায় এ কথার কিছুটা ইঙ্গিত মেলে। তিনি ‘সমকাল’ পত্রিকা প্রকাশের কারণ সম্পর্কিত এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘পাকিস্তানের আগে বাঙালী মুসলমান স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠায় উত্তেজিত ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে পরেই দেখা গেল স্বাতন্ত্র্যই মুক্তি নয়। দুর্বল বাঙালী ন্যাশনালেটি প্রবল পাঞ্জাবী ন্যাশনালেটির বন্ধনে বাঁধা পড়েছে। স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার জায়গায় নতুনভাবে দেখা দিল আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রশ্ন।’

এ ‘আত্মপ্রতিষ্ঠা’ই হলো বাংলাদেশের নবজাগরণ বা রেনেসাঁর বিরল বৈশিষ্ট্য। যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মানবতাবাদ, ইহজাগতিকতা, উদারনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা, ধর্মীয় কুসংস্কার মুক্তি, আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার চর্চা, ন্যায্যতাভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণ ও সম্পদের সুষম বণ্টনের প্রত্যাশা পূরণ। রেনেসাঁ বা নবজাগরণ কীভাবে একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো বাংলাদেশের নবজাগরণ। যেখান উপ্ত হয়েছিল পুরো জাতিকে স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করার বীজমন্ত্র। বাংলাদেশের নবজাগরণের শুরু ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর। এ সূত্রে সেই সময়ের বিদ্বৎসমাজের একট বড় অংশের এখানে বসবাস ও একত্র হওয়ার সুযোগ ঘটে। যার কল্যাণে ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। যার মুখপাত্র ছিল ‘শিখা’ পত্রিকা। যাদের স্লোগান ছিল, ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’। উল্লেখ্য, মুসলিম সাহিত্য সমাজের আদর্শ ছিল ‘ইউরোপের নবজাগরণ-ইতালীয় রেনেসাঁ, উনিশ শতকের নবজাগরণ-বঙ্গীয় রেনেসাঁ, তুরস্কের নবজাগরণ-কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে সংঘটিত মুসলিম রেনেসাঁ।

‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর নেতৃত্বে ছিলেন আবুল হুসেন। সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন অনেকেই। উল্লেখযোগ্যরা হলেন: ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আবদুল কাদির, মোতাহার হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ আবদুর রশীদ প্রমুখ।

বাংলাদেশের নবজাগরণ যখন নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত ও বিকশিত হচ্ছে তখনই জন্মগ্রহণ করেন তাজউদ্দীন আহমদ। সময় ১৯২৫-এর ২৩ জুলাই ঢাকার অনতিদূরে গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। তারপর নবজাগরণের হাত ধরে তিনিও নিজেকে তৈরি করে তোলেন। এ যেন ইতিহাসেরই চাওয়া। নবজাগরণের কালে জন্ম নেয়া মানুষটিই একদিন বাংলাদেশের নবজাগরণের মহানায়ক হয়ে উঠবেন।

তাজউদ্দীন ছিলেন যুদ্ধদিনের নায়ক, যে যুদ্ধ ছিল গণমানুষের মুক্তির জন্য, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য। দেশপ্রেমের যুদ্ধে, মানুষের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষার যুদ্ধে তাজউদ্দীন ছিলেন সংশপ্তকতুল্য। তার সবচেয়ে বড় যুদ্ধ ছিল নিজের সঙ্গে। এ কারণেই ১৯৭১ সালের নয় মাসে নিজের পরিবারকেও দেননি একটু সময়। চিরকুট লিখে জানিয়ে দেন, যদি বেঁচে থাকি দেখা হবে দেশ স্বাধীনের পর। এমন পণ সংশপ্তক ছাড়া আর কেউ নিতে পারেন কি?

সিমিন হোসেন রিমির লেখায় রয়েছে, ‘একদিন সন্ধ্যায় আমি লিপিদের (সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের মেয়ে) ফ্ল্যাটে খেলছি, ওদের এক ভাই হঠাৎ দৌড়ে এসে বলল, আব্বা, আব্বা, তাজউদ্দীন চাচা এসেছেন। আমাদের ধারণা ছিল যাওয়ার সময় আব্বু একবার হয়তো আমাদের দেখে যাবেন। কিন্তু না, লিফটে ওঠার সময় দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের দিকে তাকিয়ে স্বভাবসুলভ একটু হেসে চলে গেলেন। এতেই আমাদের মন ভরে গেছে। আবার কিছুদিন পরে শুনেছি আব্বু সেখানে আবারও এসেছিলেন। কাজ সেরে চলে গেছেন, আমরা জানতেও পারিনি।’ এই হচ্ছে তাজউদ্দীন আহমদের কর্তব্যবোধ। যেখানে সন্তানের প্রতি পিতার ভালোবাসাও তুচ্ছ।

তাজউদ্দীন আহমদের এ মানসগঠন শৈশবেই বিকশিত হয়। তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় থেকেই নিয়মিত ডায়েরি লেখা শুরু করেন। একজন মানুষের নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও প্রত্যয় কতটা দৃঢ় হলে এভাবে ডায়েরি লেখা সম্ভব, তার উদাহরণ শুধুই তিনি। ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি মুহূর্ত দেখা, নোটবদ্ধ করা ও ব্যক্তির মধ্য দিয়ে সমগ্রতার প্রকাশ ঘটানো, জাতীয়তাবোধ ও আন্তর্জাতিকতায় ঋদ্ধ হওয়ার বিরলপ্রজ এক নজির তিনি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ সময়কালে রচিত ডায়েরি এখন আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের পূর্বাপর প্রেক্ষাপটের অমূল্য দলিল হিসেবে বিবেচিত। তার ডায়েরিকে আকরসূত্র ধরে বদরুদ্দীন উমর লিপিবদ্ধ করেছেন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। ২২ বছর সময়কালে একজন তরুণের ডায়েরিতে এমন সব বিষয় হাজির হয়েছে, যা হয়তো সেই সময়ের কিংবা আগের কারো কল্পনাতেই ছিল। তার ডায়েরির বিশেষ গুণ হলো, সেখানে সর্বৈবভাবে সত্যের উপস্থিতি ঘটেছে। বদরুদ্দীন উমর তার গবেষণা অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, ক্রসচেক করে কোনো সূত্রে বিভ্রান্তির কিছু পাননি। তার ডায়েরি সময়ের এমন এক দর্পণ, যাতে সমাজ-রাষ্ট্র ও সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব ঘটেছে। এমনকি মানুষের নাম-পেশার ক্ষেত্রে তার সতর্কতা বলে দেয় তিনি কতটা পারফেকশনিস্ট ছিলেন। দেশ ভাগ ও তার পরবর্তী সময়ে মানুষের নাম কেমন ছিল তা নিয়েও যদি কখনো গবেষণা হয়, তাজউদ্দীনের ডায়েরি তাতে সহায়ক রসদ জোগাতে পালন করবে অনেক বেশি ভূমিকা। প্রতিদিনের পড়াশোনা, ঘুমাতে যাওয়া থেকে শুরু করে কোথায় গেলেন, কী করলেন—এসবের চুম্বক অংশ তিনি এমনভাবে লিখে রেখেছেন, যা পাঠ করলে বিস্ময়ের অন্ত থাকে না।

ডায়েরির পাতায় পাতায় জীবনের এ সূক্ষ্ম উপস্থাপনই তাজউদ্দীনকে অন্য সবার থেকে করেছে বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ও ব্যতিক্রমী। কীভাবে এ শক্তি অর্জন করেছেন, তার উত্তর পাই তাজউদ্দীনের কাছ থেকেই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২০ ঘণ্টা কাজ করেছেন। এ কর্মনিষ্ঠা ও কর্মক্ষমতা দেখে একবার তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনি কোনো নেশা না করে কী করে রাত-দিন এমন খাটতে পারেন?’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমার দেশ, আমার দেশের জন্য কর্তব্যবোধ আমাকে শক্তি জোগায়।’

২০০৪ সালে বিবিসি রেডিওর বাংলা বিভাগ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শিরোনামে একটি জরিপ চালায়। সেখানে শ্রোতাদের ভোটে বঙ্গবন্ধু হন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। ওই জরিপে পর্যায়ক্রমে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ২০ জন বাঙালির নাম ঘোষিত হয়। কিন্তু এ ২০ জনের মধ্যে অনেকের নাম থাকলেও ঠাঁই হয়নি তাজউদ্দীন আহমদের। অথচ তিনি বাংলাদেশ যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সেই যুদ্ধকালীন সময়ের প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রামের দিনগুলোর প্রধান নায়ক। তার অসাধারণ ব্যবস্থাপনা দক্ষতা যুদ্ধকালে বাংলাদেশকে পথ দেখিয়েছিল।

আমরা বাংলাদেশের নবজাগরণকে এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। নবজাগরণের নায়কদের চিনে নিতে পারিনি। কেবল রাজনীতির মাঠে নয়, বুদ্ধির সমবায়ে যারা যুক্ত তারাও এ ব্যাপারে কি ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন? জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠায় বিকাশ ও নির্মাণে এসব প্রশ্ন নিয়ে তর্ক হওয়াটা জরুরি নয় কি?

ড. কাজল রশীদ শাহীন: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন