ডলার-বহির্ভূত বাণিজ্য ডলারকে ঘায়েল করতে পারবে কি?

সৈয়দ আবুল বাশার

কয়েক মাসের ডলার-বহির্ভূত বাণিজ্য বন্দোবস্তের কিছু খবর দিয়ে শুরু করি। প্রথমে রাশিয়া চীনের ইউয়ানকে তার প্রাথমিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং এ দুই দেশের বাণিজ্যিক লেনদেন এখন ইউয়ান-রুবলে সম্পন্ন হচ্ছে। বর্তমানে ইউয়ান রাশিয়ায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বাণিজ্যিক মুদ্রা হিসেবে গণ্য করা হয়। দ্বিতীয়ত, গত ৩১ মার্চ চীন ও ব্রাজিল ডলারকে এড়িয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা তাদের বাণিজ্যিক লেনদেনের জন্য পারস্পরিক মুদ্রা ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোকে অতিক্রম করে চাইনিজ ইউয়ান ব্রাজিলের দ্বিতীয় সর্বাধিক ব্যবহৃত বাণিজ্যিক মুদ্রা হয়ে উঠেছে।

তৃতীয়ত, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে চীন ও সৌদি আরব পরস্পরের মুদ্রা বিনিময়ে তাদের প্রথম লেনদেন শুরু করে। সৌদি আরব চাইনিজ ইউয়ানকে তাদের সরকারি রিজার্ভের অংশ হিসেবে ধরার প্রয়োজনীয়তা ঘোষণা করে। বর্তমানে সৌদি আরবের প্রতি বছরের ৩২৬ বিলিয়ন ডলারের তেল রফতানির ৮০ শতাংশই মার্কিন ডলারে নিষ্পত্তি হয়। তবে গত জানুয়ারিতে সৌদি আরবের অর্থমন্ত্রী দেশটির তেল রফতানির অংশটি ডলারমুক্ত মুদ্রায় নিষ্পত্তির পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। রাশিয়া সাম্প্রতিক সময়ে সেরা রফতানিকারক হওয়ার আগে সৌদি আরব চীনের অপরিশোধিত তেলের প্রধান সরবরাহকারী ছিল, যার প্রতি বছর মূল্য প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার। ভবিষ্যতের বছরগুলোয় জিসিসির (গালফ কো-অপারেটিভ কাউন্সিল) অন্য দেশগুলোরও একই পথ অনুসরণের সম্ভাবনা বেশি। এরই মধ্যে গত মার্চে চীন ইউয়ানে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির জন্য প্রথমবারের মতো লেনদেন সম্পন্ন করেছে। চতুর্থত, এ বছরের এপ্রিলে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী সংসদে বিবৃতি দেন যে ‘‌মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ডলারের ওপর নির্ভর থাকার দরকার নেই।’ তিনি ইউয়ানের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য নিষ্পত্তির পরিকল্পনা সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন।

এ সময়ের খবরগুলো দেখে মনে হচ্ছে যে মার্কিন ডলারের দিন দ্রুত সংকটে পড়ছে। এই ঈদের ছুটির সময় আমাকে ডলার সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। আজকের লেখা সাম্প্রতিক ডলার-সংক্রান্ত ঘটনাগুলোর ওপর ভিত্তি করে রচিত।

মার্কিন ডলারের প্রভাব অন্তত দুটি ধাপে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। প্রথমত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর জন্য সর্বাধিক প্রিয় এবং প্রভাবশালী রিজার্ভ মুদ্রা এখনো মার্কিন ডলার (এটিকে ডলারের ‘স্টক’ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে)। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেন পরিচালনার প্রাথমিক বাহক হিসেবে ডলারের ভূমিকা এখনো অনুপম (এটিকে ডলারের ‘ফ্লো বা প্রবাহ’ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে)। ডলারের প্রভাবের বিষয়টি বোঝার জন্য এই স্টক এবং ফ্লোর পার্থক্য বোঝা প্রয়োজন। আমরা জানি যে মুদ্রার তিনটি কার্যকারিতা রয়েছে, যার মধ্যে একটি হলো সঞ্চিত মূল্য, যা ইংরেজিতে ‘স্টোর অব ভ্যালু’ বলা হয়। রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলার এ ‘স্টোর অব ভ্যালু’ কার্যকারিতার প্রধান দায়িত্ব পালন করে। মুদ্রার দ্বিতীয় কার্যকারিতা হলো বিনিময়ের মাধ্যম বা ‘মিডিয়াম অব এক্সচেঞ্জ’, যা ডলারের ফ্লো সম্পর্কে আমাদের ধারণা প্রদান করে। মুদ্রার আরো একটি কার্যকারিতা হলো হিসাবের একক বা ‘ইউনিট অব অ্যাকাউন্ট’, যা আমরা বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বিনিময়ের হার বিমানবন্দরগুলোয় ডলারের বিপরীতে দেখতে পাই।

আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে গ্লোবাল রিজার্ভ মুদ্রায় ডলারের শেয়ার ৬৬ থেকে ৫৮ শতাংশে নেমে গেছে। কিন্তু তথ্যটি বিভ্রান্তিকর, কারণ পরিসংখ্যানটি নমিনাল। আমরা যেমন অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নমিনাল জিডিপির পরিবর্তে রিয়েল জিডিপি বিবেচনা করি, ঠিক তেমনি রিজার্ভ মুদ্রার স্টকের জন্য রিয়েল সংখ্যাটি বিবেচনা করা উচিত। ধরুন, একটি দেশের রিজার্ভ হলো ১০ বিলিয়ন ডলার। এখন বাজারে যদি ডলারের মূল্য অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়ে যায়, তাহলে আসলে কার্যকর রিজার্ভের পরিমাণ ১০ বিলিয়নের বেশি, কারণ ডলারের ক্রয়ক্ষমতা এখন বেশি। 

একইভাবে ডলারের মূল্য নিম্নে চলে যাওয়ার কারণে তার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। ডলারের বিনিময় হারের এ পরিবর্তন উপলব্ধি করতে না পারলে রিজার্ভের প্রকৃত চিত্র বোঝা সম্ভব হবে না। ইউরিজোন এসএলজে রিসার্চ, একটি লন্ডনভিত্তিক হেজ ফান্ড, তাদের এক সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখিয়েছে যে ২০০৩ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে গ্লোবাল রিজার্ভ মুদ্রায় ডলারের প্রকৃত শেয়ার ৬৬ থেকে ৫৫ শতাংশে হ্রাস পায়। শুধু ২০২২ সালে ডলারের শেয়ার দ্রুত নেমে গিয়ে ৪৭ শতাংশে পৌঁছেছে। এই এক বছরে ৮ শতাংশ হ্রাস পাওয়াটা অনেকটা ব্যতিক্রমী, যা আগে কখনো দেখা যায়নি।

বলা বাহুল্য, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। তবে ডলার শেয়ার হ্রাসের পেছনে আরেকটি দিক ছিল। কভিড মহামারীর পর ডলারের মূল্য বিশ্বের অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় ২০ শতাংশ বেড়ে যায়। এ সময়ে বিশ্বব্যাপী রিজার্ভ ম্যানেজাররা ডলার বিক্রির একটি আগ্রাসী মনোভাব অবলম্বন করেন, যা ডলার শেয়ার হ্রাসের আরেকটি প্রধান কারণ। একই সময়, ২০২২ সালের মধ্যে ইউরো মুদ্রার শেয়ার ৫ শতাংশ বেড়ে যায়, যা গত ২০ বছরে বিশ্বব্যাপী রিজার্ভ বাজার শেয়ারে ইউরোর ক্ষতি মুছে ফেলে। ২০২২ সালে পূর্ববর্তী বছরগুলোর গতি অনুসরণ করে চাইনিজ ইউয়ানের অংশ বৈশ্বিক রিজার্ভে বাড়তে থাকে, কিন্তু কোনো উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে এমনটি নয়। ২০ বছরে ডলার রিজার্ভ হোল্ডিংয়ে ১৯ শতাংশ হ্রাস পুষিয়ে নেয়ার পেছনে প্রধান মুদ্রাগুলো ছিল চাইনিজ ইউয়ান (+৩ শতাংশ), জাপানি ইয়েন (+৩ শতাংশ), ব্রিটিশ পাউন্ড (+৪ শতাংশ) এবং কানাডিয়ান ডলার (+৩ শতাংশ)। 

উল্লিখিত আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে বৈশ্বিক রিজার্ভে ডলারের প্রাধান্য আগের তুলনায় কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। কেউ কেন তাদের গাড়ি পার্কিং লটে পার্ক করবে যদি লটের মালিক কোনো যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই সিদ্ধান্ত নেয় কোন গাড়ি বাজেয়াপ্ত হবে কিংবা না হবে? যেভাবে আমেরিকা ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে রাশিয়ার ৩০০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেছে, সে প্রতিক্রিয়া হিসেবে কিছু দেশ আতঙ্কিত হয়ে তাদের ডলার রিজার্ভ কমানো শুরু করেছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ডলারের স্টক হ্রাস করা শুরু করেছে এবং সম্ভবত ভবিষ্যতে আরো কিছু হ্রাস হতে পারে।

এখন ডলারের দ্বিতীয় ব্যবহার অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং আর্থিক লেনদেন পরিচালনায় নজর দেয়া দরকার। প্রতি বছর বৈশ্বিক বাণিজ্যের মোট পরিমাণ ৩২ ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু প্রতিদিন আর্থিক লেনদেন, যেমন শেয়ার, বন্ড কেনাবেচা, হেজিং ইত্যাদির পরিমাণ ৭ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। এর অর্থ হলো, বৈশ্বিক ফরেন এক্সচেঞ্জ টার্নওভারের মাত্র ২ শতাংশ বাণিজ্যিক বন্দোবস্তের জন্য ব্যবহার হয়, আর বাকি ৯৮ শতাংশ আর্থিক লেনদেনের কাজে ব্যবহার হয়। আর এ বিশাল আর্থিক লেনদেনে ডলার প্রায় ৮৫ শতাংশ (২০০ শতাংশের মধ্যে, একটি মুদ্রা লেনদেনের দুই পাশে) নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, বৈশ্বিক আর্থিক লেনদেন বাণিজ্য লেনদেনের চেয়ে ৫০ গুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং ডলারের এ একচ্ছত্র আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো মুদ্রা এখনো নেই, এমনকি ইউরোও নয়। এর প্রধান কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বাজারের তারল্য এবং গভীরতা, যা পৃথিবীর উদ্বৃত্ত সঞ্চয় খুব সহজেই পুনর্ব্যবহার করতে পারে।

প্রায়ই বিশ্লেষক ও মন্তব্যকারীরা ডলারের রিজার্ভ এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা—এ দুটি ভূমিকার মধ্যে বিভ্রান্তি করে ফেলেন। যেহেতু আর্থিক লেনদেনে ডলারনির্ভরতা বাণিজ্য লেনদেনের চেয়ে অনেক গুণ বেশি, সুতরাং সাম্প্রতিক ডলার-বহির্ভূত বাণিজ্য কারবারি ডলারকে তেমন ঘায়েল করবে না। তবে যেদিন বিশ্বের অন্যান্য আর্থিক বাজারগুলো আকারে বাড়বে ও গুণমানের উন্নতি হবে এবং একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভুল নীতি বা এর দুর্বল অর্থনীতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত করবে, সেদিন থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে ডলারের প্রভুত্ব হ্রাস পাবে।

যদিও এ দুই প্রবণতা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তার পরও বিগত কয়েক বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু নীতিজনিত ভুল প্রত্যেকের চোখে পড়েছে। ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা অনুসারে ‘কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং’ নামে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের বাজারে বড় পরিমাণে ডলার ছাপাতে শুরু করে, ২০১৩ সালের ‘টেপারিং’ সংকট এবং করোনা-পরবর্তী সময়ে আশঙ্কাজনক সুদের হারের বাড়ানো, ‘ফ্রেন্ড-শোরিং’, ‘রি-শোরিং’ এবং ‘নিয়ার-শোরিং’ তকমা দিয়ে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সংঘাত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বজুড়ে প্রভাব কিছুটা হালকা করে দিয়েছে। 

যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নীতিগত ত্রুটি চালিয়ে যায় এবং নিজের ভুল না শুধরে অন্যদের ক্ষতিগ্রস্ত করার সংস্কৃতি পরিত্যাগ না করে, তাহলে সম্ভবত এমন একটি দিন আসবে যখন বিশ্বের বেশির ভাগ অংশ সক্রিয়ভাবে ডলারের ব্যবহার এড়ানোর চেষ্টা করবে। শেষ কথা হিসেবে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ডলার ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বাদ দেয়া সম্ভব নয়, কিন্তু যেভাবে বিনিয়োগকারীরা এরই মধ্যে ডলারের ব্যবহার না করার পক্ষে হাত উঠিয়েছেন, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়।

সৈয়দ আবুল বাশার: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন