মার্কিন উদ্যোগের একটি সফল রূপকল্প বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি

সাইফুল ইসলাম বাপ্পী

দেশের গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ১৯৭৬ সালে এক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চালায় মার্কিন সংস্থা ন্যাশনাল রুরাল ইলেক্ট্রিফিকেশন কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশন (এনআরইসিএ) ওই সমীক্ষার প্রতিবেদন সুপারিশের ভিত্তিতে পরের বছর স্থাপন করা হয় বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) পাইলট প্রকল্প হিসেবে ১৯৮০ সালের মধ্যে গড়ে তোলা হয় ১৩টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি (পবিস) এজন্য কারিগরি সহায়তা দেয় এনআরইসিএ। আর্থিক সহায়তা দেয় ইউএসএআইডি। তখন থেকে পর্যন্ত দেশের পল্লী এলাকায় বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অংশীদার দেশ হিসেবে বিবেচিত যুক্তরাষ্ট্র।

বর্তমানে দেশে ৬১ জেলার ৪৬২ উপজেলা শতভাগ বিদ্যুতায়িত হয়েছে। ৮০টি পবিসের মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছে বিআরইবি। পল্লী এলাকায় বিদ্যুৎ সেবার সম্প্রসারণ কার্যক্রমে এখন পর্যন্ত বিআরইবির বড় অংশীদার সহায়কের ভূমিকা রেখেছে এনআরইসিএ এবং ইউএসএআইডি। পবিসগুলো গড়ে তোলার পাশাপাশি বিআরইবির কার্যক্রমও পরিচালিত হয়েছে মূলত এনআরইসিএর মডেলে।

পূর্ব বাংলার প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলেছিল ১৯০১ সালে ঢাকার রাস্তায়। পরের সাত দশকে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বিতরণ ব্যবস্থার প্রসার হয়েছে খুবই সীমিত আকারে। সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল পুরোপুরি শহরাঞ্চলকেন্দ্রিক। গ্রামীণ এলাকা ছিল বিদ্যুৎ সেবার বাইরে। দেশের গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়টিতে মনোযোগ দেয়ার সুযোগ মেলে মূলত স্বাধীনতার পর।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের চ্যালেঞ্জ ছিল অনেক। রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো ব্যবস্থা ছিল সম্প্রসারণ কার্যক্রমের প্রতিকূলে। প্রান্তিক দুর্গম এলাকাগুলোয় সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছিল এক প্রকার অসম্ভব। অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের রুরাল ইলেক্ট্রিফিকেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আরইএ) (বর্তমানে রুরাল ইউটিলিটি সার্ভিস-আরইউএস) এনআরইসিএর সমবায়ভিত্তিক মডেলটিকেই বাংলাদেশে পল্লী অঞ্চলে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সম্প্রসারণের জন্য বেছে নেয়া হয়।

এনআরইসিএর মডেলটি যুক্তরাষ্ট্রের গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সম্প্রসারণে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। গত শতকের ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। ফ্রাংকলিন ডিলানো রুজভেল্ট তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। দেশটির গ্রামীণ এলাকার প্রায় ৯০ শতাংশ ঘরবাড়ি তখনো বিদ্যুৎ সেবার বাইরে। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে বিদ্যুতের আওতায় দ্রুত নিয়ে আসতে ১৯৩৩ সালে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের এক নির্বাহী আদেশে গঠন করা হয় আরইএ। শুরুতে বিনিয়োগের অভাবে আরইএর কার্যক্রমে তেমন একটা গতি আসছিল না। অবস্থায় ১৯৩৭ সালে ভোক্তামালিকানাধীন অলাভজনক সমবায়ের মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সম্প্রসারণের একটি মডেল গ্রহণ করা হয়। ১৯৪২ সালে ধরনের গ্রামীণ বিদ্যুৎ সমিতিগুলো একযোগে গঠন করে এনআরইসিএ। বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল পেরিয়েও ১৯৫৩ সালের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ৯০ শতাংশেরও বেশি গ্রামীণ খামারকে বিদ্যুৎ সেবার আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয় সমিতিগুলো।

বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকাগুলোয় বিদ্যুৎ সম্প্রসারণ হয়েছে ঠিক একই মডেলে। স্বাধীনতার পর দেশে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল পুরোপুরি শহর এলাকাকেন্দ্রিক। দেশের গ্রামীণ জনপদে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা নিয়ে এনআরইসিএ ইন্টারন্যাশনালের ১৯৭৬ সালের সমীক্ষার সুপারিশে বলা হয়, নির্ভরযোগ্য সাশ্রয়ী বিদ্যুতের সরবরাহ বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় সেচ, উন্নততর শিক্ষা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং জীবনমান উন্নয়নে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবে। ওই সমীক্ষার সুপারিশের ভিত্তিতেই স্থাপন করা হয় বিআরইবি।

বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরইবির সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) অঞ্জন কান্তি দাস বণিক বার্তাকে বলেন, মার্কিন সংস্থা এনআরইসিএ মূলত দেশটির বিদ্যুৎ খাতের সহযোগিতামূলক প্রতিষ্ঠান। তাদের মডেলেই বিআরইবি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সংস্থাটির কাজ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করা। সংস্থাটির রাজস্ব আয়ের ভিত্তিকে অনুসরণ করে বিআরইবি ২০১২ সাল পর্যন্ত পল্লী এলাকায় বিদ্যুতায়নের কাজ করেছে। এরপর শতভাগ বিদ্যুতায়নে সরকার যখন বিভিন্ন প্রকল্প বরাদ্দ দিয়েছে, বিআরইবি তখন রাজস্ব আয়ভিত্তিক বিদ্যুতায়ন থেকে সরে গেছে। এনআরইসিএর মডেল অনুসরণ করেই বিআরইবি আজকের পর্যায়ে এসেছে। পল্লী অঞ্চলে বিদ্যুতায়নের ক্ষেত্রে মডেলটি বিআরইবির বৃহদায়তন বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।

বিআরইবি গঠন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এক অধ্যাদেশ জারি করা হয় ১৯৭৭ সালে। পাইলট প্রকল্প আকারে সমিতি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯৮০ সালের মধ্যে গঠন করা হয় ১৩টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। এজন্য স্থানীয় পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ-পরামর্শক তৈরির কাজেও সহায়তা করেছিল এনআরইসিএ। সে সময় পবিসগুলোর আওতায় গ্রামীণ গ্রাহকের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩ হাজার। বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলা উপকূলীয় কিছু দুর্গম এলাকা বাদ দিয়ে দেশের গ্রামীণ এলাকার প্রায় শতভাগ জনগোষ্ঠীই বিআরইবির বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার আওতায় এসেছে।

শুরুর ১৩টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির একটি ছিল সিরাজগঞ্জে। বর্তমানে এটি সিরাজগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি- নামে কার্যক্রম চালাচ্ছে। সমিতির সিনিয়র ম্যানেজার আবু আশরাফ মো. ছালেহ বণিক বার্তাকে বলেন, মার্কিন পল্লী বিদ্যুৎ সংস্থা এনআরইসিএর মডেল থেকেই দেশে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। সেবা কাজের ধরন এখন অনেকটা বদলালেও আমাদের গ্রাহক সংখ্যা বেড়েছে। সিরাজগঞ্জে আমাদের সমিতির আওতাধীন এলাকায় গ্রাহক সংখ্যা এখন লাখ ৪০ হাজার। সমিতির আওতাধীন এলাকার শতভাগই বিদ্যুতায়িত হয়েছে।

১৩টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কার্যক্রমে কারিগরি সহায়তা দিয়েছিল এনআরইসিএ। আর্থিক সহায়তায় ছিল ইউএসএআইডি। এমনই আরেক সমিতি যশোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১। সমিতির জেনারেল ম্যানেজার আবু বকর শিবলি বণিক বার্তাকে বলেন, সারা দেশে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি যখন চালু হয় তখন মার্কিন প্রতিষ্ঠান এনআরইসিএ পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছে। ওই সময় তারা কারিগরি সহায়তাসহ বাংলাদেশে কীভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে, সেসব বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছে। বিভিন্ন সময় ইউএসএআইডিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার সহায়তায় এসব সমিতি কার্যক্রম চালিয়েছে। আবার সরকারি তহবিল থেকেও আমাদের সহায়তা করা হয়েছে।

বিআরইবির তথ্য অনুযায়ী, যৌথ অংশীদারত্বের ভিত্তিতে গড়ে তোলা পবিসগুলোর সফলতা বিষয়টি নিয়ে বিদেশী অন্য দাতাদেরও আগ্রহী করে তোলে। পরে গড়ে তোলা ৬৭টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কার্যক্রমে এখন পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা করেছে ১৬টির বেশি সংস্থা। এছাড়া সিস্টেম ডিজাইন, সাবস্টেশন সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, বিআরইবি পবিসের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ এবং সংস্থা দুটির মধ্যে সমজাতীয় হিসাবরক্ষণ মানদণ্ড তৈরি, নীতিমালা গ্রহণ এবং ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের মাধ্যমেও বিআরইবিকে সহায়তা করেছে এনআরসিইএ। এছাড়া ইউএসএআইডির মাধ্যমে গৃহীত বিআরইবির নির্মাণ প্রকল্পগুলোয় প্রকৌশলী, লাইনম্যান, ব্যবস্থাপক লোকবল সরবরাহের মাধ্যমেও সহায়তা করেছে সংস্থাটি। এনআরইসিএ ইউএসএআইডির সঙ্গে সংস্থাটির অংশীদারত্ব এখন পর্যন্ত ব্যাপক সফলতা পেয়েছে।

এনআরইসিএ ইন্টারন্যাশনাল বিআরইবির কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে পর্যন্ত দেশের বিদ্যুৎ সেবার আওতাধীন পরিবারগুলোর গড় বার্ষিক আয় ২৫০ শতাংশ বেড়েছে বলে সংস্থাটির ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, বর্তমানে বিআরইবির ৩৯টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে গ্রামীণ এলাকার দ্রুতবর্ধনশীল জনগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের সক্ষমতা তৈরিতে সহায়তা দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের ভিত্তিতে রুরাল ইলেক্ট্রিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম প্রকল্পের মানোন্নয়ন কার্যক্রমে তদারকিতে যুক্ত হতে যাচ্ছে সংস্থাটি। এছাড়া ১১০টি সাবস্টেশন, ৩১টি সুইচিং স্টেশন, ৩২ সেট রিভার ক্রসিং টাওয়ারসহ নতুন লাইন নির্মাণ উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার কাজে যুক্ত হবে এনআরইসিএ ইন্টারন্যাশনাল।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন বণিক বার্তার যশোর প্রতিনিধি আবদুল কাদের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি অশোক ব্যানার্জী)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন