আলোকপাত

অর্থ পাচার: একটি সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ

কবি-সাহিত্যিকদের উক্তিতে বাঙালি আত্মঘাতী, বিশ্বাসঘাতক, অলস, ঘরকুনো ইত্যাদি নানা অপ্রিয় কথার উল্লেখ বারবার থাকলেও ‘‌বাঙালি দেশপ্রেমিক নয়’—এমন উক্তি হয়তো বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু সেই বাঙালি যখন শুধু নিজের পরিবারের সুখের জন্য দেশের অর্থ পাচার করে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে তখন বাঙালির ‘‌দেশপ্রেমিক’ গুণটায়ও ভাটা পড়ে। যদিও সবাই তা করছেন না, তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সুযোগ পেলে তল্পিতল্পা গুটিয়ে সবাই দেশ ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে? এ প্রশ্নের সরল উত্তর হচ্ছে, দেশটা এখন বেশির ভাগ মানুষের আস্থার মধ্যে নেই। এত কষ্টার্জিত স্বাধীনতা এবং এত উন্নতির পরও দেশটা কেন মানুষের আস্থার মধ্যে নেই তাও কি আশ্চর্যের নয়? বিষয়টি নিশ্চয় বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

১.

১৯৭১ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার অবজ্ঞার সুরে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে সরকারি ও বেসরকারি নানামুখী উদ্যোগে বাংলাদেশ অতি দ্রুত তলাযুক্ত ঝুড়িতে পরিণত হয়। পাশাপাশি অর্থনীতির আকার ক্রমে বড় হতে থাকে। কোনো দেশের অর্থনীতি বড় হওয়া মানে নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসারতা বৃদ্ধি পাওয়া। এসব কর্মকাণ্ডের মিথস্ক্রিয়ায় অর্থনীতিতে অর্থপ্রবাহসহ বিভিন্ন গতিশীলতা বা ঝাঁকুনি তৈরি হয়। সমাজে অর্থশালী বা ধনিক শ্রেণীর সংখ্যা বাড়ে। ফলে মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার চাহিদা, স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চাহিদা, উন্নত চিকিৎসার চাহিদা এবং সন্তানদের জন্য উন্নত শিক্ষার চাহিদাসহ উন্নত জীবনযাপনের জন্য নানামুখী চাহিদা বাড়ে। এ অবস্থায় অর্থনীতিকে সঠিকভাবে ধারণের জন্য সুশাসনের মাধ্যমে মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করা, সত্যিকার গণতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা, স্বাধীনভাবে মানুষের মতপ্রকাশের ব্যবস্থা করা, সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা এবং গুণগত মানের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের ব্যবস্থা, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ব্যবস্থা, খাদ্যের নিরাপত্তা, যানজট মোকাবেলা এবং মাটি, পানি ও বাতাসকে দূষণমুক্তসহ মানুষের উন্নত জীবনধারণের সব ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে অর্থনীতির আবরণ বা দেয়ালকে পুরু করে গড়ে তুলতে হয়। তা না করতে পারলে অর্থনীতির দেয়াল ক্রমে পাতলা হতে থাকে এবং একসময় ছিদ্র হয়ে বা তলা ফেটে নির্যাস বেরিয়ে যায়। অর্থাৎ অর্থনীতির আকার বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি দেশ যখন জনগণের এসব চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়, তখন বৈধ বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ সম্পদশালীরা বিদেশে পাচারে উদ্বুদ্ধ হয়। এক্ষেত্রে এগিয়ে থাকে শাসক শ্রেণী এবং তাদের মদদপুষ্ট আমলা, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবীসহ সব লুটেরা শ্রেণী। বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে এ ঘটনাই ঘটেছে। 

২.

প্রত্যেকটি মানুষ জীবনে অর্থাৎ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে ভ্রমণ সেই ভ্রমণে সফল হতে চায়। এ ভ্রমণে তার সফল হওয়া নির্ভর করে সফলতার সঠিক মর্ম উপলব্ধি করা এবং সেই সফলতা অর্জনের সঠিক রাস্তা বাছাইয়ের ওপর। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ সফলতার সঠিক অর্থ উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং সফলতা অর্জনেও সঠিক রাস্তা খুঁজে পায়নি। দেশের মানুষ সফলতাকে সম্পদ উপার্জন ও সেই সম্পদের প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। প্রকৃত সফলতার মধ্যে সম্পদ উপার্জন আছে, আছে সম্পদের প্রবৃদ্ধি অর্জনও। কিন্তু সে সম্পদ উপার্জন একদিকে যেমন করতে হবে নীতি-নৈতিকতা অর্থাৎ শৃঙ্খলা, সততা, আদর্শ, মানবতা এবং পারলৌকিকতার ভিত্তিতে। অন্যদিকে সে সম্পদে যেমন পরিবারের অংশ রয়েছে তেমনি আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও দেশবাসীরও অংশ রয়েছে। বর্তমান শিক্ষা, সামাজিক ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এ নীতি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। শিক্ষা, সামাজিক ও রাষ্ট্র কাঠামো সম্পদ উপার্জন, সম্পদের প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং নিজ খেয়ালখুশিমতো ভোগবাদিতাকেন্দ্রিক। নীতি-নৈতিকতা অর্থাৎ শৃঙ্খলা, সততা, আদর্শ, মানবতা ও পারলৌকিকতার স্থান দেশে কোথাও নেই। সেগুলো তো এখন সমাজে মধ্যযুগের উপাখ্যান হিসেবে বিবেচিত। তাই সুবিধাভোগী জনগণের বেশির ভাগই নীতি-নৈতিকহীনভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। এর ফলে একদিকে যেমন তাদের মধ্যে উন্নত জীবনের আশা জাগ্রত হচ্ছে, অন্যদিকে অবৈধ সম্পদ একটি নিরাপদ গন্তব্যে পাঠাতে চাচ্ছে। এক্ষেত্রে সুইস ব্যাংকের পাশাপাশি আমেরিকা, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়াসহ কিছু দেশ তাদের কাছে নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে স্থান পেয়েছে। এসব দেশও সুযোগ করে দিয়েছে যে বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনলে সেখানে থাকার অনুমতি পাওয়া যাবে। আর কানাডা আরেক ধাপ এগিয়ে। সেখানে বাড়ি কিনলে নাগরিকত্বও পাওয়া যায়। অন্যদিকে দেশে নিয়মনীতির কোনো বালাই নেই। চাইলেই হাজার হাজার কোটি ডলার বিদেশে পাচার করা যায়। কারণ শর্ষের মধ্যেই তো ভূত রয়েছে, যারা অর্থ পাচার ঠেকাবে তারাই তো অর্থ পাচারে ব্যস্ত। এ যেন চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। সবকিছু মিলিয়ে দেশদ্রোহীদের জন্য শাপেবর হয়েছে। দেশ যেন তাদের জন্য একটি নিজস্ব দুধেল গাইয়ে পরিণত হয়েছে। তাই সবটুকু দুধ দুয়ে বিদেশে পাচার করছে। 

৩.

মানুষের জীবনের তিনটি পর্যায়ের প্রথম অংশ নিজেকে গড়ে তোলার জন্য অর্থাৎ পড়ালেখা শেষ করে কাজে যোগদান পর্যন্ত যা বিশ্ব প্রেক্ষাপটে ২৫ বছর পর্যন্ত বিস্তৃত; দ্বিতীয় অংশ পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনের জন্য যা সাধারণত ৫০ বছর পর্যন্ত বিস্তৃত; এবং তৃতীয় অংশ সমাজ এবং দেশের জন্য যা জীবনের অবশিষ্ট সুস্থকালীন সময় পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে আমাদের দ্বিতীয় অংশ আর ৫০ বছরে সীমাবদ্ধ নেই। এটি বাড়তে বাড়তে জীবন সায়াহ্ন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ফলে আমাদের জীবনে তৃতীয় অংশের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। অন্যভাবে বলা যায়, আমাদের জীবনে আর সমাজ এবং দেশ ভাবনা বিরাজমান নয়। একটি কারণ হতে পারে আমাদের দেশে প্রথম অংশটি বেশির ভাগের ক্ষেত্রে ৩০-৩৫ বছর পর্যন্ত বিস্তৃত। উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতিসহ জীবনের প্রায় ৫-১০ বছর অহেতুক চলে যায় যার প্রভাব পড়ে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অংশের ওপর। বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর খুব কম দেশ আছে যেখানে চাকরির প্রস্তুতির জন্য জীবনের একটা লম্বা সময় ব্যয় করতে হয়। আর এটি পুষিয়ে নিতে সে সমাজ বা দেশের কথা বেমালুম ভুলে যায়। তাই বেশির ভাগ মানুষ ব্যস্ত শুধু নিজ পরিবার-পরিজন নিয়ে। আত্মীয়-স্বজন এমনকি নিজ ভাই-বোন এখন আমাদের চিন্তার মধ্যে নেই। পরিস্থিতি যখন এমন তখন মানুষ পরিবারের সর্বোচ্চ সুখের সন্ধান করে। আর সেই সুখের সন্ধানে অর্থ-বিত্তশালী মানুষরা বিদেশে নিরাপদ আশ্রয়ে তাদের পরিবার পাঠিয়ে দিচ্ছে। এ দলে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সরকারি চাকরিজীবী, ছাত্রনেতা, শিক্ষকসহ অনেকেই ভিড় করছে। তাছাড়া দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিচার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের আস্থা তলানিতে ঠেকার কারণে সচ্ছল পরিবারের অনেকেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য হচ্ছে।

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ: অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন