লন্ডনের অভিজাত এলাকায় প্রপার্টির শীর্ষ বিদেশী ক্রেতা বাংলাদেশীরাও

সাইফ বাপ্পী ও হাছান আদনান

লন্ডনের সবচেয়ে অভিজাত এলাকাগুলো স্থানীয়দের কাছে পরিচিত প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডন হিসেবে। গোটা লন্ডনে এসব এলাকায় প্রপার্টির দাম সবচেয়ে বেশি। বহুমূল্য এসব প্রপার্টির মালিকানাকে দেখা হয় অতিধনী ব্রিটিশদের আভিজাত্যের নমুনা হিসেবে। প্রপার্টি মূল্যের ভিত্তিতে প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনের পরিধি সংজ্ঞায় বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনভুক্ত এলাকাগুলো হলো নাইটসব্রিজ, মেফেয়ার, সাউথ কেনসিংটন, ওয়েস্ট ব্রম্পটন ইত্যাদি।

শুধু ব্রিটিশ নয়, বিশ্বের অন্যান্য স্থানের অতিধনীরাও এখন প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনে প্রপার্টি ক্রেতাদের অভিজাত তালিকায় নাম লেখাচ্ছেন। প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনের প্রপার্টি বাজারে বিদেশীদের অবদান এখন ৪০ শতাংশেরও বেশি। ধনাঢ্য এসব ক্রেতার জাতীয়তাভিত্তিক শীর্ষ তালিকায় আছেন বাংলাদেশীরাও। প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনের প্রপার্টি কেনায় জাপানি ধনীদের চেয়েও বেশি ব্যয় করেছেন তারা।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধনীদের বিনিয়োগ কোটায় অভিবাসনসংক্রান্ত সেবা দিচ্ছে লন্ডনভিত্তিক অ্যাস্টনস। সংস্থাটি সম্প্রতি ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনের বিভিন্ন এলাকার বিদেশী প্রপার্টি ক্রেতাদের জাতীয়তাভিত্তিক একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। ব্রিটিশ রিয়েল এস্টেট প্রপার্টি ব্যবস্থাপনা সংস্থা নাইট ফ্রাঙ্ক যুক্তরাজ্য সরকারের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তৈরি করা তালিকায় দেখা যায়, ২০২০ সালের প্রথম নয় মাসে প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনের বিদেশী প্রপার্টি ক্রেতাদের তালিকায় বাংলাদেশীদের অবস্থান ছিল নবম।

ওই নয় মাসে প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনে ৯৮টি লেনদেনের মাধ্যমে প্রায় ১২ কোটি ২৯ লাখ পাউন্ড মূল্যের প্রপার্টি কিনেছেন বাংলাদেশীরা। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এসব লেনদেনে গড় ব্যয় হয়েছে প্রায় ১২ লাখ পাউন্ড (প্রায় ১৫ কোটি ১২ লাখ টাকা)

বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল আবাসন এলাকাগুলোর অন্যতম লন্ডনের মেফেয়ার। বিলাসবহুল বাড়ি অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মেফেয়ার প্রপার্টিজের কাছ থেকে এখানে সম্প্রতি একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন এক বাংলাদেশী। দেশের বেসরকারি এক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যানের ছেলে তিনি।

মেফেয়ার এলাকার গ্রসভেনর স্কোয়ার এখন বিশ্বের বৃহৎ ধনকুবেরদের কাছেও অনেক ঈপ্সিত একটি জায়গা। গত কয়েক বছরে এখানে বাড়ি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন ডজন খানেক বাংলাদেশী। বাড়িগুলোর মতো তাদের বিলাসবহুল দামি গাড়িও ঈর্ষান্বিত করে তুলছে সেখানকার বাসিন্দা স্থানীয় বিদেশী ধনকুবেরদেরও।

চার দশকের বেশি সময় ধরে যুক্তরাজ্যে ব্যবসা করছেন বাংলাদেশী উদ্যোক্তা ইকবাল আহমেদ ওবিই। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত ব্যবসা রয়েছে তার। সিমার্ক পিএলসির চেয়ারম্যান প্রধান নির্বাহী ইকবাল আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, যুক্তরাজ্যের অভিজাত সব এলাকায় বাংলাদেশীদের বাড়ি কেনার সংবাদ আমরা প্রতিনিয়ত শুনছি। তবে কী প্রক্রিয়ায় বা কোন উৎসের টাকায় সেসব বাড়ি কেনা হচ্ছে, সেটি অজ্ঞাত। ১৯৭১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে আমি লন্ডনে এসেছি। চার দশকের বেশি সময় ধরে দেশে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছি। কিন্তু কখনো ওইসব অভিজাত এলাকায় বাড়ি কেনার কথা ভাবিনি।

ইকবাল আহমেদ বলেন, যুক্তরাজ্যে মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচার আইন খুবই কঠোর। দেশে একটি ব্যাংক হিসাব চালু করতে হলেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। কিন্তু কীভাবে বাংলাদেশীরা যুক্তরাজ্যে সম্পদ এনে বাড়ি বা সম্পত্তি কিনছেন সেটিও একটি বিস্ময়। এখানেও কিছু মধ্যস্থতাকারী বা দালাল আছে, যারা বিভিন্ন দেশ থেকে সম্পদ পাচারের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান দ্য সেন্টার ফর পাবলিক ডাটার পর্যবেক্ষণ হলো প্রপার্টি বাজারে সম্পত্তির মূল্যবৃদ্ধির বড় একটি কারণ বিদেশী ক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি। সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০১০ সালের পর দেশটিতে বিদেশের ঠিকানায় নিবন্ধিত প্রপার্টির সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এর তিন-চতুর্থাংশই মূলত ২০টি দেশ অঞ্চলের ঠিকানা ব্যবহার করে নিবন্ধিত। ২০ অঞ্চলের মধ্যে আবার জার্সি, গার্নসে, আইল অব মান ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের মতো ব্রিটিশরাজ শাসিত অঞ্চলের আধিপত্য বেশি দেখা যায়।

প্রসঙ্গত, ব্রিটিশরাজ শাসিত এসব অঞ্চল আবার গোটা বিশ্বেই সম্পদ পাচারকারীদের বেনামে অফশোর প্রপার্টি কেনার জন্য স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত।

গত এক যুগে যুক্তরাজ্যের গোটা প্রপার্টি বাজারেই বাংলাদেশীদের উপস্থিতি বেশ জোরালো হয়েছে। তালিকায় অফশোর প্রপার্টি হিসেবে বেনামে নিবন্ধিত সম্পত্তির পাশাপাশি বাংলাদেশের ঠিকানায় নিবন্ধনকৃত প্রপার্টিও রয়েছে অনেক। ব্রিটিশ সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০ সালের জানুয়ারিতেও যুক্তরাজ্যের আবাসন খাতে সম্পত্তি মালিকের বাংলাদেশের ঠিকানা ব্যবহার করে নিবন্ধিত প্রপার্টির সংখ্যা ছিল ১৫। ছয় বছরের মাথায় ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২-তে। এর পাঁচ বছর পরে ২০২১ সালের আগস্টে সংখ্যা দাঁড়ায় দ্বিগুণেরও বেশিতেমোট ১০৭।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগকারী কোটায় অনেকেই পাড়ি দিয়েছেন যুক্তরাজ্যে। টিয়ার- ইনভেস্টর শ্রেণীতে ২০ লাখ পাউন্ড বিনিয়োগ করলেই যুক্তরাজ্যে পাঁচ বছর থাকার অনুমতি পেতেন বিদেশীরা। এরপর তারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসেরও আবেদন করতে পারতেন। দুই বা তিন বছরের মধ্যেই স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পেতে হলে বিনিয়োগ করতে হতো যথাক্রমে কোটি ৫০ লাখ পাউন্ড। তবে গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ধরনের ভিসা দেয়া বন্ধ করে দেয় ব্রিটিশ সরকার। যদিও ইনোভেটর ভিসা স্কেল-আপ ভিসা ক্যাটাগরিতে বিনিয়োগভিত্তিক অভিবাসনের সুযোগ এখনো রয়ে গেছে। ধরনের ক্যাটাগরিতে যুক্তরাজ্যে যাওয়া ব্যক্তিরাই প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনের অভিজাত এলাকাগুলোয় প্রপার্টির বড় ক্রেতা বলে সেখানে বসবাসরত অভিবাসী বাংলাদেশীরা জানিয়েছেন।

লন্ডনসহ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় অন্তত অর্ধশত বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী ব্যাংকারের বাড়ি কেনার সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে বণিক বার্তা। এর মধ্যে সাবেক বর্তমান হাইপ্রোফাইল রাজনীতিবিদ আমলার নামও রয়েছে। একটি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, এমনই এক হাইপ্রোফাইল রাজনীতিবিদের এখন যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় বাড়ি আছে এক ডজনেরও বেশি।

তালিকায় দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের সাবেক বর্তমান শীর্ষ নির্বাহীর পাশাপাশি রয়েছে ব্যাংকের মাঝারি স্তরের কর্মকর্তার নামও। অভিযোগ রয়েছে, পরিচালনা পর্ষদ বা মালিকপক্ষের যোগসাজশে ওইসব কর্মকর্তা ব্যাংকের অর্থ লুণ্ঠনের পথ সুগম করে দিচ্ছেন। এর বিনিময়ে ফুলেফেঁপে উঠছে তাদের অর্থবিত্ত।

এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়েছে। ঋণের নামে অর্থ লোপাটে ব্যবসায়ীদের সহযোগী ছিলেন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরাও। যুক্তরাজ্য ঢাকার একাধিক সূত্রের তথ্য বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অন্তত তিনজন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) যুক্তরাজ্যে বাড়ি রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ডজন খানেক সাবেক বর্তমান এমডির যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে প্রপার্টি রয়েছে। যুক্তরাজ্যে প্রপার্টি কিনেছেন বেসরকারি ব্যাংকের অনেক সাবেক বর্তমান চেয়ারম্যান-পরিচালকও।

তবে এদিক থেকে অন্যদের চেয়ে বেশ এগিয়ে তৈরি পোশাক খাতের বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা। খাতটির শতাধিক ব্যবসায়ীর লন্ডনসহ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় বাড়ি রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থে অতিধনীরা প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনসহ ব্রিটিশ বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় প্রপার্টি কিনে বিলাসবহুল জীবনযাপন করলেও সাধারণ অভিবাসী বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় এর বিপরীত চিত্র। বিশেষ করে কভিডের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর সেখানকার বাংলাদেশীসহ প্রচুরসংখ্যক বিদেশী অভিবাসী চরম দারিদ্র্যের মুখে পড়ে যান। কভিডের আগে থেকেই তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ শোচনীয় অবস্থায় দিনাতিপাত করছিলেন। জীবনধারণের মৌলিক উপকরণগুলো জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছিল তাদের। মহামারীর প্রাদুর্ভাব তাদের আরো নাজুক পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী অভিবাসীদের মধ্যে বেকারত্বের হারও স্থানীয়দের চেয়ে অনেক বেশি। ব্রিটিশ অনেক বাংলাদেশীকে তীব্র শীতের সময়ে গরম কাপড় সংগ্রহ করতেও হিমশিম খেতে হয়। আয়ের দিক থেকে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশীরা সম্পদ সঞ্চয়ের দিক থেকে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী ভারতীয়, পাকিস্তানি বা আফ্রিকানদের চেয়েও বেশ পিছিয়ে। বৈশ্বিক অর্থনীতির চলমান দুর্বিপাক, মূল্যস্ফীতি ইউরোপীয় জ্বালানি সংকট তাদের জীবনকে করে তুলেছে আরো দুর্দশাগ্রস্ত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন