রাজধানীর
উত্তরা থেকে
মিরপুর হয়ে
আগারগাঁও, সেখান
থেকে ফার্মগেট-শাহবাগ
হয়ে মতিঝিল-কমলাপুর
রুটে গড়ে
উঠছে দেশের
প্রথম মেট্রো।
এর মধ্যে
আগামীকাল থেকে
শুরু হবে
উত্তরা-মিরপুর-আগারগাঁও
অংশে মেট্রোর
বাণিজ্যিক চলাচল।
যদিও শুরুর
পরিকল্পনায় মেট্রোর
এই রুটটি
ছিল ভিন্ন।
আগারগাঁও থেকে
সেটি বিজয়
সরণি দিয়ে
ঘুরিয়ে ফার্মগেটে
আনার পরিকল্পনা
হয়েছিল। আবার
শাহবাগ থেকে
কেন্দ্রীয় শহীদ
মিনার হয়ে
মেট্রোটি শেষ
হওয়ার কথা
ছিল সায়েদাবাদে।
জাইকা ও
বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের
পরামর্শে এবং
গতিপথে থাকা
বিভিন্ন সংস্থা
ও সাধারণ
মানুষের মতামত
নিয়ে চূড়ান্ত
করা হয়
মেট্রোর বর্তমান
রুট। এজন্য
একাধিকবার গতিপথ
বদলাতে হয়েছে
নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষ
ঢাকা ম্যাস
ট্রানজিট কোম্পানি
লিমিটেডকে (ডিএমটিসিএল)।
ঢাকা ও রাজধানীর উপকণ্ঠের জন্য প্রণীত ২০ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার সুপারিশের ভিত্তিতে প্রথমে উত্তরা, মিরপুর-১০, ফার্মগেট, শাহবাগ, পলাশী, কাপ্তানবাজার, সায়েদাবাদ—রুটটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। মেট্রোর এ গতিপথটি নিয়ে প্রথম বিপত্তি তৈরি করে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার। এ উড়ালসড়কের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যাওয়ায় প্রথম মেট্রোটির গতিপথ বদলানোর প্রস্তাব দেয় তত্কালীন ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ড (ডিটিসিবি)। অন্যদিকে প্রস্তাবিত রুটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শহীদ মিনার ও মেয়েদের একটি হল থাকায় কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের সামনে থেকে এটি পরিবর্তন করে টিএসসি-দোয়েল চত্বর হয়ে প্রেস ক্লাবের সামনে দিয়ে মতিঝিল পর্যন্ত নেয়া হয়। যদিও রুট পরিবর্তনের এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা আপত্তি তোলেন। ঢাবির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও শিক্ষার পরিবেশ রক্ষায় ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে নেয়া মেট্রোরেলের রুটটি পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের যুক্তি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে মেট্রোরেল হলে তিন জাতীয় নেতার মাজার, ঢাকা গেট, বাংলা একাডেমির কিছু অংশ, রাজু ভাস্কর্যের মতো ঐতিহ্যগুলো বিনষ্ট হবে। একই সঙ্গে শব্দদূষণের কারণে ব্যাহত হবে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ।
অন্যদিকে
বিজয় সরণি
অংশে মেট্রোরেল
নির্মাণের ব্যাপারে
আপত্তি জানায়
বিমান বাহিনী।
২০১১ সালের
৭ জুন
তত্কালীন যোগাযোগ
মন্ত্রণালয়ে পাঠানো
এক চিঠিতে
মেট্রোরেলের প্রস্তাবিত
রুটের বিজয়
সরণি অংশ
বাদ দেয়ার
পক্ষে বিভিন্ন
যুক্তি তুলে
ধরে তারা।
ওই চিঠিতে
বলা হয়,
তেজগাঁও বিমানবন্দর
থেকে বাংলাদেশ
বিমান বাহিনী
ও বাংলাদেশ
সেনাবাহিনী যৌথভাবে
সব ধরনের
হেলিকপ্টার, হালকা
প্রশিক্ষণ বিমান,
হালকা জেট
বিমান ও
পরিবহন বিমান
পরিচালনা করে।
এয়ারফিল্ডটি জরুরি
অবস্থায় প্রয়োজন
অনুযায়ী জঙ্গিবিমান
পরিচালনার জন্যও
প্রস্তুত রাখা
হয়। তাই
প্রতিরক্ষার দিক
থেকে এ
এয়ারফিল্ডের কৌশলগত
গুরুত্ব অপরিসীম।
রাজধানী ঢাকার
প্রতিরক্ষার জন্য
এ এয়ারফিল্ডের
সুষ্ঠু সংরক্ষণ
ও ব্যবস্থাপনা
জরুরি। মেট্রোরেল
বিজয় সরণি
দিয়ে নির্মিত
হলে তেজগাঁও
এয়ারফিল্ড থেকে
ফ্লাইট পরিচালনা
মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত
হতে পারে।
ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলটি যখন পরিকল্পনা পর্যায়ে, তখন তত্কালীন ডিটিসিবির (বর্তমানে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ-ডিটিসিবি) নির্বাহী পরিচালক ছিলেন ড. সালেহ উদ্দিন। রুটটি চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রথম দিককার পরিকল্পনায় মেট্রোরেলের গতিপথ ছিল ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে। তখন সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমাদের একটা মিটিং হয়। তাদের পক্ষ থেকে বলা হলো—সেখানে তাদের একটা আবাসন প্রকল্প হবে। এজন্য আমরা এটাকে একটু পুব দিকে নিয়ে এখন যে লাইনটা, সেটা করেছি।’ তিনি বলেন, ‘পুরনো বিমানবন্দরের সামনে দিয়ে সেটা যাওয়ার কথা ছিল ফার্মগেটের দিকে। তাতে বিমানবাহিনী একটা আপত্তি দিল। প্রধানমন্ত্রী সরাসরি আমাকে নির্দেশনা দিলেন, যাতে আমি বিমান বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে মিটিং করি। বললেন, জনস্বার্থে এবং রাষ্ট্রের স্বার্থে যদি রুট পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে করতে হবে। তখন লাইনটা খামাড়বাড়ির দিকে আনা হয়। তবে সেদিকে যাওয়ার ফলে সংসদ ভবন এলাকায় কোনো জায়গা নেয়া হয়নি। আমার যতদূর মনে পড়ে, সেখানে গণপূর্ত আর সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কিছু জায়গা ছিল সেটা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়।’
পরবর্তী
বিপত্তির কথা
জানিয়ে ড.
সালেহ উদ্দিন
বলেন, ‘আবার
আমরা ধাক্কা
খেলাম কেন্দ্রীয়
শহীদ মিনার
এলাকায়। ওখানে
অনেকেই অবজেকশন
দিল। এটা
যুক্তিসংগতও ছিল।
তখন আমরা
টিএসসির সামনে
দিয়ে রুটটি
ঘুরিয়ে নিলাম।
সেখানেও বিপত্তি।
শেষমেশ বিশ্ববিদ্যালয়
কর্তৃপক্ষ, ছাত্রনেতাদের
সঙ্গে আমরা
একাধিক মিটিং
করি। তাদের
বোঝাতে সমর্থ
হই, রুটটা
সেদিক দিয়ে
গেলে বহু
শিক্ষার্থী উত্তরা
থেকে মেট্রোতে
ভ্রমণ করে
বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত
করতে পারবে।
আবার পিজির
(বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিব মেডিকেল
বিশ্ববিদ্যালয়) সামনেও
এলাম, তখন
অবজেকশন এল।
প্রাণগোপাল সাহেব
ছিলেন ভাইস
চ্যান্সেলার। তার
সঙ্গেও আমরা
মিটিং করি
এবং বোঝাতে
সক্ষম হই,
রুটটি সেদিক
দিয়ে গেলে
রোগীদের যাতায়াত
সহজ হয়ে
যাবে।’
মেট্রোরেলের
রুট পরিবর্তনের
বিভিন্ন কাজে
সম্পৃক্ত ছিলেন
পরিবহন বিশেষজ্ঞ
ও বাংলাদেশ
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধ্যাপক ড.
সামছুল হক।
এ সম্পর্কে
জানতে চাইলে
তিনি বণিক বার্তাকে বলেন,
‘মেট্রোটির
গতিপথ ঠিক
করার জন্য
আমরা দুইবার
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে
দেখা করি।
সে সময়
বারবার গতিপথ
বদলানোর কারণে
জাইকার প্রতিনিধিরা
বেশ বিরক্ত
ছিলেন। তাদের
আস্থাও কমে
যাচ্ছিল। সে
সময় বিজয়
সরণিতে মেট্রোর
গতিপথ নিয়ে
আপত্তি জানিয়েছিল
বিমান বাহিনী।
আমরা অবশ্য
চেয়েছিলাম বিজয়
সরণি দিয়েই
আসতে। কিন্তু
বিমান বাহিনীর
আপত্তির মুখে
সেটা শেষ
পর্যন্ত করা
সম্ভব হলো
না। এরপর
আবার সায়েদাবাদ
থেকে সরিয়ে
রুট মতিঝিলে
নেয়া হয়।’
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ২০১৯ সালে মেট্রোরেলের লাইনটি মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ডিএমটিসিএল। এ সম্পর্কে কর্মকর্তারা জানান, প্রথমে রুটটির সঙ্গে কমলাপুরের কোনো সংযোগ ছিল না। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিপুলসংখ্যক যাত্রী কমলাপুরে নামেন। সেখান থেকে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বাস বা সিএনজিই প্রধান ভরসা যাত্রীদের, যা অনেক সময়ই প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকে। ফলে কমলাপুরে নেমে যাত্রীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেলটি কমলাপুর পর্যন্ত নিয়ে গেলে স্টেশনে আসা যাত্রীদের একটা বড় অংশ সেটি ব্যবহার করতে পারবেন। ঢাকার পরিকল্পনাধীন মেট্রো রুটগুলোর মধ্যে ৬ নম্বর রুটটির (এমআরটি লাইন-৬) বাণিজ্যিক সম্ভাবনা এবং রাজধানীবাসীর জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক ড. সামছুল হক।