আলোকপাত

ডিজিটাল বাংলাদেশে ডিজিটাল লেনদেন ক্রেতা-বিক্রেতার বোঝা!

ড. সৈয়দ আবুল বাশার

ব্যাপারটা একবার ভেবে দেখুন। আপনি ১০ লাখ টাকা নিয়ে রাস্তাঘাটে কি স্বস্তিতে চলাফেরা করতে পারবেনকিন্তু ১০ লাখ টাকার সমতুল্য ডলার যা এখনকার বাজার দরে ১০ হাজার ডলারেরও কম, তা নিয়ে অনায়াসে আপনি যাতায়াত করতে পারবেন। ১০ হাজার ডলারে মাত্র ১০০টা শত ডলারের নোট থাকে, যা খুব কম জায়গা নেয় আপনার ব্যাগে, এমনকি আপনার পকেটেও রাখা যায় কোনো রকম দৃষ্টি আকর্ষণ ছাড়া। এখন চিন্তা করুন তাহলে অনায়াসে কত টাকার সমতুল্য ডলার আপনার বাসায় রাখা সম্ভব যা কিনা আপনার পরিবারের অন্য কেউ টেরও পাবে না। যারা অসৎ উপায়ে অনেক টাকা উপার্জন করেছে কিন্তু ব্যাংকে টাকা রাখতে ভয় পায় এবং হুন্ডি করে বিদেশে পাঠানোর সুযোগ নাই, তাদের জন্য ডলার মজুদ করার তাগিদ কতটা প্রবল।

এজন্যই আন্তর্জাতিক গ্যাংস্টার বা মাফিয়া চক্রের মাঝে ডলারের চাহিদা অনেক বেশি। এটা জেনেই ফেডারেল রিজার্ভ যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১০০ ডলারের চেয়ে বড় নোট বাজার থেকে উঠিয়ে নিয়েছে। ডলারের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে ইউরো এবং সুইস ফ্রাঙ্কের চাহিদাও অনেক বেশি, বিশেষ করে অর্থ পাচারকারীদের মধ্যে। কারণ এখনো বাজারে ইউরো ৫০০ এবং সুইস ফ্রাঙ্কের ১০০০ মানের নোট চালু আছে। বিষয়টির গুরুত্বারোপের জন্য একটা উদাহরণ দিই। আপনি ১০ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ১০০০ সুইস ফ্রাঙ্কে নোটে রূপান্তর করলে তার ওজন হবে মাত্র ১১ দশমিক কেজি, যা কিনা একটা ছোট স্যুটকেসে অনায়াসে নেয়া যাবে। আর ৫০০ ইউরোয় রূপান্তর করলে তার ওজন হবে ২০ দশমিক কেজি, যার জন্য দুটি ছোট স্যুটকেসই যথেষ্ট। কিন্তু ১০ মিলিয়ন ডলার ১০০ ডলার নোটে রাখলে তার ওজন হবে ১০০ কেজি, যার জন্য কমপক্ষে সাত-আটটি স্যুটকেস দরকার। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ডলারের একচেটিয়া চাহিদা, তাই একটু বিভ্রান্তিকর কারণ অনেক নগদ টাকা সহজেই ইউরো বা সুইস ফ্রাঙ্কে রূপান্তর করে রাখা যায়। হতে পারে আমাদের বাজারে দুটি বৈশ্বিক মুদ্রার সরবরাহ ডলারের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম।    

ডলারের কম জায়গা নেয়া সুবিধা ছাড়াও ডলার মজুদ করে রাখার পেছনে আরো বেশ কয়েকটি আকর্ষণ আছে। টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ালে মুনাফা হবে। তার চেয়েও বড় আকর্ষণ হলো টাকার বিপরীতে ডলারের দাম পড়ার আশঙ্কা খুবই কম। যেকোনো বিনিয়োগে যদি ডাউনসাইড (দাম কমার) ঝুঁকি কম থাকে তাহলে তার চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। আপনি ১১০ টাকা দিয়ে ডলার কিনলে তার দাম পড়ার আশঙ্কা (যেমন ১০০ অথবা ৯০ টাকা হওয়া) দৃশ্যত কম। মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক ঋণের চাপ বাড়লে টাকার মান কমে, কিন্তু ডলারের মান বাড়ে ছাড়া কমে না। আর ডলারের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা তো আছেই যেটা টাকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। মানুষ এখন আর্থিক হিসাব-নিকাশ শিক্ষা এবং ইন্টারনেটের বদৌলতে অনেকটা রপ্ত করে ফেলেছে। তারা অন্যদের পরামর্শের জন্য কৌতূহলী নয়।

গত ২৯ নভেম্বর বণিক বার্তার একটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নগদ অর্থের ব্যবহার আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। নগদে বেশি লেনদেন হলে সরকারের কর আদায় কম হয়, অপরাধ কার্যক্রম বৃদ্ধি পায় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির কার্যকারিতা হ্রাস পায় বিষয়গুলো আর নতুন করে বলার নেই। নব্বইয়ের দশকে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে জাপানে সবচেয়ে বেশি নগদে লেনদেন হতো। এর কারণ ছিল জাপানে সুদের হার একেবারে শূন্যের কাছে। তখন জাপানি অর্থনীতিবিদদের মধ্যে একটা ঠাট্টা ছিল যে জাপানে মুহূর্তে সবচেয়ে টেকসই পণ্য বিক্রি হলো লকার বা দেরাজ। খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে বাংলাদেশে হয়তো এখন নগদ অর্থের ব্যবহার বাড়ার পাশাপাশি লকারের বিক্রিও বেড়ে গেছে।

যদিও নগদের ওপর নির্ভরতার পেছনে বেশকিছু জিনিস কাজ করে যেমন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকা, হিসাববিহীন আয়, অর্থনীতিক বা রাজনৈতিক অস্থিরতা কিন্তু হতাশাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। সঞ্চয়ের সুদের হার যখন মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম, সীমিত আয়ের মানুষ হতাশ হয়ে তাদের জমা টাকা তুলে নিয়ে নগদ অর্থে বা অন্য কোনো খাতে রাখতে আগ্রহী হবে। সুদের হার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ছয়-নয় নির্ধারণের পরীক্ষাটি বড় ভুল ছিল। কারণ সঞ্চয়ের ওপর ভ্যাট, আগাম কর আর অন্যান্য সারচার্জ দেয়ার পর তেমন কিছুই থাকে না।

সুদের হার কমানোর আগে জরুরি হলো মূল্যস্ফীতির হার কমানো যেটা বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে একমাত্র জোগান বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্ভব। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির প্রধান উপাদান হলো খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা এবং যাতায়াত। কারণ খাতগুলোতেই আয়ের বেশি অংশ খরচ হয়। তাই উপাদানগুলোর সরবরাহ না বাড়লে দাম নাগালের মধ্যে আসবে না, আর যতদিন মূল্যস্ফীতি একটি সহনশীল অবস্থায় না আসবে, ততদিন সুদের হারও কমানো সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ভোক্তা মূল্যসূচকের বিভিন্ন উপাদানের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টির ওপর বিশেষ নজর দেয়া উচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পশ্চিম জার্মানি প্রায় পঙ্গু অবস্থা থেকে উন্নত অবস্থায় যাওয়ার পেছনে একটা বড় অর্থনৈতিক নীতি ছিল ভোক্তার বিভিন্ন উপাদানের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি কঠিন নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা। কয়েক দশক ধরে মূল্যস্ফীতি দক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্যই আজ ইউরোপিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হেডকোয়ার্টার জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে অবস্থিত হওয়ার একটি বড় কারণ।

নগদ লেনদেনের ওপর নির্ভরতা কমার জন্য পাবলিক পলিসি একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের দেশে অধিকাংশ লেনদেনের পরিমাণ খুব ছোট হয়ে থাকে যেমন ১০০-২০০ টাকার নিচে। যদিও ভোক্তারা মোবাইল পেমেন্টের মাধ্যমে এটি বিনা খরচে করতে পারে; কিন্তু বিক্রেতাদের প্রতিটি লেনদেনে পেমেন্ট সিস্টেমকে একটি ফি দিতে হয়। ডেবিট কার্ড-এর ক্ষেত্রেও বিক্রেতাদের ফি দিতে হয় প্রতিটি লেনদেনের জন্য। কারণে অনেক বিক্রেতা তাদের দোকানে এখনো মোবাইল, ডেবিট বা ক্রেডিট পেমেন্টের সুবিধা চালু করেনি। লক্ষ করলে দেখা যাবে, যখনই একজন ক্রেতা একটি ছোট পরিমাণের বিল ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করছেন, বিক্রেতার মুখে হাসি ফোটে না। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য ডিজিটাল পেমেন্ট অবলম্বন করা তাই অনেকটা বোঝা। এক্ষেত্রে সরকার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের ধরা যাক ৩০০ টাকার নিচে মার্চেন্ট ফির চর্চা বাদ দিতে পারে। যদিও মোবাইল পেমেন্ট সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপারে আপত্তি করতে পারে কিন্তু ডিজিটাল পেমেন্টের ব্যাপক ব্যবহারের স্বার্থে পরামর্শটি ভাবা যেতে পারে। এছাড়াও সরকার নগদ লেনদেনের একটি সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দিতে পারে, যেমন ১০ হাজার বা ২০ হাজার টাকার আইটেম নগদে কেনা যাবে না। উপরন্তু সরকার তার সব রকম সেবা ডিজিটাল পেমেন্টের আওতায় আনতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, রেলপথের টিকিট ডিজিটাল পেমেন্টের আওতায় আনা ইত্যাদি।

যেটা দিয়ে শুরু করেছিলাম সেটা দিয়ে শেষ করি। ডলার সংকট এড়াতে রফতানি আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রবাসী রেমিট্যান্স প্রবাহ একটি বড় ভূমিকা রাখে। যেখানে দেশের অর্থনীতির ৮০ ভাগের বেশি অনানুষ্ঠানিক (ইনফরমাল) সেখানে হুন্ডির হাত থেকে রেহাই পাওয়া দুষ্কর। তার চেয়ে এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়া উচিত, যা হুন্ডি ব্যবসায়ীদের জন্য মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। যদি বিদ্যমান দশমিক শতাংশ প্রণোদনায় কাজ না হয় তাহলে ভাবা উচিত ১০ শতাংশ প্রণোদনায় অনাবাসী শ্রমিকরা প্রণোদিত হবে কিনা। মোদ্দা কথা হলো রকম একটা সংখ্যা নির্ধারণ করা, যা কিনা হুন্ডি মাধ্যমকে কিছু মাত্রায় হলেও অনাকর্ষণীয় করে ফেলবে, কিন্তু একক প্রণোদনা পর্যাপ্ত না, এর সঙ্গে আরো কিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে যেমন রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের গৃহায়ণ অর্থায়নের সুবিধা এবং রিওয়ার্ড কার্ডের সুবিধা চালু করা, যা দিয়ে অনাবাসী শ্রমিকরা সরকারের বিভিন্ন সেবা যেমন পাসপোর্ট নবায়ন, বিমানবন্দরে লাউঞ্জ ইত্যাদিতে ভিআইপি সুবিধা ভোগ করতে পারবে। এর সঙ্গে সঙ্গে অনাবাসী শ্রমিক পরিবারদের একটা ডাটাবেজ তৈরি করে তাদের সরকারি যেকোনো সেবা গ্রহণের একটি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা যেতে পারে। রকম বেশ কয়েকটি অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ একসঙ্গে নিলে হয়তো হুন্ডি মাধ্যমকে ঘায়েল করা যাবে।

গত এক দশকের বেশি সময় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ এত ডলার ছাপিয়েছে যে বৈশ্বিক বাজারে ডলারের অভাব হওয়ার কথা না। বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ ভালো হলে বৈদেশিক বিনিয়োগ এসে ভিড় জমত আর দেশ ডলার এবং উন্নয়ন দুটিই পেত। দেরি করে হলেও মোদি সরকার বেশ কয়েকটি সরবরাহ-পার্শ্ব সংস্কার (সাপ্লাই-সাইড রিফর্ম) বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। ২০২১-২২ সালের ইন্ডিয়ান ইকোনমিক সার্ভের প্রথম অধ্যায়ে এর ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। এরই মধ্যে সংস্কারগুলো দেশীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে বিদেশী বিনিয়োগও আগের চেয়ে বেশি এসেছে। যখন শুনি তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি অথবা অ্যাপল তার প্রযুক্তির একটা অংশ ভারতে বিনিয়োগ করবে তখন মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। নিজের দেশকে এগিয়ে নিতে আমাদের মনোনিবেশ এবং সংকল্পকে আরো জোরদার করতে হবে।

 

. সৈয়দ আবুল বাশার: অর্থনীতির অধ্যাপক, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন