অব্যবহৃত সক্ষমতা সত্ত্বেও সম্প্রসারণে যাচ্ছে সিমেন্ট খাত

মেহেদী হাসান রাহাত

তিন দশক আগেও দেশের সিমেন্ট খাত ছিল আমদানিনির্ভর। তবে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা সিমেন্ট ব্যবসায় প্রবেশের পর পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যায়। আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে বর্তমানে সিমেন্ট রফতানিকারক হিসেবে নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। অবশ্য বর্তমানে দেশে সিমেন্টের চাহিদার তুলনায় কোম্পানিগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বেশি। এতে অর্ধেকের বেশি সক্ষমতাই অব্যবহৃত থাকছে। অবস্থায়ও সিমেন্ট উৎপাদকদের কেউ কেউ বড় আকারে ব্যবসা সম্প্রসারণের দিকে যাচ্ছেন। মূলত বিদ্যমান চাহিদার পাশাপাশি ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে বাজার অংশগ্রহণ বাড়াতে কৌশল নিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে ৩৪টি সিমেন্ট কোম্পানির কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সব মিলিয়ে এসব কোম্পানির বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা কোটি ৫০ লাখ টন। এর মধ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে চার কোটি টন। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি সক্ষমতাই অব্যবহৃত থাকছে। ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে সিমেন্ট খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে তিন গুণের মতো।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত সরকারের অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোকে কেন্দ্র করেই খাতের উদ্যোক্তারা নিজেদের সক্ষমতা বাড়িয়েছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সিমেন্ট জোগানের মাধ্যমে খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো ব্যবসা করেছে। নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর পদ্মা সেতুর মাধ্যমে ২১ জেলার মধ্যে যে সংযোগ তৈরি হবে তার প্রভাবে সিমেন্টের চাহিদা বাড়ার প্রক্ষেপণ ছিল তাদের। তাছাড়া পদ্মা সেতুর সঙ্গে মোংলা পায়রা বন্দরের মাধ্যমে সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রত্যাশিত গতিও সিমেন্টের ব্যবহার বাড়াবে বলে প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু কাঁচামালের ঊর্ধ্বমুখী দাম জাহাজীকরণ ব্যয় বৃদ্ধি খাতের ব্যবসায় মুনাফা মার্জিনের ওপর বেশ চাপ তৈরি করেছে। তার ওপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি তেলের দামে উল্লম্ফন এবং ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তাদের আরো বিপাকে ফেলে দিয়েছে। এর ওপর কৃচ্ছ্রসাধন উদ্যোগের অংশ হিসেবে অতি প্রয়োজনীয় ছাড়া অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি বেসরকারি ব্যক্তি খাতেও সিমেন্টের ব্যবহার কমেছে।

অবস্থায়ও সিমেন্ট উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছেন। গত মাসে ক্রাউন সিমেন্টের ষষ্ঠ ইউনিট নির্মাণে কোটি ৫০ লাখ ডলার ঋণ দেয়ার কথা জানিয়েছে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি অব বাংলাদেশ (ইডকল) মুন্সিগঞ্জে সিমেন্ট গ্রাইন্ডিং কারখানা নির্মাণে মোট ব্যয় হবে কোটি ডলার। এর ৭০ শতাংশের জোগান আসবে ঋণের মাধ্যমে। আগামী বছরের শেষের দিকে কারখানাটি উৎপাদনে আসার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে। বর্তমানে ক্রাউন সিমেন্টে বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৪০ লাখ ১৫ হাজার টন। নতুন ইউনিট নির্মাণ শেষে বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে ৬৫ লাখ ৭০ হাজার টনে। ২০১৯ সালেই যষ্ঠ ইউনিট নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল ক্রাউন সিমেন্ট। তবে কভিডের কারণে পরিকল্পনা পিছিয়ে যায়। গত বছর নতুন করে আবারো এটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয় কোম্পানিটি।

বিষয়ে জানতে চাইলে ক্রাউন সিমেন্টের উপদেষ্টা মাসুদ খান বণিক বার্তাকে বলেন, বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে এটি ঠিক। কিন্তু বর্তমানে কাঁচামালের দাম অনেকটাই কমে এসেছে। ডলারের দামে অস্থিরতাও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আশা করছি সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতির আরো উন্নতি হবে। তাছাড়া বাজারে আমাদের পণ্যের চাহিদাও রয়েছে। এমনও হয়েছে যে সক্ষমতা না থাকার কারণে চাহিদা সত্ত্বেও পণ্য দিতে পারিনি। বর্তমানে আমাদের ব্যবসায় যে প্রবৃদ্ধি রয়েছে সেটি অব্যাহত থাকলে সামনের দিনগুলোতে আমাদের সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। তাছাড়া ভবিষ্যৎ চাহিদার বিষয়টি তো রয়েছেই। সব মিলিয়েই কোম্পানি উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

সিমেন্ট খাতের বহুজাতিক কোম্পানি লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ গত মাসে নতুন সিমেন্ট বাজারে এনেছে। কোম্পানিটির বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতা ১১ লাখ টন। তবে দেশের বিদ্যমান চাহিদার তুলনায় এটি তেমন বেশি নয়। ভবিষ্যতে কোম্পানিটির ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির ভালো সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন এর কর্মকর্তারা।

সিমেন্ট খাতের আন্তর্জাতিক প্রকাশনা গ্লোবাল সিমেন্ট অতিরিক্ত সক্ষমতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর ব্যবসা সম্প্রসারণের বিষয়টি তুলে ধরেছে। তাদের প্রকাশনায় ক্রাউন সিমেন্টের নতুন কারখানা স্থাপন লাফার্জহোলসিমের নতুন সিমেন্ট বাজারে আনার কথা বলা হয়েছে। তারা বলছে, ভূরাজনীতি, জ্বালানির উচ্চমূল্য এবং স্থানীয় সমস্যার কারণে বাংলাদেশের সিমেন্ট উৎপাদকদের অবস্থা কঠিন করে তুলেছে। বর্তমান পরিস্থিতিকে বাজার মেনে নিলেও এক্ষেত্রে স্থানীয় সিমেন্টের দাম বনাম সরাসরি সিমেন্ট আমদানির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি ক্রাউন সিমেন্ট কিংবা লাফার্জহোলসিমকে দমাতে পারবে না বলেই মনে হচ্ছে। পরিস্থিতির সমাধান হিসেবে সিমেন্ট রফতানির কথা বলছেন উৎপাদকরা এবং বিসিএমএ সরকারকে বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শও দিয়েছে। তবে যেখানে দেশের সিমেন্ট খাতের ৯০ শতাংশ কাঁচামালই আমদানি করতে হয়, সেখানে এটি কোনো নিশ্চিত সমাধান নয় বলে মত দিয়েছে তারা।

দেশের পুঁজিবাজারে বর্তমানে সিমেন্ট খাতের সাতটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পাঁচটি কোম্পানি। এর মধ্যে আরামিট সিমেন্টের আয় সময়ে এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮৩ শতাংশ কমে কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি সময়ে কোম্পানিটির লোকসান শতাংশ বেড়ে কোটি ৯৬ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

কনফিডেন্স সিমেন্ট বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ৯০ কোটি টাকা আয় করেছে। যেখানে এর আগের বছরের একই সময়ে আয় ছিল ৭৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির আয় বেড়েছে ১৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অন্যদিকে সময়ে কোম্পানিটির মুনাফা ২৭ শতাংশ কমে ১৩ কোটি ১৭ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

বহুজাতিক সিমেন্ট উৎপাদক হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশের আয় বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ দশমিক ১২ শতাংশ বেড়ে ৩৪৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সময়ে কোম্পানিটির লোকসান ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ কমে কোটি ৬০ লাখ টাকা হয়েছে।

আরেক বহুজাতিক সিমেন্ট উৎপাদক লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ৫৭১ কোটি ৫০ লাখ টাকা আয় করেছে। যেখানে এর আগের বছরের একই সময়ে আয় ছিল ৪৬০ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির আয় বেড়েছে ২৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। এদিকে সময়ে কোম্পানিটির মুনাফা ২১ দশমিক ১৫ শতাংশ বেড়ে ১১৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

মেঘনা সিমেন্ট মিলসের আয় বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩০ দশমিক ৪৮ শতাংশ কমে ১৩৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সময়ে কোম্পানিটির মুনাফা ২৬ দশমিক শতাংশ কমে কোটি ২৫ লাখ টাকা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন