ঢাকার দুই সিটি

ল্যান্ডফিলের নির্গত তরলে বিষাক্ত কৃষিজমি জলাশয়

আল ফাতাহ মামুন

রাজধানীর আমিনবাজারের ল্যান্ডফিল থেকে নির্গত ভারী ধাতু ও পদার্থমিশ্রিত লিচেট ক্ষতিগ্রস্ত করছে পার্শ্ববর্তী কৃষিজমি ছবি: সালাহউদ্দিন আহমেদ

ঢাকার উত্তর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকাগুলো থেকে সংগৃহীত ময়লা প্রাথমিক সংগ্রহাগার থেকে নিয়ে জমা করা হয় মাতুয়াইল সাভারের আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে। যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনার অভাবে এসব বর্জ্য থেকে চুইয়ে পড়া তরল (লিচেট) গিয়ে মিশছে পার্শ্ববর্তী কৃষিজমিতে। লিচেটের ক্ষতিকর রাসায়নিকের প্রভাবে এসব কৃষিজমিতে উত্পন্ন ফসলও ব্যাপক মাত্রায় বিষাক্ত হয়ে উঠছে, বাড়াচ্ছে কৃষক ভোক্তার ক্যান্সারের ঝুঁকি।

পরিবেশবিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, পচনশীল কোনো বর্জ্য থেকে নিঃসৃত তরল বা বৃষ্টির পানি ল্যান্ডফিলের অন্যান্য বর্জ্যের সংস্পর্শে এসে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে পারে। তরল বা লিচেটে ভারী-হালকা ধাতুসহ নানা ধরনের রাসায়নিক মিশ্রিত থাকে। এজন্য বর্জ্য পরিশোধনের সময়ও নির্গত তরল যাতে কোনোভাবেই মাটি বা পানির সঙ্গে মিশতে না পারে, সেজন্য বিশেষ সতর্কতা ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হয়। এছাড়া বর্জ্য নির্গত তরলকেও আলাদাভাবে পরিশোধনের পরই ড্রেন বা নিষ্কাশন লাইনে ছাড়তে হয়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির অধীন এলাকাগুলো থেকে সংগৃহীত বর্জ্য নিয়ে জমা করা হচ্ছে মাতুয়াইলের ল্যান্ডফিলে। সাভার আমিনবাজারের ল্যান্ডফিলে জমা হচ্ছে উত্তর সিটির বর্জ্য। ল্যান্ডফিল দুটির কোনোটিতেই যথাযথভাবে লিচেট ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করা হচ্ছে না। দুটি ল্যান্ডফিলেই লিচেট সংরক্ষণের জন্য আলাদা গর্ত পাইপের ব্যবস্থা থাকলেও তা আদতে কাজ করে না বলে সংশ্লিষ্টরাও স্বীকার করেছেন। ফলে ল্যান্ডফিলে উত্পন্ন লিচেট অবাধেই মিশে যাচ্ছে সংলগ্ন কৃষিজমি জলাশয়ে। এতে এসব কৃষিজমি জলাশয়সহ সার্বিক প্রতিবেশই হয়ে পড়ছে বিষাক্ত। বাড়াচ্ছে কৃষক ভোক্তার ক্যান্সারসহ নানা দুরারোগ্য ব্যাধির ঝুঁকি।

দেশের বিদ্যমান ল্যান্ডফিলগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদা পারভীন। গত বছর প্রকাশিত তার এক গবেষণা প্রতিবেদনে ঢাকার দুই সিটির ল্যান্ডফিল সম্পর্কে বলা হয়, এগুলো থেকে নির্গত লিচেট পার্শ্ববর্তী কৃষিজমিতে ছড়িয়ে পড়ছে। ভারী ধাতু পদার্থমিশ্রিত এসব লিচেট কৃষিজমিতে মিশে ফসল আশপাশের গাছপালায়ও ছড়িয়ে পড়ছে। এসব ফসল থেকে উত্পন্ন খাবার মানবদেহে ক্যান্সারসহ প্রাণঘাতী নানা ব্যাধির ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

জানতে চাইলে অধ্যাপক ফাহমিদা পারভীন বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা গবেষণায় দেখিয়েছি কীভাবে লিচেট পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী লিচেট যেখানে জমা হবে তার তলদেশ ছিদ্রমুক্ত হবে। অর্থাৎ তলদেশ এমনভাবে ঢালাই দিতে হবে বা পলির আস্তর দিতে হবে যাতে কোনোভাবেই নির্গত তরল মাটির সঙ্গে না মেশে। লিচেট মাটির সঙ্গে মিশলে তা কৃষিজমি ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে মিশে যায়। আমরা গবেষণায় দেখেছি, পার্শ্ববর্তী কৃষিজমিতে বিপজ্জনক মাত্রায় ভারী ধাতু পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলো ফসল বৃক্ষে মিশে যাচ্ছে। এসব ফসল বা গাছের ফল কেউ যদি খায় তাহলে তার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক গুণ বেড়ে যায়।

এর আগেও ঢাকার ল্যান্ডফিল নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা হয়েছে। সেগুলোর প্রতিটিতেই দেখা গিয়েছে, ঢাকার ল্যান্ডফিল সংলগ্ন কৃষিজমিতে আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, ক্রোমিয়াম, কার্বন মনোক্সাইড, নিকেল, কপার, জিঙ্ক, আর্সেনিক, লেড, ক্যাডমিয়ামের মতো ক্ষতিকর ভারী ধাতুর উপস্থিতি অনেক বেশি।

ঢাকার দুই ল্যান্ডফিলের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ল্যান্ডফিল পরিচালনা করতে হলে শুধু বর্জ্য এনে জমা করা নয়, তা পরিশোধন এবং উত্পন্ন মিথেন গ্যাস লিচেট ব্যবস্থাপনার দিকেও মনোযোগ দিতে হয়। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কোনো ল্যান্ডফিলেই এসব ব্যবস্থাপনা দেখা যায় না।

দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন, ঢাকার ল্যান্ডফিলগুলো ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনায় চলছে। ল্যান্ডফিলগুলোয় আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুযোগ-সুবিধা নেই। বিশেষ করে মিথেন গ্যাস ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে না। এছাড়া লিচেট নির্গমনের জন্য পাইপ রাখা হলেও তা ত্রুটিপূর্ণ। ফলে তা সহজেই মাটিতে আশপাশের জলাশয়ে ছড়িয়ে যেতে পারছে।

প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিল সম্প্রসারণসহ ভূমি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক . মোহাম্মদ সফিউল্লাহ সিদ্দিক ভুঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা লিচেট ট্রিটমেন্ট করছি। কিন্তু সেটি যথার্থ হচ্ছে না। লিচেট ট্রিটমেন্টের জন্য দক্ষ জনবলের পাশাপাশি সক্ষমতাও বড় একটি সমস্যা। আমাদের পুরনো অংশের লিচেট পাইপ পুরোপুরি কার্যকর না। তাছাড়া ল্যান্ডফিল হয়ে গেলে সেখানে প্রতি ১০-১৫ ফুট পরপর নতুন করে লিচেট নেটওয়ার্ক নির্মাণ করতে হয়। সেখানেও আমাদের সক্ষমতার অভাব রয়েছে। আমাদের নতুন একটি প্রকল্প চলছে। এটি বাস্তবায়ন হলে আশা করি পরিবেশসম্মতভাবে লিচেট ট্রিটমেন্ট করতে সক্ষম হব।

একই অবস্থা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আমিন বাজার ল্যান্ডফিলেরও। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের লিচেট ট্রিটমেন্ট পাইপের অবস্থা ভালো নয়। তাছাড়া ল্যান্ডফিলটি বন্যাপ্রবণ এলাকায় হওয়ায় লিচেট দ্রুত কৃষিজমি আশপাশের পানির উৎসে মিশে যাচ্ছে।

ল্যান্ডফিলে উত্পন্ন লিচেট মানবস্বাস্থ্যের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যের জন্যও মারাত্মক হুমকি বলে মন্তব্য করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক . মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, আমাদের দেখা অনুযায়ী সুইডেন ল্যান্ডফিলের জন্য আদর্শ উদাহরণ। সেখানে ৪০ বছর মেয়াদি ল্যান্ডফিল নির্মাণ হয়। পুরো সময় ধরে ল্যান্ডফিল থেকে উত্পন্ন মিথেন গ্যাস লিচেট পরিবেশসম্মতভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয়। ঢাকায় প্রচুর বর্জ্য হয়। ভুল ব্যবস্থাপনার কারণে বর্জ্য আমাদের জন্য সম্ভাবনার না হয়ে এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাথমিক উৎস থেকেও বর্জ্যগুলো পৃথকভাবে সংগৃহীত হচ্ছে না। অনিয়মটা এখান থেকে শুরু হয়ে অপরিশোধিত লিচেট ডিসচার্জে এসে শেষ হয়। কাচের বোতল থেকে শুরু করে ব্যাটারি, খাবারসহ সব বর্জ্য একসঙ্গে ডাম্পিং হচ্ছে। ল্যান্ডফিলে যদি ব্যাটারির অ্যাসিড এসে জমা হয় আর সেটি যদি একসঙ্গে পরিশোধন করা হয়, তাহলে তো ব্যাটারির ভেতরের ক্ষতিকর ভারী পদার্থগুলো আশপাশে ছাড়াবেই। যেহেতু আমাদের সিটি করপোরেশনগুলো সঠিকভাবে লিচেট পরিশোধন করছে না, সেহেতু আশপাশের কৃষিজমি জলাশয় যে মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঝুঁকি কমাতে সিটি করপোরেশনকেই পদক্ষেপ নিতে হবে।  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন