ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের বেতন ১৮ হাজার টাকা!

সাইফ সুজন

হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন কাঠামোই নিম্নমানের। এর মধ্যে কিছু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতনের পরিমাণ খুবই প্রশ্নবিদ্ধ। এমনই একটি প্রতিষ্ঠান চুয়াডাঙ্গার ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এফসিইউবি) বিশ্ববিদ্যালয়টিতে একজন অধ্যাপককে মাসে বেতন দেয়া হচ্ছে মাত্র ১৮ হাজার টাকা করে। যদিও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের মাসিক বেতন-ভাতার পরিমাণ লাখ টাকার বেশি। আর শীর্ষস্থানীয় কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে হার পাঁচ লাখেরও বেশি।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) এক আকস্মিক পরিদর্শনে দুর্বল বেতন কাঠামোসহ এফসিইউবির বিভিন্ন অনিয়ম দুরবস্থার চিত্র উঠে এসেছে। কমিশনের পরিদর্শন প্রতিবেদন বলছে, এফসিইউবিতে অধ্যাপকদের ১৮ হাজার, সহযোগী অধ্যাপকদের ১০ থেকে ২৮ হাজার, সহকারী অধ্যাপকদের ২৩ থেকে ২৭ হাজার ৫০০ প্রভাষকদের থেকে ২৩ হাজার টাকা হারে মাসিক বেতন দেয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির গত বছরের অক্টোবরের বেতন বিবরণীর ভিত্তিতে ইউজিসির প্রতিবেদনে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো নেই। এমন কাঠামোতে কখনো কখনো অধ্যাপক একজন প্রভাষকের চেয়েও কম বেতন পান। তাছাড়া তাদের যে বেতন প্রদান করা হয়, তা বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী খুবই অপ্রতুল। তাই বাস্তবসম্মত বেতন কাঠামো নির্ধারণপূর্বক তা যথাযথ বাস্তবায়ন করে কমিশনকে অবহিত করতে একটি সুপারিশ এনেছে পরিদর্শক কমিটি।

বিশ্ববিদ্যালয়টির বেতন কাঠামোকে অমানবিক অপ্রত্যাশিত বলে মন্তব্য করেছেন ইউজিসির সদস্য পরিদর্শক কমিটির আহ্বায়ক . মো. আবু তাহের। বণিক বার্তাকে অধ্যাপক বলেন, যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষকের মূল বেতন ২২ হাজার টাকার বেশি। ভাতাসহ সেটি ৩০ হাজারের বেশি। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপককে ১৮ হাজার টাকা দেয়া বড় অসম্মানের কথা। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। শুধু বেতন কাঠামো নয়, বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিদর্শনকালে আয়-ব্যয়, সংরক্ষিত তহবিল, শিক্ষক নিয়োগসহ নানা অনিয়মের চিত্র পাওয়া যায়। আমরা পরিদর্শন প্রতিবেদনে এসব অনিয়ম বন্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রমে শৃঙ্খলা ফেরাতে বেশকিছু সুপারিশ করেছি।

জানা যায়, গত ১৩ অক্টোবর চুয়াডাঙ্গার একমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি আকস্মিক পরিদর্শনে যায় ইউজিসির একটি পরিদর্শক দল। বিশ্ববিদ্যালয়টির বিষয়ে উত্থাপিত বিভিন্ন ধরনের আর্থিক, প্রশাসনিক একাডেমিক অভিযোগ বিষয়ে মতামত প্রদানের জন্য ওই পরিদর্শক কমিটি গঠন করে কমিশন। পরিদর্শনে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন অনিয়মের প্রমাণও পাওয়া যায়, যা পরিদর্শন প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

ইউজিসির পরিদর্শন প্রতিবেদনটিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রকট শিক্ষক সংকটের চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছেবিশ্ববিদ্যালয়টিতে অনুমোদিত প্রোগ্রাম রয়েছে ১৪টি। এসব প্রোগ্রাম পরিচালনায় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পূর্ণকালীন শিক্ষক রয়েছেন ৩৩ জন। এর মধ্যে দুজন অধ্যাপক, তিনজন সহযোগী অধ্যাপক, চারজন সহকারী অধ্যাপক ২৪ জন প্রভাষক। এত স্বল্পসংখ্যক শিক্ষক দিয়ে কীভাবে এসব প্রোগ্রামের পাঠদান অন্যান্য শিক্ষাসম্পর্কিত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তা বোধগম্য নয়।

যদিও ইউজিসির নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি প্রোগ্রামে কমপক্ষে চারজন স্থায়ী শিক্ষক থাকতে হবে। এর মধ্যে একজন কমপক্ষে সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার হতে হবে। সে হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টির ১৪টি প্রোগ্রামের বিপরীতে কমপক্ষে ৫৬ জন শিক্ষক থাকার কথা। যার মধ্যে অন্তত ১৪ জন সহযোগী অধ্যাপক পদের।

বিশ্ববিদ্যালয়টির আয়-ব্যয়ের হিসাবের ক্ষেত্রেও আইন অমান্য করার প্রমাণ পেয়েছে কমিশন। বিষয়ে পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির ২০১৯-২০ ২০২০-২১ অর্থবছরের নিরীক্ষিত হিসাব পাওয়া যায়নি। আইন অনুযায়ী প্রতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে আগের বছরের আর্থিক হিসাব ইউজিসিতে জমা দিতে হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়-ব্যয়ের হিসাব বিষয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০- বলা হয়েছে, প্রত্যেক আর্থিক বছরের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আগের আর্থিক বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষিত তহবিল এবং সাধারণ তহবিলের হিসাব কমিশন সরকারের কাছে পাঠাতে হবে। প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি আর্থিক বছরের আয় ব্যয়ের হিসাব কমিশনের নির্ধারিত ফরমে তৈরি সংরক্ষণ করবে। উল্লিখিত হিসাব প্রতি আর্থিক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত বহিঃনিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানগুলোর (সিএ ফার্ম) মধ্যে থেকে সরকার মনোনীত একটি ফার্ম দ্বারা নিরীক্ষা করাতে হবে এবং নিরীক্ষা প্রতিবেদন পরবর্তী আর্থিক বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কমিশনে পাঠাতে হবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠাকালীন তহবিলের নির্ধারিত অর্থ এফডিআর করার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠার বেশ কয়েক বছর পর তা সম্পন্ন করা হয়েছে। এটিকেও আইনের লঙ্ঘন হিসেবে দেখছে কমিশন।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় অবকাঠামোর অবস্থাও খুবই নাজুক। আইন অনুযায়ী, কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সাময়িক অনুমতি পেতে হলেও সর্বনিম্ন ২৫ হাজার বর্গফুট আয়তনের নিজস্ব বা ভাড়াকৃত ভবন থাকতে হবে। যদিও পরিদর্শক দলের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়টির ভাড়া করা ভবনের মোট আয়তন ১৫ হাজার বর্গফুটেরও কম। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই), ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই), ব্যাচেলর অব পাবলিক হেলথ মাস্টার্স অব পাবলিক হেলথ প্রোগ্রাম থাকলেও এসব বিষয়ে কোনো ধরনের ল্যাব খুঁজে পায়নি কমিশনের পরিদর্শক দল।

দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এসব অনিয়ম বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক . মো. হযরত আলী বণিক বার্তাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি। নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে অগ্রগতি কিছুটা ধীর প্রক্রিয়ায় চলছে। স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে তোলা হচ্ছে। শিক্ষক সংখ্যা তাদের বেতন-ভাতা নিয়ে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমরা সেগুলো সমাধানে কাজ করে যাচ্ছি।

গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রামের ল্যাব না থাকার বিষয়ে উপাচার্য বলেন, সব যন্ত্রপাতিই রয়েছে। শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে না আসায় সেগুলো বক্সে রাখা হয়েছে, যাতে নষ্ট না হয়। শিক্ষার্থীরা এলে সেগুলো ব্যবহার করে পুনরায় রেখে দেয়া হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন