সেন্ট গ্রেগরিজ, ভিকারুননিসা, হলিক্রস, মতিঝিল বয়েজ কিংবা আজিমপুর গার্লস—রাজধানীতে অবস্থিত স্বনামধন্য এমন স্কুলের সিংহভাগই গড়ে উঠেছিল পাকিস্তান কিংবা ব্রিটিশ শাসনামলে। একইভাবে চট্টগ্রামের খাস্তগীর, কলেজিয়েট, ইস্পাহানি কিংবা মুসলিম হাইয়ের মতো নামকরা স্কুলগুলোও প্রতিষ্ঠা পায় বাংলাদেশ অধ্যায়ের আগে। জেলা পর্যায়ের মাধ্যমিক শিক্ষায়ও এখনো নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতার আগে গড়ে ওঠা জিলা স্কুলগুলো।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, স্বাধীনতার পর শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রসার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটি পরিকল্পিত উপায়ে ঘটেনি। বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় এ সংকট প্রকট। গত পাঁচ দশকে দেশে কয়েক হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যার প্রায় সবই বেসরকারি। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারি তদারকি ও নজরদারির বেশ অভাব। অনেক প্রতিষ্ঠানই অর্থাভাবে শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারছে না। নাজুক অবস্থানে থাকছে অবকাঠামো। কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করছেন। এছাড়া শিক্ষার ব্যয় বেশি হওয়ায় স্বল্প আয়ের পরিবারের অনেক শিক্ষার্থীই মাধ্যমিকে এসে ঝরে পড়ছে। গত কয়েক বছরে কিছুসংখ্যক প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলেও মোটাদাগে দেশে সরকারি উদ্যোগে ভালোমানের মাধ্যমিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠেনি। তাই স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত এখনো অনেকটাই দুর্বল।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এসএম হাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, প্রাথমিককে ভিত্তি বলা হলেও মাধ্যমিক হলো শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড। এখানে দুর্বলতা থেকে গেলে গোটা ব্যবস্থার ভিতই নড়বড়ে থেকে যায়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সেটি ঘটছে। মানসম্মত পরিকল্পনার অভাবে অনেকটা বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত হচ্ছে মাধ্যমিকের প্রতিষ্ঠান। নানা ক্যাটাগরিতে বিভক্ত বিদ্যালয়গুলোয় সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো মনিটরিং ব্যবস্থা নেই। যেসব অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে, পরিকল্পনার অভাবে সেটির আউটকামও নিশ্চিত হচ্ছে না।
তিনি আরো বলেন, ব্রিটিশ আমল কিংবা স্বাধীনতার আগে গড়ে ওঠা বিদ্যালয়গুলোয় খেলার মাঠ থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের বিকাশের উন্মুক্ত পরিবেশ রয়েছে। এখন একটি ভবন ও কয়েকজন শিক্ষক নিয়েই গড়ে তোলা হচ্ছে বিদ্যালয়। ভালো ও নামকরা বিদ্যালয় গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই সেখানে শিক্ষার মানসম্মত পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। গত কয়েক দশকে ঢাকায় কয়েকটি মডেল বিদ্যালয় গড়ে তোলা হলেও সারা দেশে সে মডেল অনুসরণ করতে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রকাশিত শিক্ষা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ২০ হাজার ১৭৯টি। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বিদ্যালয় রয়েছে মাত্র ৬৭৯টি। অর্থাত্ দেশের মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাত্র ৩ শতাংশ সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। বাকি ১৯ হাজার ৫০০ স্কুলই পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। এর বাইরে প্রায় ছয় হাজার দাখিল মাদ্রাসা রয়েছে।
সিংহভাগ প্রতিষ্ঠান বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হওয়ায় দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের পেছনে সরকারের ব্যয়ের পরিমাণও অনেক কম। গ্লোবাল পার্টনারশিপের এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপির (মোট দেশজ উত্পাদন) বিপরীতে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয়ের পরিমাণ ১০ দশমিক ২ শতাংশ, যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ হার ১৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। পাকিস্তান মাথাপিছু জিডিপির বিপরীতে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় করে ১৫ দশমিক ২২ শতাংশ। এছাড়া মালয়েশিয়া মাথাপিছু জিডিপির ২২ দশমিক ৯৭ ও সিঙ্গাপুর ২২ দশমিক ২২ শতাংশ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় করে। ইউনেস্কো ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিসটিকসের (ইউআইএস) তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এডুকেশন সেক্টর অ্যানালাইসিস (ইএসএ) ফর বাংলাদেশ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরে গ্লোবাল পার্টনারশিপ। পাঁচটি দেশের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, মাথাপিছু জিডিপির বিপরীতে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয়ে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে এখনো নানা ধরনের সংকটে ভুগছে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা। বিশেষ করে দেশের বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোয় প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব অনেকটাই প্রকট। ব্যানবেইসের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক রয়েছেন ২ লাখ ৫২ হাজার ৫০৫ জন। এর মধ্যে বিএড, বিপিএড, এমএড—এ ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ১ লাখ ৬৭ হাজার ৬৫২ জন। সে হিসেবে মাধ্যমিকের প্রায় ৮৫ হাজার শিক্ষক এখনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করছেন, যা মোট শিক্ষকের ৩৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এছাড়া অর্থের অভাবে অনেক বেসরকারি বিদ্যালয়ই প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারে না। আর নিয়োগ প্রক্রিয়া ধীর হওয়ায় সরকারি স্কুলগুলোয় শিক্ষক সংকট রয়েছে।
বেসরকারি স্কুলগুলোয় অভিভাবকদের শিক্ষা ব্যয়ের পরিমাণও অনেক বেশি। এ ব্যয়ভার বহন করতে না পারায় শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ মাধ্যমিক পর্যায় থেকে ঝরে পড়ছে। ব্যানবেইসের পরিসংখ্যানমতেই দেশের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি মাধ্যমিকে। শিক্ষা পরিসংখ্যান প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৩। এর মধ্যে ছাত্রী ৫৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ। মাধ্যমিকে এসব শিক্ষার্থীর ৩৬ দশমিক ৭৩ শতাংশই দশম শ্রেণী শেষ করার আগে ঝরে পড়ে।
সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত সংস্থাটি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণও নির্ণয়ের চেষ্টা করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার পেছনে আটটি কারণ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে পরিবার অন্যত্র চলে যাওয়া, বই-খাতাসহ লেখাপড়ার উপকরণ নষ্ট হয়ে যাওয়া, তাত্ক্ষণিকভাবে স্কুলের ব্যয় বহনে অক্ষমতা, মা-বাবাকে গৃহস্থালি কাজে সহায়তা, উপার্জন বা ভাগ্যান্বেষণে নেমে পড়া, লেখাপড়ায় আর আগ্রহ না পাওয়া, স্কুলে যেতে নিরাপদ বোধ না করা, যাতায়াতে যানবাহন সংকট-সমস্যা। ঝরে পড়ার কারণ বিষয়ে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ছেলে ও মেয়েদের স্কুল ছেড়ে দেয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ মা-বাবাকে ঘরের বা সংসারের কাজে সহায়তা করা। ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৭ দশমিক ১৫ আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৭ দশমিক ৫৬ শতাংশই মা-বাবাকে ঘরের বা আয়-উপার্জনের কাজে সহায়তার কারণে স্কুলে আসে না। স্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে এর পরের সবচেয়ে বড় বাধা দুর্যোগ-পরবর্তী যানবাহনের সংকট। ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ ছেলে ও ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ মেয়ে এ কারণে স্কুলে যায় না। উভয়ের ক্ষেত্রে স্কুলে না যাওয়ার তৃতীয় কারণ হচ্ছে লেখাপড়ায় আগ্রহ না থাকা। ১০ দশমিক ৯৭ শতাংশ ছেলে ও ১১ দশমিক ২২ শতাংশ মেয়ে এ কারণে স্কুলে যায় না।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, এটা সত্য যে গত পাঁচ দশকে ওই অর্থে ভালো মানের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। তবে বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা বা কোনো বিদ্যালয়ের বিশেষ উন্নয়ন ঘটানো সরকারের লক্ষ্যও ছিল না। সরকারের লক্ষ্য হলো, গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে একসঙ্গে এগিয়ে নেয়া। এক্ষেত্রে বেশকিছু অর্জনও রয়েছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হলেও বেসরকারি স্কুলে সরকারের বিনিয়োগের পরিমাণ কম নয়। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়ের একটি বড় অংশ সরকার দিচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়ন করছে। এছাড়া শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাকরণসহ সরকার নানাভাবে মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।