ছাড়ের পর ছাড় পেলেও পদ্মা ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি

নিজস্ব প্রতিবেদক

কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে লোকসান গুনছে পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড। ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ৯০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অবস্থায় পদ্মা ব্যাংককে ব্যতিক্রমধর্মী আরেক ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটিকে আর্থিক প্রতিবেদনে তথ্য গোপন রাখার সুযোগ দেয়া হয়েছে। সুযোগ পাওয়ায় এখন থেকে পদ্মা ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে লোকসানের কোনো তথ্য থাকবে না। বিদেশী বিনিয়োগ আনতে ব্যাংকটিকে সুযোগ দেয়া হয়েছে।

নতুন করে দেয়া সুযোগ কাজে লাগিয়ে পদ্মা ব্যাংক পুঞ্জীভূত লোকসানের বিপরীতে ইনট্যানজিবল অ্যাসেট বা অদৃশ্য সম্পদ সৃষ্টি করবে, যা আগামী ১০ বছরের মুনাফা থেকে সমন্বয় করতে হবে। লোকসান সমন্বয়ের সময়সীমা পর্যন্ত ব্যাংকটি শেয়ারধারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারবে না। তবে বিদেশী বিনিয়োগ না এলে সুবিধা বাতিল হয়ে যাবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জানানো হয়েছে।

গত সেপ্টেম্বরে পদ্মা ব্যাংক থেকে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ডেলমর্গান অ্যান্ড কোম্পানি পদ্মা ব্যাংকে ৭০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ প্রায় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। এর মধ্যে হাজার ৪০০ কোটি টাকা আসবে ইকুইটি বা মূলধন হিসেবে। বাকি বিনিয়োগ হবে বন্ডসহ অন্যান্য উপায়ে। বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকটির বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন পরিচ্ছন্ন দেখানোর সুযোগ করে দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

প্রসঙ্গত, উদ্যোক্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির ভারে প্রায় ডুবে গিয়েছিল ফারমার্স ব্যাংক। ডুবন্ত ব্যাংকটিকে জীবন দিতে এগিয়ে এসেছিল অর্থ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তিন বছর আগে ব্যাংকটিকে বাঁচাতে ৭১৫ কোটি টাকার পুঁজি ঢালা হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইসিবি থেকে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নাম পরিবর্তন করে ফারমার্স থেকে ব্যাংকটি পদ্মা হয়েছে। আইন রীতিনীতি পরিপালনে নজিরবিহীন ছাড়ও পেয়েছে ব্যাংকটি। তার পরও পদ্মা ব্যাংক নিয়ে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের মাথাব্যথা শেষই হচ্ছে না। উল্টো সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পদ্মা ব্যাংকের সংকট বেড়েই চলছে।

কোনো ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে লোকসান থাকলে বিদেশী বিনিয়োগ আনা দুরূহ বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, পদ্মা ব্যাংক ৭০ কোটি ডলার বিদেশী বিনিয়োগ আনার কথা বলেছে। বিনিয়োগ আনার স্বার্থে শর্তসাপেক্ষে ব্যাংকটির লোকসান সমন্বয়ে ১০ বছর সময় দেয়া হয়েছে। বিনিয়োগ না এলে সুবিধা বাতিল হবে। লোকসান সমন্বয় না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংকটি শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারবে না।

তবে ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা ব্যাংক এরই মধ্যে যেসব নীতিছাড় পেয়েছে, সেগুলো দেশের ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন। ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রাখার কথা বলে নিত্যনতুন যেসব ছাড় দেয়া হচ্ছে, সেগুলোর মাধ্যমে আর্থিক খাতে উদাহরণ সৃষ্টি হচ্ছে। অন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও একই ধরনের ছাড় পেতে চাইলে বিপর্যয় নেমে আসবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর . সালেহউদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক বিক্রির কথা বলে নীতিছাড়ের মাধ্যমে ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদন পরিচ্ছন্ন দেখানো হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রূপালী ব্যাংক বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। আমার মেয়াদে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক বিক্রির সময় লোকসানের দায়সহ আইসিবি গ্রুপ কিনেছিল। বিদেশী যে প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করবে, তারাই নিরীক্ষার মাধ্যমে বের করবে কোন পাত্রে তারা সম্পদ রাখছে। পদ্মা ব্যাংককে নীতিছাড় দিয়ে পরিচ্ছন্ন দেখিয়ে কোনো উপকার হবে বলে আমার মনে হয় না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, পদ্মা ব্যাংকে বিনিয়োগ আনার বিষয়ে ডেলমর্গানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামির আসাফ বাংলাদেশ ব্যাংকে যান। তিনি গভর্নর ফজলে কবিরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে বিনিয়োগের অর্থ ফেরত নেয়ার নিশ্চয়তা চান সামির আসাফ। একই সঙ্গে বিনিয়োগ এনে দেয়ার বিপরীতে প্রাপ্ত কমিশন দ্রুত ছাড় করার ব্যবস্থার অনুরোধ জানান তিনি। ডেলমর্গান বিনিয়োগ এনে দেয়ার বিপরীতে শতাংশ হারে কমিশন চেয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কমিশনের অর্থ দ্রুত ছাড়ের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েছে। তবে বিনিয়োগের অর্থ ফেরত নেয়ার নিশ্চয়তা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে দেয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ওই বৈঠকের পর পদ্মা ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন পরিচ্ছন্ন দেখানোর সুযোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ধারাবাহিকভাবে গ্রাহকদের আমানতের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৭ সালে ফারমার্স ব্যাংকে হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুনর্গঠন করা হয় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ, অপসারণ করা হয় ব্যবস্থাপনা পরিচালককে। তারপর প্রায় চার বছর পেরিয়ে গেলেও ব্যাংকটির দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয়নি। বরং নীতিছাড়ের ছড়াছড়ির পরও ঘুরে দাঁড়াতে ব্যর্থ পদ্মা ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিল।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে পদ্মা ব্যাংকের ৬৮ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা নিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী রূপালী ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) বিনিময়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে জোগান দিতে হয়েছে ৭১৫ কোটি টাকার পুঁজি। ২০১৮ সালে দেয়া এসব পুঁজির বিপরীতে টাকাও মুনাফা পায়নি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। উল্টো ধারাবাহিক লোকসানের কারণে মূলধন হিসাবে জোগান দেয়া অর্থও প্রায় শেষ করে ফেলেছে পদ্মা ব্যাংক। ২০২১ সালের জুন শেষে প্রায় হাজার ১০০ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতিতে ছিল ব্যাংকটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী সিআরআর এসএলআর সংরক্ষণেও ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হচ্ছিল পদ্মা ব্যাংক। ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসএলআর সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা থেকে ব্যাংকটিকে মুক্তি দেয়া হয়। এর ফলে ৮৯ কোটি টাকার জরিমানা মওকুফও পেয়েছে ব্যাংকটি।

পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে পদ্মা ব্যাংকে আটকে আছে সরকারি ব্যাংক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাজার ৮০০ কোটি টাকার আমানত। ব্যাংকটিতে রাখা আমানতের সুদও সময়মতো পায়নি প্রতিষ্ঠানগুলো। দফায় দফায় তাগিদ দেয়া হলেও সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত ফেরত দিতে পারেনি পদ্মা ব্যাংক। উল্টো সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতকেও মূলধনে রূপান্তরের জন্য পদ্মা ব্যাংক থেকে এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল।

সামগ্রিক বিষয়ে বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসান খসরুকে পাওয়া যায়নি।

পদ্মা ব্যাংককে দেয়া নীতিছাড়গুলোকে নজিরবিহীন বলে মনে করেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, প্রথম থেকেই পদ্মা ব্যাংককে এমনসব ছাড় দেয়া হয়েছে যেগুলো দেশের আর্থিক খাতে প্রথম ঘটনা। ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন ছিল কসমেটিক সার্জারির মতো। ভাবমূর্তি শূন্যতায় থাকা কোনো ব্যাংককে এভাবে টিকিয়ে রাখা যায় না। ব্যাংকটিকে আর্থিক প্রতিবেদন পরিচ্ছন্ন দেখানোর যে সুযোগ দেয়া হয়েছে, সেটি অ্যাকাউন্টিংয়ের ফরমেটে কতটুকু সঠিক সেটিও ভেবে দেখতে হবে। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে নরফান্ডের বিনিয়োগ আনার জন্য আমরা দুবছরের বেশি সময় ধরে চেষ্টা করে সফল হয়েছি। উজ্জ্বল ভাবমূর্তি থাকা সত্ত্বেও নরফান্ড ওই সময় বহু তথ্য যাচাই-বাছাই করেছে। কোনো স্বনামধন্য বিদেশী প্রতিষ্ঠান মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকে হঠাৎ করেই বিনিয়োগ করে ফেলবে বলে আমার বিশ্বাস হয় না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন