সময়ের ভাবনা

এলডিসি থেকে উত্তরণের ‘টেস্ট কেস’ বাংলাদেশ

ড. আব্দুল্লাহ্-আল-মামুন

স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সুপারিশ প্রাপ্তি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশের জন্য একটি বড় অর্জন। বাংলাদেশ প্রস্তুতির জন্য ২০২৬ সাল পর্যন্ত সময় পাবে। এরপর সব ঠিক থাকলে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হবে। এলডিসি হিসেবে বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে প্রাপ্ত বাণিজ্য জাতিসংঘ কর্তৃক প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা হারালেও অর্জন বিশ্বদরবারে জাতি হিসেবে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। তবে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে ১৯৭১ সালে এলডিসি তালিকা করার পর এরই মধ্যে যে ছয়টি দেশ উত্তরণ করেছে তার সবগুলোই জনসংখ্যা, আয়তন (বতসোয়ানা) ছাড়াও অর্থনীতির আকারে খুবই ছোট। বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনাযোগ্য নয়। যেমন মালদ্বীপ বা ভানুয়াতু। মালদ্বীপের জনসংখ্যা সাড়ে লাখের মতো এবং মোট জিডিপি প্রায় বিলিয়ন ডলার। ভানুয়াতুর জনসংখ্যা লাখের মতো এবং জিডিপি বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। সেখানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি এবং জিডিপি এখন ৪০০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। এজন্য বাংলাদেশই হবে এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রথম টেস্ট কেস যেহেতু টেস্ট কেস সেহেতুু এলডিসি উত্তরণ ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনা মহামারী ব্যবস্থাপনাকে আরো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের লাভ-ক্ষতির হিসাব সম্পর্কে পাঠকদের অনেকেই অবগত, তাই সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে এলডিসি থেকে বের হওয়ার প্রক্রিয়া এবং করণীয় নিয়ে আলোচনা করব। তবে সংক্ষেপে বললে উন্নয়নশীল দেশে উপনীত হওয়ার পর বাণিজ্যসহ আন্তর্জাতিকভাবে প্রাপ্ত অনেক সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে পড়বে রফতানি খাত, মূলত বস্ত্র ওষুধ। জাতিসংঘে চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যাবে এবং যেসব যাতায়াত সুবিধা প্রদান করা হয় তা বন্ধ হয়ে যাবে। অন্যদিকে, উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হলে বিশ্বদরবারে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হওয়ার পাশাপাশি আমাদের ক্রেডিট রেটিং উন্নত হবে। ফলে আমরা আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বেশি বেশি ঋণ পাব, আরো বেশি বিদেশী বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা তৈরি হবে, দেশী কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ করতে পারবে। আমরা নিজেরাও সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করার মাধ্যমে সম্পদ আহরণ করতে পারব।

জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এলডিসি থেকে উত্তরণের নয়টি ধাপের কথা বলে। এর অন্যতম হলো জাতিসংঘের সুপারিশ, সরকারের নেতৃত্বে প্রস্তুতি প্রক্রিয়া, উন্নয়ন-সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা, স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি (এসটিএস) তৈরি অনুমোদন, এসটিএস প্রয়োগ এসটিএস প্রয়োগের পর্যালোচনা। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট (সিডিপি) জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির কাছে গত ফেব্রুয়ারিতে একটি চিঠি হস্তান্তর করেছে, যাতে ২০২৬ সালে লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে কী কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন তা উল্লেখ করেছে। চিঠির নির্দেশনাসহ আরো যে বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা দরকার তা হলো এলডিসি উত্তরণ পরিকল্পনা এবং করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা একসঙ্গে নিয়ে এগোনো, এলডিসি থেকে সঠিকভাবে উত্তরণের জন্য স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি (এসটিএস) তৈরি করা, গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন-সহযোগীদের এসটিএস প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করা এবং আন্তর্জাতিক ফোরাম যেমন সম্প্রতি স্থগিত হওয়া ১২তম ডব্লিউটিও মিনিস্টারিয়াল কনফারেন্স, দোহায় জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য এলডিসি- কনফারেন্স এবং ইউনাইটেড ন্যাশন কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে (ইউএনসিটিএডি) বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসটিএস তৈরির জন্য সিডিপির নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে, যেখানে ইউএনডিপির মতো সংস্থাগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এসটিএস তৈরির কাজ করতে বলা হয়েছে। এরই মধ্যে যেসব দেশ এসটিএস তৈরি করেছে যেমন ভানুয়াতু, ভুটান, সামোয়া বা কেপভার্দি তারা প্রত্যেকে সিডিপির তত্ত্বাবধানে উন্নয়ন-সহযোগীদের সহায়তায় এসটিএস তৈরি করেছে। এসটিএসে সাধারণত এলডিসি থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি চিহ্নিত করা, মন্ত্রণালয় অধিদপ্তর, পরিদপ্তর সংস্থাগুলোর মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করা এবং লক্ষ্য অর্জনের সময় নির্ধারণ করা। সিডিপির দুটি শাখা বিষয়ে সহায়তা দিয়ে থাকেঅ্যাডভাইজরি সাপোর্ট টু ইন্টিগ্রেটেড গ্র্যাজুয়েশন রিলেটেড অ্যাক্টিভিটি এবং ইন্টার এজেন্সি টাস্কফোর্স ফাইন্যান্সিং ফর ডেভেলপমেন্ট। করোনা পরিস্থিতির কারণে এলডিসি থেকে উত্তরণ প্রক্রিয়ায় থাকা দেশগুলোর জন্য সিডিপি এলডিসি সাসটেইনেবল সাপোর্ট ফ্যাসিলিটি গঠন করেছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য উন্নয়ন-সহযোগীদের সঙ্গে সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। সম্পর্ক শুধু ঋণপ্রাপ্তির জন্য নয়। এটি দরকার গবেষণা, দক্ষতা বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুবিধা, বাংলাদেশের পক্ষে তদবির করা, আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করা এবং আপস আলোচনায় দক্ষতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করার জন্যও। উন্নয়ন-সহযোগীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলে এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ডব্লিউটিও বিভিন্ন দেশ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা আদায় করা সম্ভব।

এলডিসি থেকে উত্তরণ প্রক্রিয়ায় দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণএক. চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা, দুই. ২০৪১ সালের মধ্যে যে আমরা উন্নত দেশে পরিণত হতে চাই সে লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া। এক্ষেত্রে, আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি আমাদের রফতানি পণ্যের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং নতুন নতুন বাজারের সংস্থান করতে হবে। মালদ্বীপ এলডিসি উত্তরণের পরে থাইল্যান্ড আমেরিকায় মাছের নতুন বাজার সৃষ্টি করেছে। সামোয়া জাপান চীনের কৃষিপণ্যের বাজার সৃষ্টি করেছে। ইকুয়েটোরিয়ান গিনি চিনি, জাপান দক্ষিণ কোরিয়া গ্যাস রফতানি বৃদ্ধি করেছে। এরই মধ্যে এলডিসি উত্তরণ হওয়া সব দেশ পণ্য উৎপাদনক্ষমতা এবং পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। পর্যটন খাত থেকে আয় বাড়িয়েছে।

বছর ফেব্রুয়ারিতে সিডিপি সুপারিশ পাওয়ার পর সরকার বিভিন্ন কমিটি গঠন করেছে। ইআরডি সাপোর্ট টু সাসটেইনেবল গ্র্যাজুয়েশন নামে একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। সরকার মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে ন্যাশনাল কমিটি অন এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন (এনসিজি) গঠন করেছে। এনসিজির অধীনে সাতটি উপকমিটিও গঠন করা হয়েছে। এগুলো হলো প্রেফারেনশিয়াল মার্কেট অ্যাকসেস এবং ট্রেড এগ্রিমেন্ট, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইট (আইপিআর), ডব্লিউটিও ইস্যু (আদার দেন মার্কেট অ্যাকসেস অ্যান্ড টিআরআইপিএস), ইনভেস্টমেন্ট, ডোমেস্টিক মার্কেট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট ডাইভারসিফিকেশন, ইন্টারনাল রিসোর্স মোবিলাইজেশন অ্যান্ড ট্যারিফ র্যাশনালাইজেশন, বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিং স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি। এছাড়া উন্নয়ন-সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে জয়েন্ট টাস্কটিম (এসটিএস) এবং ন্যাশনাল কমিটি এসবিএসকে সহযোগিতা করার জন্য ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়েছে। প্রত্যেক মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর এবং পরিদপ্তরের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন ফোরাম পয়েন্ট তৈরি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এসব কমিটি, সাবকমিটি ওয়ার্কিং গ্রুপের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন প্রক্রিয়ার মধ্যে ওভারল্যাপিং আছে এবং সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ইআরডি অন্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে সাসটেইনেবল গ্র্যাজুয়েশন প্রজেক্ট কী কী কাজ করছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। সমন্বয়ের অভাব স্পষ্ট। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় পোশাক ওষুধ শিল্পসহ রফতানি ক্ষেত্রে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর কী কী অসুবিধা হবে সে বিষয়ে একটি সমীক্ষা করেছে বলে জানা গেছে। কিন্তু সমীক্ষা অনুযায়ী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না।

২০২১ থেকে ২০২৬ সাল পাঁচ বছরের প্রস্তুতির সময় অনেক লম্বা মনে হলেও আদতে এলডিসি থেকে উত্তরণ প্রক্রিয়া একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ, যা সন্নিবেশিত হবে স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজিতে (এসটিএস) এসটিএসকে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা উন্নয়ন বাজেট বলে চিন্তা করা মারাত্মক ভুল হবে। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বা উন্নয়ন বাজেট পরিকল্পনার লক্ষ্যগুলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্জন করতে না পারলে পরবর্তী সময়ে করার সুযোগ থাকে কিন্তু এসটিএস ঠিকভাবে তৈরি করা না গেলেও মধ্য আয়ের দেশের ফাঁদে বন্দি হয়ে যাবে দেশ। এসটিএস তৈরির প্রক্রিয়া তথা এলডিসি উত্তরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সমাজের সার্বিক অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি এখনো অনুপস্থিত। অথচ দেশের সব জনগণকে এলডিসি উত্তরণের ভালো দিক চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতন করা উচিত।

এলডিসি উত্তরণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে উন্নয়ন-সহযোগীদের সাহায্যের প্রয়োজন হবে, যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। দুশ্চিন্তার বিষয় হলো সরকারের সঙ্গে উন্নয়ন-সহযোগীদের আলোচনার মূল মঞ্চ লোকাল কনসালটেটিভ গ্রুপ (এলসিজি) কার্যকর নেই। আবার বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ফোরাম (বিডিএফ) নিয়েও উন্নয়ন-সহযোগীদের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে। ধরনের সম্পর্ক এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য মোটেও সুখকর নয়। যে কারণে এলডিসি থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগিতা এবং সরকারের মধ্যে যেসব সমন্বিত উদ্যোগ দেখতে পাওয়ার কথা তা দেখা যাচ্ছে না। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে এলডিসি উত্তরণ শুধু বাণিজ্যিক বিষয় নয়। এটি দেশের প্রায় সব অর্থনৈতিক খাত যেমন স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, বিজ্ঞান প্রযুক্তি খাতকে প্রভাবিত করবে। তাই খুব দ্রুত স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি তৈরির কাজ শুরু করতে হবে। সব অংশীদারকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রত্যেক চ্যালেঞ্জ সুযোগের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এলডিসি উত্তরণের লাভ-ক্ষতির হিসাব করে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবে একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যারা আপস-আলোচনার সঙ্গে যুক্ত থাকবে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। ক্ষেত্রে ইআরডির অধীনে একটি নেগোসিয়েশন ইউনিট বা উয়িং গঠন করা যেতে পারে। এলডিসি থেকে উত্তরণ অবশ্যই সরকার জাতির জন্য একটি বড় অর্জন। তবে আত্মতৃপ্তি এবং অধিক বিশ্বাসের বিশ্বাসী হয়ে যদি আমরা সঠিকভাবে এসটিএস তৈরি করতে না পারি তাহলে এলডিসি উত্তরণের আশীর্বাদ অভিশাপ হিসেবে দেখা দেবে।

 

. আব্দুল্লাহ্-আল-মামুন: রিসার্চ ডিরেক্টর, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন