মহামারী-উত্তর প্রস্তুতি

অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ

লি জং ওয়া

কভিড-১৯ মহামারী বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল অর্থনীতিতে উত্তরণের বিষয়টি ত্বরান্বিত করেছে, যা আগামীর প্রবৃদ্ধি সুযোগের চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করবে কাজেই আমরা যেহেতু মহামারী-উত্তর সময়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, সেহেতু আমাদের অবশ্যই একটি বিষয় স্বীকার করতে হবে আর তা হলো, ডিজিটাল অর্থনীতির সম্ভাবনাময়ভাবে অসীম সুফলগুলো ততক্ষণ পর্যন্ত সমানভাবে বণ্টন হবে না, যতক্ষণ আমরা সঠিক পদক্ষেপ না নিই

মোবাইল সেবা, ইন্টারনেট, ক্লাউড কম্পিউটিং অন্য উদ্ভাবনগুলো একটি বহুবিস্তৃত বৈশ্বিক পরিসর সৃষ্টি করেছে সেখানে কয়েক বিলিয়ন মানুষ কাজ করতে পারে, আরো গতিশীল জীবনের উপায়গুলো সন্ধান করতে পারে, সুযোগগুলো গ্রহণ করতে পারে ডিজিটাল প্লাটফর্মগুলো আমাদের ভোগের পদ্ধতি বদলে দিয়েছে, আমাদের কাজের ধরন পরিবর্তন করেছে, অনেক বেশি অর্থনৈতিক মূল্য সৃষ্টি করেছে সর্বোপরি কম্পিউটার, যোগাযোগ সরঞ্জাম এবং সফটওয়্যারের মতো ডিজিটাল সম্পদগুলো উৎপাদন ব্যয় হ্রাস এবং কার্যকারিতা বাড়াতে প্রভূত সাহায্য করেছে

ডিজিটাল রূপান্তর ব্যাপকভাবে বিগ ডাটার ব্যবহার বাড়াবে সম্মিলন ঘটাবে ৫জি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইন্টারনেট অব থিংসের মতো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তিগুলোর এভাবে পুরো রূপান্তর প্রক্রিয়াটি দ্রুত বেগবান করবে এরই মধ্যে ম্যাকেঞ্জি গ্লোবাল সার্ভেতে উঠে এসেছে যে মহামারী নিজেদের গ্রাহক সরবরাহ নিগড়ের মিথস্ক্রিয়ার ডিজিটাইজেশন ঘটানোর দিকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিচালিত করেছে এবং তাদের অভ্যন্তরীণ পরিচালন প্রক্রিয়াও আগামী তিন-চার বছর নাগাদ পুরোপুরি ডিজিটাল হয়ে যাবে

তবে প্রশ্ন হলো, ডিজিটালাইজেশনে ত্বরায়নের সুবিধা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে কর্মী ভোক্তাদের কাছে আদৌ পৌঁছবে কিনা পুরনো প্রযুক্তি, প্রক্রিয়া, এমনকি গোটা শিল্পগুলোকে অচল করে দিয়ে ডিজিটালাইজেশন মানুষের কর্মচ্যুতি অব্যাহত রাখবে ২০২০ সালের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ফিউচার অব জবস রিপোর্টে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে যে ব্যক্তি খাতের অনেক কোম্পানিই আগের চেয়ে অনেক বেশি যন্ত্র অ্যালগরিদম নিয়োজন করবে এটা বিভিন্ন খাত অঞ্চলজুড়ে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা ব্যাহত করবে এআই, রোবটস অন্য নতুন প্রযুক্তিগুলো ২০২৫ সালের মধ্যে কোম্পানিগুলোর গড় ১৫ শতাংশ জনশক্তি হুমকিতে ফেলতে পারে

এসব প্রভাবের বাস্তবতায় ডিজিটাল রূপান্তর সামাজিক অর্থনৈতিক অসমতা, ডিজিটালি দক্ষ অদক্ষ শ্রমিকের ব্যবধান বাড়াবে নতুন প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে আর্থসামাজিক বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন অঞ্চলে গভীর বিভাজন তৈরি হয়েছে একই সঙ্গে প্রযুক্তিগত বিস্তার প্রতিষ্ঠান শিল্পগুলোর মধ্যে অসম হবে বড়গুলোর তুলনায় ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন সন্নিবেশে কম সামর্থ্য থাকতে পারে, বিপরীতে যা বাজারে প্রবেশের চেষ্টাকারী নতুন প্রতিযোগীদের বাধাগ্রস্ত করতে পারে

আরো বড়ভাবে বললে, অর্থনীতিজুড়ে উৎপাদনশীলতা প্রবৃদ্ধি চালিত করতে ডিজিটাল বিপ্লব আরো কিছু সময় নিতে পারে অর্থনীতিবিদরা বেশ আগে থেকে কূটাভাস পর্যবেক্ষণ করেছেন যে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রভাব উৎপাদনশীলতা পরিসংখ্যান বাদে সবখানে দেখা যায় এখন মহামারী প্রতিষ্ঠান শিল্পজুড়ে উৎপাদনশীলতায় ব্যবধান বাড়িয়েছে ট্র্যাডিশনাল কোম্পানি ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পুনরুদ্ধার ধীর হতে পারে, যদিও ডিজিটাল চাহিদা উল্লম্ফনের পরিবেশের অধীনে টেক জায়ান্টগুলো বিকশিত হয়েছে  

ডিজিটাল বিপ্লব রাজনৈতিক উদ্বেগও বাড়ায়, যেমন যখন সরকার করপোরেশনগুলো তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের সময় পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কনট্যাক্ট ট্রেসিং অ্যাপ, মবিলিটি ডাটা, ক্যামেরা এবং অন্য ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে, তবে নজরদারির সুফল এসেছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিনিময়ে তথ্যপ্রযুক্তি জায়ান্টরা ব্যবহারকারীর তথ্যে আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে এমন ব্যাপক ক্ষমতা চর্চা করছে যে গ্রাহকরা তথ্য সুরক্ষা গোপনীয়তা রক্ষার গুরুত্ব বিষয়ে অধিক সচেতন হয়ে উঠছে

মহামারী-উত্তর যুগের জন্য প্রস্তুত হওয়ার জন্য এসব প্রশ্ন সামনে আনা এবং উত্তর অন্বেষণ আবশ্যক, যখন সব দেশেরই কাজ, উৎপাদন ভোগের নতুন উপায়গুলো আলিঙ্গন করা প্রয়োজন হবে ডিজিটালাইজেশন জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, ভোক্তাকল্যাণ সমাজজুড়ে সম্পদ সৃষ্টিতে বিপুল অবদান রাখতে পারে, তবে সেটি কেবলই সম্ভব হবে যদি সরকারি বেসরকারি খাতগুলো অন্তর্ভুক্তিতা নিশ্চিতে একযোগে কাজ করে

বেশির ভাগ দেশেরই ডিজিটাল দক্ষতা প্রবেশগম্যতায় ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে, কারণ বিপুলসংখ্যক কাজের ক্ষেত্রে অধিক প্রযুক্তিগত জ্ঞান দক্ষতা রপ্ত করা প্রয়োজন হবে ভবিষ্যতের ডিজিটাল দুনিয়ার জন্য প্রয়োজন হওয়া জ্ঞান দক্ষতায় শিক্ষার্থীদের সজ্জিত করতে শিক্ষা ব্যবস্থা অবশ্যই ঢেলে সাজাতে হবে সর্বাধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ে হালনাগাদ রাখতে সব কর্মীর জন্য অবশ্যই কর্মক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে

এসব ক্ষেত্রে সরকারগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে মূলত রাষ্ট্রীয় সমর্থন অঙ্গীকারই ইন্টারনেট, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, অ্যান্টিবায়োটিক এবং সবচেয়ে কার্যকর কভিড-১৯ টিকা উন্নয়নে এমআরএন প্রযুক্তির মতো বৈপ্লবিক উদ্ভাবন সহজতর করেছে বাজার নির্মাতা হিসেবে নিজস্ব ভূমিকা পরিপূরণে সরকারগুলোকে ভৌত অবকাঠামো মানব পুঁজিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগুলোয় সমতামূলক অভিগম্যতা নিশ্চিতে আর্থিক কর প্রণোদনা জোগাতে হবে ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোগ, স্টার্ট আপগুলোকে অনুদান, ভর্তুকি কারিগরি সহায়তা দেয়ারও বিভিন্ন উপায় খুঁজে বের করতে হবে, যাতে ডিজিটাল বিপ্লবের সুবিধাগুলো গুটিকয়েক বড় কোম্পানির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে

বিশেষ করে বিগ টেকের প্রসঙ্গ যখন আসে, তখন প্রাক-ডিজিটাল অর্থনীতির নীতি মানদণ্ডগুলো আর খাটে না এর মানে হলো, অধিকাংশ দেশকেই অবাধ ন্যায্য প্রতিযোগিতা নিশ্চিতে তাদের প্রতিযোগিতা নীতি নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামোগুলো হালনাগাদ করতে হবে, সংশোধন করতে হবে

যদিও কার্যকর সুশাসনের জন্য চূড়ান্তভাবে বৈশ্বিক ঐকমত্য প্রয়োজন ভিন্ন জাতীয় কৌশল (অ্যাপ্রোচ) কেবলই ডিজিটাল অর্থনীতিকে খণ্ডিত করবে এবং কর রেগুলেটরি স্বেচ্ছাচারিতাকে আমন্ত্রণ জানাবে ৫জি হার্ডওয়্যার, সামাজিক নেটওয়ার্ক প্লাটফর্মগুলো সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনের মধ্যে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা জাতীয়তাবাদী সুরক্ষাবাদী পদক্ষেপের দিকে চালিত করেছে ফলে আরো বহুপক্ষীয় সহযোগিতামূলক অ্যাপ্রোচের প্রয়োজনীয়তা নতুন করে দেখা দিয়েছে লক্ষ্য অবশ্যই হতে হবে ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তিগুলোর আন্তঃসীমান্ত বিনিময়ের ব্যবস্থা করা একই সঙ্গে ডিজিটাল বাণিজ্যের জন্য শক্তিশালী নীতি মানদণ্ড তৈরি করা

বিশ্ব এখনো একটি নজিরবিহীন অভিঘাত থেকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে তবে যত দ্রুত আমরা নতুন স্বাভাবিকের জন্য প্রস্তুত হব, ততই তা আমাদের জন্য ভালো হবে এবং সফল প্রস্তুতি নির্ভর করবে আমরা ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে পারি কিনা তার ওপর

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

লি জং ওয়া: অর্থনীতির অধ্যাপক, কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়; মুখ্য অর্থনীতিবিদ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক; সাবেক দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি মাইয়াং-বাকের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বিষয়াদির জ্যেষ্ঠ পরামর্শক

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন