শ্রদ্ধাঞ্জলি

একজন আদর্শ প্রকাশক ও ব্যক্তিগত কিছু স্মৃতি

আফসান চৌধুরী

মহিউদ্দিন ভাইয়ের চলে যাওয়াটা আমাদের অনেককে দুদিক থেকে কষ্ট দিচ্ছে, বেদনাহত করছে। একটা  হলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে। তিনি আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পুরো পরিবারটাই ঘনিষ্ঠ। মহিউদ্দিন ভাইয়ের মেয়ে মাহরুখ মহিউদ্দিন ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) হাল ধরেছে। সেও আমার মেয়ের মতো। এজন্য খুব বেশি খারাপ লাগছে। দ্বিতীয়ত, তার মৃত্যুতে আমাদের প্রকাশনা জগতের জন্য বিরাট ক্ষতি হয়েছে। তিনি প্রকাশনা জগতে যে মান প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তা আন্তর্জাতিক মানের। এটা বাংলাদেশের জন্য গর্বের। একটা মানুষ দেখিয়ে গেছেন কীভাবে বই প্রকাশ করতে হয়, ছাপাতে হয়। এটি তার বড় অর্জন।

একজন লেখক হিসেবে আমার বই ইউপিএল এবং অন্য প্রকাশনা সংস্থা প্রকাশ করে। সেজন্য আমি জানি কীভাবে ইউপিএল বই প্রকাশ করে এবং অন্যরা কীভাবে করে। আমি বলব, ইউপিএলের প্রক্রিয়া-পদ্ধতি অবশ্যই অনেকটা ভিন্ন। বাংলাদেশে ইউপিএলের পদ্ধতি সবচেয়ে উত্তম। অসুবিধা হলো, আজকের দুনিয়া এবং বাংলাদেশে বইয়ের বাজারের প্রেক্ষাপটে তা কতটা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। দীর্ঘ সময় ধরে সম্পাদনা করা হয়, দেখা হয়, ছাপা হয় এবং তারপর বাজারে বিতরণ করা হয়। কোনোটাতেই কোনো ঘাটতি থাকে না। সেদিক থেকে ইউপিএল বাংলাদেশে সবচেয়ে উত্তম প্রতিষ্ঠান। অন্যরাও দেখে কিন্তু অনেক সময় তাদের বইয়ে অনেক ভুলভ্রান্তি থেকে যায়। ইউপিএল এক্ষেত্রে অনেকটা ব্যতিক্রম। বাংলাদেশের একাডেমিক জগতে সংস্থাটি আস্থা অর্জন করেছে। একাডেমিক পাঠ্যবইয়ের ক্ষেত্রে ইউপিএলের চেয়ে ভালো, উন্নত প্রকাশনা সংস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। আমি যে অন্যদের কথা বলছি, তারাও ভালো। কিন্তু এক্ষেত্রে ইউপিএল এখনো অতুলনীয় হয়ে আছে।

আবারো উল্লেখ করছি যে ইউপিএলের মডেলটি চলবে কিনা জানি না। প্রকাশনা চ্যালেঞ্জটি সেদিক থেকে সবচেয়ে বেশি মাহরুখের ওপর। যেহেতু উত্তরসূরি হিসেবে সংস্থাটি পরিচালনা করছে। আমি দেখছি যে সেও নানা রকম সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে।

মহিউদ্দিন ভাই একসময় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রকাশনা সংস্থায় (ওইউপি) ছিলেন। পরে সেটি তিনি ছেড়ে এলেন। প্রতিষ্ঠা করলেন ইউপিএল। সংস্থাটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আজকের দুনিয়ায় প্রকাশনা জগতে অনেক কিছু পরিবর্তন ঘটছে। মহিউদ্দিন ভাইয়ের সময়ের তুলনায় অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে। অবস্থায় মহিউদ্দিন আহমেদের লিগ্যাসি কতটুকু ধরে রাখা যাবে, তা নিয়ে কিছুটা সন্দিহান।

মহিউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় প্রসঙ্গে বলি। তার সঙ্গে যোগাযোগ ১৯৭২-৭৩ সালে। আমি তখন ছাত্র। তার পরও আমি তার অফিসে গিয়েছিলাম। তিনি খুব সজ্জন মানুষ ছিলেন। এমন সজ্জন মানুষ বাংলাদেশে খুব কম আছে। আচার-ব্যবহারে তার নম্রতা, ভদ্রতা, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা সবসময়ই দেখা গেছে। আমি যেহেতু তার পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সেহেতু জানি যে তিনি কীভাবে সবাইকে আগলে রেখে চলেছেন। আমার সবসময়  মনে হয়, তিনি যে মান প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তা টিকিয়ে রাখা যাবে কিনা। আজকের দুনিয়ায় এটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ বৈকি।

ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি রয়েছে। আমার প্রথম উপন্যাস তার প্রকাশনা থেকে ছাপা হয়েছে। আমি কীভাবে সাহস করে গিয়েছিলাম, তা ভেবে নিজেই অবাক হই। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছাড়া এটা প্রকাশ করা সম্ভব হতো না। বইয়ের সম্পাদক ছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। আজকে ভাবা যায়, ইলিয়াস ভাইয়ের মতো ঔপন্যাসিক আমার মতো নতুন লেখকের উপন্যাস দেখে দিয়েছেন! সেটি মহিউদ্দিন ভাই পারতেন। এটি তার কাজের একটি বড় বৈশিষ্ট্য। অন্য কোনো প্রকাশনায় বড় কোনো লেখক অন্যের লেখা দেখে দিচ্ছেন, সেই প্রক্রিয়া চালু আছে কিনা, আমার সন্দেহ আছে।

ইউপিএল আমার আরো কিছু বই প্রকাশ করেছে। একাত্তর নিয়ে দুটি বই প্রকাশ করেছে। তৃতীয় আরেকটি প্রকাশ হবে। লেখক-প্রকাশকের সম্পর্কের জায়গা থেকে তিনি আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। অন্য একটি বিশেষ কাজ আমরা একসঙ্গে করেছি। সেটি হলো, পাকিস্তানের ইতিহাস বিষয়ে বই। যেহেতু আমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেছি, মামুন ভাই (মুনতাসীর মামুন) মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেছেন, সেহেতু মহিউদ্দিন ভাই আমাদের দুজনকে দিয়ে পাকিস্তানের ইতিহাস অনুসন্ধান করিয়েছেন। এটা একটা বিরল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। জানি যে তিনি ওই সময় পাকিস্তানে ছিলেন। কিন্তু সে সময় তাকে দেখেছি, ভদ্রতা রক্ষা করে খুব সবলভাবে তিনি পাকিস্তানের বিষয়ে যুক্তিগুলো দিতেন। জেনারেল তারেকের শাসনামল বিষয়ে অভিজ্ঞতার কথা মনে আছে। ২৫ মার্চ যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, তার পরিকল্পনা এঁটেছিলেন তারেকই। তার সঙ্গে আমরা সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, জেনারেল তারেক মৃত্যুর আগে বুড়ো বয়সে ওই বিষয়ে অপরাধ বোধে ভুগছিলেন। আমাদের বুকে জড়িয়েছিলেন। আমাদের সবারই খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। ওই অবস্থায় না করতে পারেনি। বোঝাই যাচ্ছে, তিনি সাংঘাতিকভাবে অস্বস্তিতে রয়েছেন। মহিউদ্দিন ভাই একের পর এক তাদের আক্রমণ করে যাচ্ছেন। তাদের প্রশ্ন দিয়ে নাজেহাল করছেন। এসব বিষয়ে মামুন ভাইয়ের বই বের হয়েছে সেই সব পাকিস্তানি নামে। আমার মনে হয়, খুব সাফল্যের সঙ্গে তার অবস্থানটা মহিউদ্দিন ভাই রক্ষা করে গেছেন। সেটি খুব কম মানুষই করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ওপর তিনি যেসব বই প্রকাশ করেছেন, সেগুলো দিয়ে আর লাভ করা সম্ভব কিনা, আমার যথেষ্ট সংশয় আছে। কিন্তু তার পরও তিনি করে গেছেন। যেসব সাহিত্যের বই প্রকাশ করেছেন, লেখক হিসেবে যাদের নির্বাচন করেছিলেন, সেগুলো সম্পাদনায় যাদের ন্যস্ত করেছিলেন, তাতে বোঝা যায় তিনি প্রকাশনাকে কতটা গভীরভাবে, দায়িত্বশীলতার সঙ্গে দেখেছেন। একটা মান প্রতিষ্ঠা করে গেছেন যে এর নিচে হলে অতটা ভালো নয়, এর ওপর হলে ভালো। এটা কাকতালীয় ব্যাপার নয়, তিনি দুই খণ্ডের বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী প্রকাশ করতে পেরেছেন। অবশ্যই বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ প্রকাশনা সংস্থা হিসেবে এটি তিনি করেছেন। এটিই তার একটি বড় অর্জন কাজ।

যাদের সঙ্গে কথা বলি তারা বলেন, যে বই প্রকাশ করা হোক না কেন, ওই বইটি সবচেয়ে বেশি চলবে। মহিউদ্দিন ভাইয়ের এটি বিরাট অর্জন এবং তার মেয়েও এটা পেয়েছে। বড় একটি ব্যাপার, পরম্পরাটা কীভাবে রক্ষিত হয়েছে। মাহরুখও একেবারে মহিউদ্দিন ভাইয়ের মতো। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে যেভাবে পরিশ্রম করে, আজকাল ভাবাই যায় না। আরেকটি বিষয় হলো, তিনি সাংবাদিকতার মানুষ ছিলেন। গণমাধ্যমের সঙ্গে তার সম্পর্ক কতটা নিবিড় ছিল তা বোঝা যায়, তিনি ১৯৭৭-৭৮ সালে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। এর নাম ছিল সাপ্তাহিক সানডে স্টার। পত্রিকায় আমার বন্ধু হাসান ফেরদৌস কাজ করত, সে আমাকে নিয়ে যায় এবং আমরা দুজন সেখানে কাজ করতাম। এটা পরে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু পত্রিকায় যারা কাজ করতেন, প্রত্যেকেই বাংলাদেশের ইংরেজি সাংবাদিকতায় অন্যতম ভালো দক্ষ সাংবাদিক ছিলেন। মহিউদ্দিন ভাই এর সম্পাদক ছিলেন। খুব কম মানুষ জানবে যে তিনি একজন সম্পাদকও বটে। প্রকাশকের ভূমিকায় তো আছেন বটে, সম্পাদকও বটে। ব্যক্তিগতভাবে একটি বড় মানের সাপ্তাহিক পত্রিকা চালানোর অভিজ্ঞতা আমি তার কাছ থেকেই শিখেছি। এটা নিয়ে আমার কৃতজ্ঞতার কোনো শেষ নেই মানুষটির প্রতি।

আমি মনে করি, মহিউদ্দিন ভাই সব দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে আদর্শ প্রকাশক। মানসম্মত প্রকাশনা বলতে যা বোঝায়, তার একটা রূপ তিনি দেখিয়ে গেছেন, এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আর কেউ পারেননি। সেজন্য তার অর্জনের সঙ্গে অন্য প্রকাশকের অর্জনের তুলনা হতে পারে না।

তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

 

আফসান চৌধুরী: লেখক সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন