টিকা সংকটের শঙ্কায় কমেছে প্রথম ডোজ পাওয়ার হার

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

দেশে নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা প্রয়োগের কর্মসূচি চলছে দুই মাসের বেশি সময় ধরে। যদিও পরিকল্পনা অনুযায়ী এখনো টিকার সংস্থান করতে পারেনি বাংলাদেশ। এমনকি আগাম মূল্য পরিশোধের পরও দেশে আসেনি কাঙ্ক্ষিত টিকার চালান। এর মধ্যে চলতি মাসে দ্বিতীয় ডোজের প্রয়োগ শুরু হয়। দ্বিতীয় ডোজ শুরুর পর দেখা গেছে প্রথম ডোজ গ্রহণকারীর সংখ্যা কমেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান কর্মসূচিতে দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগের বিষয়টিকে আপাতত বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

গত এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ৫৫ লাখ ৬৮ হাজার ৭০৩ জন নারী-পুরুষ প্রথম ডোজের টিকা গ্রহণ করেছেন। পরদিন, অর্থাৎ এপ্রিল থেকে শুরু হয় তাদের টিকার দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ। পাশাপাশি চলমান থাকে প্রথম ডোজের প্রয়োগও। এপ্রিল থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মোট ২১ লাখ ৬৩ হাজার ১৫৪ জন মানুষ প্রথম দ্বিতীয় ডোজের টিকা নিয়েছেন। এর মধ্যে প্রথম ডোজ নিয়েছেন লাখ ৯৫ হাজার ১৭৯ জন, যা গত দুই সপ্তাহে মোট টিকা গ্রহণকারীদের ১০ শতাংশের কম।

রাজধানীতে মোট ৪৭টি কেন্দ্রে টিকাদান কার্যক্রম চলছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব কেন্দ্রে গত দুই সপ্তাহে প্রথম ডোজের টিকা নেয়ার সংখ্যা কমেছে। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে গত সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে ১৪ জন পুরুষ চারজন নারী প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছেন। একই দিন কেন্দ্রটিতে দ্বিতীয় ডোজের টিকা নিয়েছেন ৬০২ জন। রাজধানীর সব টিকা কেন্দ্রের চিত্র প্রায় একই রকম। এদিন রাজধানীর কেন্দ্রগুলোতে দ্বিতীয় ডোজের টিকা নিয়েছেন ২৪ হাজার ৩৬৫ জন প্রথম ডোজ পেয়েছেন হাজার ৬৭১ জন।

রাজধানীর একটি টিকা কেন্দ্রের উপপরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, টিকার সংকটের কারণে প্রথম ডোজ প্রয়োগে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। আমাদের কেন্দ্রে প্রতিদিন ৫০ জনকে প্রথম ডোজ দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে। মূলত দ্বিতীয় ডোজকেই সবার আগে রাখছি আমরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, পর্যন্ত ৭১ লাখ ৮৪ হাজার ৪০৬ জন টিকাপ্রত্যাশী নিবন্ধন করেছেন। এর মধ্যে এপ্রিলের পর দুই সপ্তাহে লাখ ৯১ হাজার ৬১৬ জন নিবন্ধন করেছেন। সব মিলিয়ে ১৪ লাখের বেশি নিবন্ধনকারী প্রথম ডোজের টিকা পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। তথ্য অনুযায়ী গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে দুই ডোজ মিলিয়ে ৭৭ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬১ জন টিকা নিয়েছেন। এর মধ্যে ৫৭ লাখ ৭৮ হাজার ৬৮৬ জন নারী পুরুষ নিয়েছেন প্রথম ডোজের টিকা। আর দ্বিতীয় ডোজের টিকা নিয়েছেন ১৯ লাখ ৬৭ হাজার ৯৭৫ জন। ফলে মজুদকৃত টিকার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩৯ ডোজে। টিকা আগামী মাসের মাঝামাঝিতে শেষ হয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বর্তমানে যে সংখ্যক টিকার মজুদ রয়েছে, তাতে সংকট খুব বেশি দূরে নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ফার্মাকোলজি সোসাইটির সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজির বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আগামী মাসের মধ্যে অন্য উৎস থেকে টিকা এলে ভালো। আসলে গত দুই মাসে যাদের প্রথম ডোজের টিকা দেয়া হয়েছে, তাদের জন্যই কেবল দ্বিতীয় ডোজ বরাদ্দ রাখা উচিত। এতে কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকবে। কারণ দুই ডোজের মাঝে বিরতি বেশি হলে তা আর কাজে আসবে না। পরিকল্পনামাফিক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচিত সবাইকে দুই ডোজ টিকার আওতায় আনা গেলে করোনার সংক্রমণ কমানো যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র পরিচালক (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, প্রথম ডোজের টিকা পরিকল্পনা অনুযায়ী দেয়া হচ্ছে। নিবন্ধনের পর মূলত সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রই নিজস্ব মজুদের অবস্থা পরিকল্পনা অনুযায়ী ঠিক করে যে কবে কতজনকে টিকা দেয়া হবে। তিনি বলেন, টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি ধরেই কার্যক্রম চালিয়ে নিতে হবে। যে টিকা আছে তা শেষ হতে অনেক সময় লাগবে। এর মধ্যেও সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে টিকা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে রাশিয়া চীনের কাছ থেকে সাড়াও পাওয়া গেছে। এছাড়া কোভ্যাক্স থেকে টিকা পাওয়ার কথা রয়েছে।

গত ফেব্রুয়ারি থেকে সারা দেশে কভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকা প্রয়োগ শুরু করে সরকার। বর্তমানে চল্লিশোর্ধ্ব অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নাগরিকদের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড টিকা দেয়া হচ্ছে। টিকার জন্য স্থানীয় উৎপাদক ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে গত নভেম্বর ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করে সরকার। টিকার দাম আগাম পরিশোধ করে বাংলাদেশ সরকার। চুক্তির শর্ত অনুসারে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশে আসার কথা। গত জানুয়ারিতে ৫০ লাখ ডোজ টিকা এলেও ফেব্রুয়ারিতে এসেছে মাত্র ২০ লাখ ডোজ। গত মাসে কোনো টিকা আসেনি। এর মধ্যে টিকা রফতানিতে স্থগিতাদেশ জারি করেছে ভারত সরকার। এতে আগামী কয়েক মাস টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কেনা টিকার ৭০ লাখ ডোজ ছাড়াও ৩২ লাখ ডোজ উপহার পাঠায় ভারত।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তায় অন্যান্য উেস যোগাযোগ করেছিল বাংলাদেশ। কূটনৈতিক তত্পরতার পরিপ্রেক্ষিতে শর্তসাপেক্ষে রাশিয়া চীন থেকে সহযোগিতার আশ্বাস পাওয়া যায়। রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে কভিড-১৯-এর টিকা উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। যৌথভাবে টিকা উৎপাদনের পাশাপাশি দেশটি থেকে বাণিজ্যিকভাবেও টিকা কিনবে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোতে টিকা দ্রুত সরবরাহ করার লক্ষ্যে একটি সংরক্ষণাগার গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে চীন। ইমার্জেন্সি কভিড ভ্যাকসিন স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি নামের জোটে চীনের নেতৃত্বাধীন অন্য দেশগুলো হলো আফগানিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, পাকিস্তান বাংলাদেশ। বাংলাদেশ প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন