হেনরি কিসিঞ্জারের মিথ ফিরিয়ে আনছেন কি অমিত শাহ

শিশুরা খর্বকায় পশ্চিমবঙ্গের মাথাপিছু আয়ও বাংলাদেশের চেয়ে কম

সাইফ বাপ্পী

পশ্চিমবঙ্গের শিশুদের বেড়ে ওঠার সমস্যা নিয়ে গবেষণা চালিয়েছিলেন ভারতের একদল গবেষক। তাদের গবেষণায় দেখা যায়, জনস্বাস্থ্যের কিছু সমস্যা শিশুদের শারীরিক বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। জনসাধারণের যত্রতত্র মলত্যাগের অভ্যাস সেখানকার পরিবেশকে করে তুলেছে অস্বাস্থ্যকর। ফলে শিশুরাও প্রায়ই ডায়রিয়াসহ পেটের অসুখে ভোগে। কারণে পশ্চিমবঙ্গের শিশুদের মধ্যে বাংলাদেশের একই সামাজিক অবস্থানে থাকা পরিবারের শিশুদের তুলনায় খর্বকায়ত্বের সমস্যা অনেক বেশি।

গবেষক দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন দিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকসের বিশেষজ্ঞ ডিন স্পিয়ার্স। জার্নাল ফর ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকসের গত সেপ্টেম্বরের সংখ্যায় তার -সংক্রান্ত আরেকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়েছে। এর শিরোনাম ছিল এক্সপোজার টু ওপেন ডিফিসেশন ক্যান অ্যাকাউন্ট ফর দি ইন্ডিয়ান এনিগমা অব চাইল্ড হাইট সেখানেও তিনি পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা ভারতেই স্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন ব্যবস্থার অভাবকেই শিশু খর্বকায়ত্বের বড় কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

শুধু শিশু স্বাস্থ্য বা স্যানিটেশন নয়, অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকেও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে পশ্চিমবঙ্গসহ নিকটবর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলো। ক্ষুদ্রতর ভূখণ্ড জনসংখ্যা নিয়েও বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বর্তমানে এমন কয়েকটি রাজ্যের সম্মিলিত জিডিপির চেয়েও বেশি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল হাজার ৯০৫ ডলার। এর বিপরীতে প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল প্রায় হাজার ৫৬৬ ডলার। আসামের ক্ষেত্রে সংখ্যা হাজার ১৮৬। এছাড়া ঝাড়খণ্ডের মাথাপিছু জিডিপির আকার ছিল প্রায় হাজার ৮৭ ডলার, বিহারের ৬২৭, মেঘালয়ের হাজার ২৭৬ ত্রিপুরার হাজার ৭৩০ ডলার।

আইএমএফের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও ভারতের পূর্ব উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ১০টি রাজ্যের সম্মিলিত জিডিপির প্রায় সমান ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি। ওই সময় পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড আসামসহ ১০ রাজ্যের জিডিপির পরিমাণ ছিল ২৯ হাজার কোটি ডলার। অন্যদিকে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ছিল ২৮ হাজার ৮০০ কোটি ডলার।

এর বিপরীতে ভারতের সাম্প্রতিক বছরগুলো কেটেছে অর্থনৈতিক শ্লথতার মধ্য দিয়ে। আইএমএফের ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পরের সময়টিতেও দুই দেশের অর্থনীতির বিপরীতমুখী গতি আরো দৃশ্যমান হয়েছে। সর্বশেষ কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব অর্থনীতিতে চাপ ফেললেও সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভারতীয় অর্থনীতির শ্লথতা রূপ নিয়েছে সংকোচনে। সর্বশেষ অক্টোবরে প্রকাশিত আইএমএফের আরেক প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেয়া হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরে ভারতের অর্থনীতি সংকুচিত হতে পারে ১০ দশমিক শতাংশ হারে। সময় বাংলাদেশ মাথাপিছু জিডিপির দিক থেকে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর দুই দেশের সংবাদমাধ্যমেই নিয়ে বেশ আলোচনাও হয়। ভারতের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও নিয়ে কথা হয়েছে অনেক।

এর পরও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্প্রতি বাংলাদেশীদের নিয়ে কটাক্ষ করে ভারতীয় গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন। কলকাতাভিত্তিক একটি সংবাদমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাত্কারে তিনি মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশীরা খেতে পায় না বলে। তার ভাষ্যমতে, কারণে বাংলাদেশ থেকে লোকজন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অনুপ্রবেশ করছে।

অমিত শাহের বক্তব্যে কোনো সত্যতা দেখতে পাচ্ছেন না সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থা অনেক ভালো। অর্থনৈতিক সামাজিক অনেক সূচকে তারা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান যে প্রবণতা, সেটিও বক্তব্যকে সমর্থন করে না। কারণে বক্তব্য মোটেও যথাযথ, যৌক্তিক বা গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রায় ৫০ বছর আগে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে মন্তব্য করেছিলেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। যুদ্ধবিধ্বস্ত, দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে থাকা অবকাঠামোশূন্য দেশের পক্ষে সে সময় মন্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হয়নি। যদিও পরে মন্তব্যকে ভুল প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ। তবে তাতে সময় লেগেছে অনেক। কিন্তু এক পর্যায়ে ওয়াশিংটনের কূটনীতিকরাও স্বীকার করেছেন, কিসিঞ্জারের বক্তব্য সঠিক ছিল না। অর্ধশতক পর অমিত শাহের মন্তব্যে কিসিঞ্জারের সে বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ঐতিহ্যগত সাদৃশ্য সবচেয়ে বেশি। দুটি দেশই নিজ নিজ সংস্কৃতিতে আদি উপমহাদেশীয় সভ্যতার উত্তরাধিকার বহন করছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এর পরও অমিত শাহসহ আরো কয়েকজন ভারতীয় রাজনীতিবিদ বাংলাদেশীদের নিয়ে ধরনের অসম্মানসূচক মন্তব্য করে চলেছেন স্রেফ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকেই।

পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক সুবিধা পেতেই অমিত শাহ ধরনের মন্তব্য করেছেন বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক . ইমতিয়াজ আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বক্তব্য পুরোপুরি রাজনৈতিক। গত কয়েক বছরে বিজেপি এক ধরনের কমিউনাল রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে। এটি তারই প্রতিফলন। হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতাকে কাজে লাগাতে ধরনের বক্তব্য রেখেছেন তিনি। তবে আমি মনে করি. এটা অমিত শাহর ব্যক্তিগত মন্তব্য বিজেপির রাজনীতিপ্রসূত। আমি মনে করি না এটি ভারতের রাষ্ট্রীয় বক্তব্য বা দৃষ্টিভঙ্গি। হলে তারা আমাদের সঙ্গে বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এভাবে চুক্তি করত না।

অমিত শাহের ভাষ্যের বিপরীত তথ্য মিলছে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক সামাজিক বিষয় সম্পর্কিত বিভাগের (ইউএন-ডিইএসএ) পরিসংখ্যানেও। ইউএন-ডিইএসএর তথ্য বলছে, ১৯৯০ সালেও ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশী অভিবাসীর সংখ্যা ছিল ৪৩ লাখ ৭০ হাজার। প্রায় দুই দশকের মাথায় ২০১৯ সালে তা নেমে এসেছে ৩১ লাখে। বিষয়ে জাতিসংঘের সংস্থাটির ভাষ্য হলো, সময় বাংলাদেশীদের মধ্যে ভারতে অভিবাসনের আগ্রহ ক্রমেই হ্রাস পেয়েছে। এর পরিবর্তে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে অভিবাসন বেড়েছে বাংলাদেশীদের। ইউএন-ডিইএসএর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী অন্যান্য দেশে অভিবাসন গ্রহণকারীদের মধ্যে ভারতীয়ের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।

বাংলাদেশের অর্থনীতির যাত্রা ভারতের অনেক পর। দেশভাগের পর পাকিস্তানি শাসন অর্থনৈতিক আধিপত্যের কারণে পূর্ববঙ্গে অর্থনৈতিক অবকাঠামো তেমন একটা গড়ে ওঠেনি। উপরন্তু উদ্যোক্তাদের সিংহভাগই ছিল অবাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানি। স্বাধীনতার সময় তারা দেশ থেকে বড় অংকের পুঁজি স্থানান্তর করে পাকিস্তানে। এছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামো অর্থনৈতিক সক্ষমতা ছিল পুরোমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত। কারণে স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনীতির পুনর্গঠন সম্প্রসারণই রীতিমতো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সে সময় হেনরি কিসিঞ্জারের বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা দিয়ে করা বক্তব্যটিকে চ্যালেঞ্জ করা ছিল অসম্ভব।

কিন্তু কালের পরিক্রমায় সে অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। ক্রমেই বড় হয়েছে অর্থনীতি। পাশাপাশি এগিয়েছে আর্থসামাজিক সূচকগুলোতেও। এদিক থেকে অনেক সূচকেই এরই মধ্যে ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে শিল্প খাত। এছাড়া স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, খাদ্য নিরাপত্তা নারীর ক্ষমতায়নসহ অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় লিঙ্গসমতার কথা। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী লিঙ্গসমতার ভিত্তিতে তৈরি সূচকে ২০১৯ সালেও এদিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল শীর্ষে। বিশ্বব্যাপী অবস্থান ছিল শীর্ষ ৫০ দেশের মধ্যে। অন্যদিকে ভারতের অবস্থান ছিল ১১২তম।

বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকেও দেখা যাচ্ছে অমিত শাহর বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য। গত বছরের বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে (গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স-২০২০) বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৫তম। ভারতের ৯৪।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন