‘দেউলিয়া হওয়ার আগ পর্যন্ত বই প্রকাশ...’

এসএম রশিদ

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় বই প্রকাশ শুরু করেছিল ১৬৪০-এর দশকে। শুরুটা হয়েছিল এভাবে। ১৬৩৮ সালে পাদ্রি জোসে গ্লোভার স্ত্রী এলিজাবেথ ও সন্তানদের নিয়ে ম্যাসাচুসেটস চলে আসেন। সঙ্গে ছিল কামার স্টিফেন ডে ও তার পরিবার। গ্লোভার সঙ্গে নিয়েছিলেন একটা প্রিন্টিং প্রেস, টাইপ ও কাগজ। কিন্তু সমুদ্রযাত্রায় জোসে মারা যান। এলিজাবেথ কেমব্রিজের একটি বড় বাড়িতে ওঠেন আর স্টিফেন ডের জন্য ছাপাখানার যন্ত্রপাতিসহ একটি ছোট বাড়ির বন্দোবস্ত করেন।

১৬৪০ সালে হাজির হন পাদ্রি হেনরি ডানস্টার। তার বয়স তখন ৩০, তিনি হার্ভার্ড কলেজের প্রথম প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। তিনি বিধবা এলিজাবেথ গ্লোভারকে বিয়ে করেন এবং তার বাড়িতে ওঠেন। এলিজাবেথ ১৬৪৩ সালে মারা যান। প্রেস, টাইট ও কাগজের মালিকানা পান ডানস্টার। তিনি নতুন বিয়ে করেন। গ্লোভার দম্পতির সন্তান, নতুন স্ত্রী ও ছাপাখানার যন্ত্রপাতি নিয়ে ডানস্টার হার্ভার্ড ইয়ার্ডে তার জন্য কলেজের নির্মাণ করে দেয়া বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। খুব সম্ভবত ছাপাখানাটি চালাতেন স্টিফেন ডের সন্তান ম্যাথিউ, তিনি আবার কলেজ স্টুয়ার্ডও ছিলেন।

এ প্রেস থেকে তৃতীয় যে আইটেমটি ছাপা হয়েছিল, সেটি ব্রিটিশ উপনিবেশে ছাপা হওয়া প্রথম বই। ১৬৪০ সালে প্রকাশিত হয় দ্য হোল বুক অব সালমস ফেইথফুলি ট্রান্সলেটেড ইনটু ইংলিশ মেট্রে। পরবর্তী সময় এর নাম হয় ‘বে সালম বুক’। উপনিবেশের ক্ষমতাধররা এ বই হাতে নিয়ে ঈশ্বরের বন্দনা গাইতেন। এ বইয়ের ১১টি কপি এখনো টিকে আছে।

কিছুদিন পর প্রেসটি ইয়ার্ডের অন্য একটি ভবনে স্থানান্তরিত হয়। বই, প্যাম্ফলেট ও কলেজের বিভিন্ন প্রকাশনা ছাপাতে গিয়ে প্রেসটি দারুণ ব্যস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু ১৬৯২ সালে হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষ প্রেসের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।

এরপর ১৮০২ সালে প্রেসিডেন্ট ও ফেলোরা নতুন করে একটি প্রকাশনা বিভাগ খোলার পক্ষে ভোট দেন। কিন্তু এ উদ্যোগও ১৮২৭ সালে বাতিল করা হয়। প্রকাশনা নিয়ে হার্ভার্ডের তৃতীয় উদ্যোগটি আসে ১৮৭২ সালে। এ বছর একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ১৮৯২ সালে চালু হয় পাবলিকেশন অফিস। দুটি দপ্তরই ছিল ইয়ার্ডের ইউনিভার্সিটি হলে। পরবর্তী সময় পাবলিকেশন অফিস চলে যায় আরো প্রশস্ত র্যান্ডল হলে। প্রকাশনা কর্মীরা একটি কাচের পার্টিশনের এক পাশে ব্যালকনিতে বসতেন। পার্টিশনের অন্য পাশে বসতেন কম্পোজিটররা। (আনুষ্ঠানিকভাবে ছাপাখানা ও প্রকাশনার কর্মীরা পৃথক হন ১৯৪২ সালে) ১৯১৩ সালে পাবলিকেশন অফিসটি আজকের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসে পরিণত হয়। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি তাদের শতবর্ষ উদযাপন করেছে।

কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস? ১৯১২ সালে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা একটি পূর্ণাঙ্গ ইউনিভার্সিটি প্রেস চালু করতে সিদ্ধান্ত নেন, তখন তাদের দরকার হয়েছিল মোটা তহবিলের। এ তহবিল সংগ্রহ ও মানুষের মধ্যে এ প্রেস নিয়ে আগ্রহ জাগাতে তারা একটি সার্কুলার প্রকাশ করেছিলেন, যাতে তারা ব্যাখ্যা করেছিলেন যে কেন তারা প্রেসটি প্রতিষ্ঠা করতে চান। দিয়েছিলেন সাতটি যুক্তি। মুখ্য যুক্তিটি ছিল একটি সমৃদ্ধ প্রকাশনা সংস্থা হার্ভার্ডের বুদ্ধিবৃত্তিক খ্যাতিকে ছড়িয়ে দেবে। আরেকটি কারণ ছিল যে এটা জ্ঞানের বিকাশে বস্তুগত ভূমিকা রাখবে। এটাও স্পষ্ট করা হয়েছিল যে এ সংস্থা কোনো অবস্থাতেই বাণিজ্যিক প্রকাশনার প্রতিদ্বন্দ্বী হবে না, কারণ তারা সেই বই প্রকাশ করবেন, যেগুলো বাণিজ্যিক প্রকাশকরা লাভজনক মনে করেন না।

১৯৪৭ থেকে ১৯৬৭—এ দুই দশক হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের পরিচালক ছিলেন থমাস জে. উইলসন। তিনি ছিলেন এর পঞ্চম পরিচালক। উইলসনের হাত ধরে প্রকাশনা সংস্থাটি নিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং দুনিয়ার প্রকাশনা জগতে নিজেকে বিশিষ্ট আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। তার একটি কথা বিখ্যাত হয়ে আছে—‘একটি ইউনিভার্সিটি প্রেসের উচিত দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ভালোমানের, বুদ্ধিবৃত্তিক বই প্রকাশ করতে থাকা।’

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের প্রথম যে বইটি পুলিত্জার পুরস্কার জেতে সেটি ফ্র্যাংক লুথার মটের হিস্ট্রি অব আমেরিকান ম্যাগাজিন। ১৯৩৯ সালে বইটি পুলিত্জার জেতে। আমেরিকার কূটনীতি বা ইতিহাস বিষয়ে প্রকাশিত বইয়ের জন্য প্রচলিত ব্যানক্রফট পুরস্কার প্রথমবার আসে ১৯৫১ সালে। আর্থার এন হলকম্বের আওয়ার মোর পারফেক্ট ইউনিয়ন: ফ্রম এইটিন-সেঞ্চুরি প্রিন্সিপালস টু টোয়েন্টিয়েথ-সেঞ্চুরি প্র্যাকটিস। কিন্তু কোনো বেস্টসেলার বই কেন যেন হার্ভার্ডের হাতে আসছিল না। এ অপূর্ণতা দূর হয় ১৯৫০ সালে। এ বছর প্রকাশিত হয় এমি কেলির এলেনর অব অ্যাকুইটেইন অ্যান্ড দ্য ফোর কিংস, বইটি টাইমসের বেস্টসেলারে স্থান করে নিয়েছিল।

মার্ক ক্যারল হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসে যোগ দেন ১৯৫৬ সালে, পরিচালক হন ১৯৬৭ তে। তিনি এ পদে ছিলেন চার বছর। তার আমলে প্রকাশিত হয়েছিল বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ জন রাওলের আ থিওরি অব জাস্টিস, ই. ও. উইলসনের দি ইনসেক্ট সোসাইটিজ এবং এডওয়ার্ড ও জ্যানেট জেমসের সম্পাদনায় নোটেবল আমেরিকান ওম্যান: ১৬০৭-১৯৫০। তার পরও প্রেসের বেশ আর্থিক ঘাটতি দেখা দেয়, যা প্রশাসনকে উদ্বিগ্ন করে। ১৯৭২ সালে ক্যারল হার্ভার্ড প্রেস ত্যাগ করেন।

১৯৯০ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের পরিচালক হন উইলিয়াম পি. সিসলার। তিনি এক সময় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের যুক্তরাষ্ট্র অফিসের মানবিক ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। তার অধীনে প্রেসটি আলোচিত সব দার্শনিক ক্রিটিকাল বই প্রকাশ করে, যার মধ্যে আছে ব্রুনো লাতুরের উই হ্যাভ নেভার বিন মডার্ন (১৯৯৩), ভাল্টার বেনজামিনের দি অ্যারাকেডস প্রজেক্ট (১৯৯৯), স্টিফেন জে গোল্ডের দ্য স্ট্রাকচার অব ইভোলুশনারি থিওরি (২০০২), ম্যারি বিয়ার্ডের দ্য রোমান ট্রায়াম্ফ (২০০৭), চার্লস টেলরের আ সেকুলার এজ (২০০৭), অমর্ত্য সেনের দি আইডিয়া অব জাস্টিস (২০০৯), মার্থা সি. নাসবমের ক্রিয়েটিং কেপাবিলিটিজ (২০১১)।

২০০১ সাল থেকে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস মূল ভাষার টেক্সটের মুখোমুখি পাতায় অনুবাদ আকারে বই প্রকাশ শুরু করে। ২০০১ সালে চালু হয় আই ট্যাটি রেনেসাঁ লাইব্রেরি, ২০১০ সালে ডাম্বারটন ওকস মেডিয়েভাল লাইব্রেরি এবং ২০১৪ সালে মূর্তি ক্ল্যাসিক্যাল লাইব্রেরি অব ইন্ডিয়া। তিন দশক ঈর্ষণীয় সাফল্য নিয়ে দায়িত্ব পালন করেন সিসলার, অবসরে যান ২০১৭ সালে। তার স্থালাভিষিক্ত হন জর্জ আন্দ্রেও, তিনি এর আগে খ্যাতনামা প্রকাশনা সংস্থা আলফ্রেড এ. নফের সিনিয়র এডিটর ছিলেন।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মতো হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসেরও ভালো-খারাপ দিন গেছে। ম্যাক্স হল লিখেছেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের ইতিহাস। তার কথায়, ‘উত্তর আমেরিকায় প্রথমবার প্রিন্টিং প্রেস পৌঁছনোর পর থেকে কয়েক শতাব্দীতে হার্ভার্ডের বই প্রকাশনা বিভিন্ন রকমের চেহারা নিয়েছে। কেন্দ্রীয় প্রকাশনা দপ্তরের বিকশিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি ছিল ধীর ও অস্থির প্রকৃতির, এমনকি ১৯১৩ সালের পরও। প্রেসিডেন্ট এলিয়ট প্রিন্টিং ও প্রকাশনা দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; আর্থিক সমর্থন থাকলে তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ ইউনিভার্সিটি প্রেস তৈরি করতে পারতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক প্রেসিডেন্ট লোয়েলও চেয়েছিলেন একটা ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রতিষ্ঠা করতে, তবে তার মনে আশঙ্কা ছিল যে প্রতিষ্ঠানটি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে না। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। এরপর প্রেসিডেন্ট কোনান্ট চেয়েছিলেন প্রেসটি বন্ধ করে দিতে, কারণ তিনি মনে করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত নয় ব্যবসায় জড়ানো। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন বরং তার মেয়াদের দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হার্ভার্ড প্রেসকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়। প্রেসিডেন্ট বোক ১৯৭২ সালে নতুন পরিচালককে বলেন যে তিনি একই সঙ্গে সেরা বুদ্ধিবৃত্তিক ও পেশাদার একটি প্রেস চান এবং তিনি মনে করেন না যে এ দুটো বৈশিষ্ট্য পরস্পরকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।’

২০১৩ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের পরিচালক উইলিয়াম সিসলার প্রতিষ্ঠানটির শতবর্ষ পালনের সেই সময়ে বলেছিলেন, ‘আমরা প্রকাশিত বইগুলোর জন্য যে ইতিবাচক রিভিউ পাই কিংবা পুরস্কার জিতেছি, তাতে মনে হয় আমাদের কাজকর্ম ঠিকঠাক চলছে। আমার জানা মতে, ৪০ বছর প্রতিষ্ঠানটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হাত পাততে হয়নি। দুটি উেসর আয় থেকে আমরা স্বাবলম্বী—বই বিক্রি ও অনুদান। বিশ্ববিদ্যালয়ও খুশি থাকবে এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে। যদিও কাজ মোটেই সহজ নয়!’

এসএম রশিদ: লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন