বিদেশনির্ভরতায় অস্থিতিশীল খাদ্যপণ্যের দাম

উৎপাদন বাড়াতে কৃষি মন্ত্রণালয়কেই পদক্ষেপ নিতে হবে

সম্প্রতি দেশে চাল, আলু পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধির কারণ উদ্ঘাটনে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপনবিষয়ক জাতীয় কর্মশালায় কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, বছর চাল, পেঁয়াজ আলু তিনটির দাম বেশি ছিল। তাই উৎপাদন বাড়াতে না পারলে কোনো পণ্যেরই দাম স্থিতিশীল থাকবে না। বক্তব্যের মাধ্যমে মন্ত্রী বাজার চাহিদা পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন। চলতি বছরের শুরু থেকেই ভোগ্যপণ্যের দামে অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে অভ্যন্তরীণ ঘাটতি কভিড পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক খাদ্যবাজারের অস্থিরতাকে দায়ী করা হচ্ছে। জোগানের স্বল্পতার সুযোগ নিয়ে কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অতিরিক্ত মুনাফা করছে বলেও অভিযোগ আসছে। অবস্থায়  নিত্যপণ্যের দামের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির কথাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। চাল, আলু, পেঁয়াজের মতো পণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ বাংলাদেশের রয়েছে। এর সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যমান খাদ্য সংরক্ষণ-পরিবহন পদ্ধতি আধুনিকায়ন বণ্টন ব্যবস্থা শক্তিশালী করা জরুরি।

দেশের কৃষকরাই কয়েক বছরের ব্যবধানে ভুট্টার উৎপাদন দ্বিগুণ করেছেন। বছরে কোটি টনের ওপর সবজি উৎপাদন করে নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে রফতানিও করছেন। প্রশ্ন হলো, তাহলে তারা কেন চাহিদামাফিক পেঁয়াজ উৎপাদনে সক্ষম হবেন না? সন্দেহ নেই, এক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। কৃষক নিজে যে বীজ উৎপাদন করেন, সেসব বীজের গুণগত মান তেমন ভালো না হওয়ায় ফলনও কম হয়। ক্রেতারাও দেশী পেঁয়াজ কিনতে অনাগ্রহ দেখান। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে গুণগত মানের বীজ উৎপাদন সরবরাহের উদ্যোগ নিতে হবে। দেশে শুধু শীতকালেই পেঁয়াজ উৎপাদন করা হয়। এক ঋতুর ওপর নির্ভর করে উৎপাদন করলে চাহিদা পূরণ সম্ভব হয় না। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদন সহায়ক জাত উদ্ভাবনে গবেষণা জোরদার করতে হবে। চাল, পেঁয়াজের পাশাপাশি বিভিন্ন শস্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধিতে বীজ, সার, প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ দিয়ে কৃষককে সহায়তা করা প্রয়োজন।  

আতঙ্কজনক চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা। বলা হচ্ছে, আগামী কয়েক বছরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক বিরাট অংশ সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবে। লবণাক্ততায় আবাদি জমি নষ্ট হওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি, সময়মতো বৃষ্টিপাত না হওয়া, ঋতুবৈচিত্র্য তাপমাত্রার পরিবর্তন, কৃষিব্যবস্থাকে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এছাড়া বাজারব্যবস্থার ত্রুটির ফলে কৃষক ভোক্তা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য চাই জ্ঞাননির্ভর টেকসই প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং যথাসময়ে তা কৃষকের মধ্যে প্রয়োগ। প্রয়োজন দূরদর্শী নীতি পরিকল্পনা গ্রহণ, যেন সমস্যাভিত্তিক ধারাবাহিক গবেষণায় কৃষিতে প্রযুক্তিগত জ্ঞানের নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন হয়।

এক হিসাবে দেখা গেছে, এদেশে কৃষি গবেষণায় টাকা বিনিয়োগে টাকার বেশি রিটার্ন আসে। সুতরাং কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। গতানুগতিক খাপ খাওয়ানোর কৌশল সনাতন অনুভূমিক কৃষির মধ্য দিয়ে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য জোগানের নিশ্চয়তা দুরূহ। কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং শস্যবীমা চালু করতে হবে।

কৃষি উৎপাদন লাভজনক না হলে কৃষক উৎপাদন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। ভর্তুকি দিয়ে হলেও কৃষককে বাঁচাতে হবে। তা করা না হলে বিশাল জনসংখ্যার এদেশে খাদ্য নিরাপত্তা শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। অবস্থায় জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের লক্ষ্যে কোষ আণবিক স্তরে গবেষণার মাধ্যমে মৌলিক জ্ঞান সৃজন এবং কৃষিতে এগুলো প্রয়োগে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। বায়োটেকনোলজি জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে কৃষিতে নানা রকম ঘাত সহনশীল ফসল প্রাণীর জাত সৃষ্টি করা সম্ভব। তবে জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে উদ্ভাবিত যেকোনো নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের আগে জৈব নিরাপত্তা নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ প্রয়োজন।

কভিড-১৯-এর প্রভাবে বহু দেশে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অনেক দেশ খাদ্যসামগ্রী রফতানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এমতাবস্থায় খাদ্যের জন্য পরনির্ভরশীলতা হবে বিশাল ঝুঁকিপূর্ণ বিপজ্জনক। দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ছাড়িয়েছে। সেই সঙ্গে কমছে আবাদি জমি। বর্ধিত জনসংখ্যা, আবাদকৃত জমি হ্রাস, উৎপাদনশীলতায় স্থবিরতাএসব মিলিয়ে দেশে প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্য উৎপাদন এমনিতেই বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বৃহৎ জনসমষ্টির খাদ্য পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে মৌসুমেই খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো জরুরি। কভিড-১৯ বিশ্বের প্রতিটি দেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অনেক দেশে খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। খাদ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়তে পারে। অতএব স্থানীয়ভাবে খাদ্য উৎপাদনে জোর দিতে হবে। উৎপাদনশীলতা উৎপাদন বাড়াতে যেসব উপখাত জড়িত, সবাইকে সরকার কর্তৃক ঘোষিত ভর্তুকি উদ্দীপনা প্যাকেজের আওতায় আনা বাঞ্ছনীয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন