সবার আগে ভ্যাকসিন পাবে কে?

বণিক বার্তা ডেস্ক

যখনই একটি নতুন অনুমোদিত ভ্যাকসিন উপলব্ধ হবে, তখনই স্বাস্থ্যকর্মীদের যে কঠিন প্রশ্নটির মুখোমুখি হতে হবে তা হলো এটি গ্রহণের জন্য লাইনে সবার সামনে কে থাকবে? সচরাচর স্বাস্থ্যসেবার কর্মীরাই সবার আগে থাকেন। এর আগের প্রাদুর্ভাব, যেমন ২০০৯ সালে এইচ১এন১ সোয়াইন ফ্লুর সময় যেসব মানুষের স্বাস্থ্যের অবস্থা খুবই দুর্বল তারাও অগ্রাধিকার পেয়েছিল।

বহুল প্রত্যাশিত কভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে আরো একটি নতুন বিষয় বিবেচনা করা হচ্ছে: ন্যায্যতা।  অক্টোবর ন্যাশনাল একাডেমি অব মেডিসিন ভ্যাকসিন বিতরণে তাদের প্রস্তাব প্রকাশ করে। ২৩৭ পৃষ্ঠার প্রস্তাব ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ অ্যান্ড দ্য ইউএস সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন দ্বারা অনুমতিপ্রাপ্ত।

রিপোর্টে প্রস্তাব করা হয়, উপলব্ধ হওয়ার পর ভ্যাকসিনের বিতরণ যেন চারটি ধাপে সম্পন্ন করা হয়। প্রথম কারা গ্রহণ করবে সেটা অবধারিত: স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, জরুরি সেবাদাতা, যারা শারীরিকভাবে দুর্বল এবং গোষ্ঠীবদ্ধ পরিবেশে বসবাস করা বয়স্করা। এর সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রস্তাবের এবং কোভ্যাক্স সমন্বয়ের যে মূলনীতি তার সাদৃশ্য রয়েছে। কোভ্যাক্স মূলত দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে, ১৭১টি দেশ এখানে যোগ দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ (যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া উদ্যোগে থাকতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং একদল বিজ্ঞানী স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের সবার ওপর রাখার বৌদ্ধিক যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন)

কিন্তু ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রিপোর্টটিতে সেসব মানুষকে অগ্রাধিকার দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, যারা সিডিসির সামাজিক ক্ষতিগ্রস্ততা সূচকে সবচেয়ে বেশি স্কোর করেছে। যা চিহ্নিত করে দারিদ্র্য, যাতায়াত ব্যবস্থায় প্রবেশগম্যতার অভাব কিংবা জনাকীর্ণ ঘরে অবস্থান করার কারণে দুর্বল স্বাস্থ্যজনিত ফলাফলগুলোকে। ভাইরোলজিস্ট, এপিডেমিওলজিস্ট, ইকোনমিস্ট অন্যান্য স্বাস্থ্য গবেষক যারা রিপোর্টটি লিখেছেন তারা বলেছেন, তাদের লক্ষ্য হচ্ছে সংখ্যালঘু দরিদ্র মানুষদের ওপর মহামারীর অসামঞ্জস্যপূর্ণ বোঝা হালকা করা। সে সঙ্গে স্বাস্থ্যে সমতা বিধানকে সামনে রেখে নতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।

শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় অন্যদের বৈষম্যগুলো ব্যাপক। আফ্রিকান আমেরিকান, হিস্পানি স্থানীয় আমেরিকানদের করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা শ্বেতাঙ্গদের তিন গুণ বেশি। যেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যুর আশঙ্কা দ্বিগুণ।

কমিটি মেম্বার ডেল মেডিকেল স্কুলের হেলথ ইকুইটির ডিন জুয়েল মুলেন বলেন, পদ্ধতির ফলে আমরা সব মানুষের জন্য সমান সম্মানের ধারণাটিকে গ্রহণ করতে পেরেছি এবং সামাজিক বৈষম্যের মূল বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে পেরেছি। পাশাপাশি যে কারণগুলো আফ্রিকান আমেরিকান, হিস্পানি স্থানীয় আমেরিকানদের এমন পরিস্থিতিতে ফেলেছে এবং পেশায় নিয়ে এসেছে তাও চিহ্নিত করেছি। তবে এটা এখনো নিশ্চিত নয় যে এগুলো কীভাবে কার্যকর করা হবে এবং দেশের নজিরবিহীন ভ্যাকসিন বিতরণে এগুলো কেমন ভূমিকা রাখবে।

এরপর কে

কভিড-১৯-এর উচ্চসংক্রামক প্রকৃতি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বাধ্য করেছে কে আগে ভ্যাকসিন পাবে, সে সিদ্ধান্ত নিতে সামাজিক মানদণ্ডগুলোকে বিবেচনা করার জন্য। যেমন গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বাস করা মানুষদের সুরক্ষা দেয়া কিংবা এমন পরিবেশে বাস করা, যেখানে সংক্রমণের আশঙ্কা অনেক বেশি।

রিপোর্টের গবেষকরা জরুরি কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তালিকায় আছেন শিক্ষক, বাসচালক মুদি দোকানিরা, যাদের ওপর আমরা সবাই নির্ভর করি।

দ্বিতীয় ধাপের প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বাকি বয়স্কদের যাদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি, স্কুল-কলেজ শিক্ষক, স্কুল স্টাফ চাইন্ডকেয়ার কর্মীদের। সে সঙ্গে কিছু জরুরি সেবা কর্মীদেরও, যেমন যারা মাংস প্যাকিংয়ের কাজ করে। তাদের কর্মস্থলে সামাজিক দূরত্ব মানা হয় না। গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বসবাসকারী এবং স্টাফদের আবাসস্থল, গৃহহীনদের আশ্রয়স্থল, কারাগার এবং আটক কেন্দ্রগুলোও ক্যাটাগরিতে স্থান পাবে।

শিশু, ৩০ বছর বয়সের নিচে তরুণরা এবং অন্যান্য জটিল কাজে যুক্ত কর্মীরা ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি নিয়ে তৃতীয় গ্রুপে অবস্থান করবে। চতুর্থ গ্রুপে বাকি সবাই অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

বর্তমানে প্রতিবেদনটি জমা দেয়া হয়েছে। রিপোর্টটি যাচাই করবে অ্যাডভাইজরি কমিটি অন ইমিউনাইজেশন প্র্যাকটিস (এসিআইপি) এটি একটি বেসরকারি সংস্থা, যারা সিডিসিতে লাইসেন্সযুক্ত ভ্যাকসিন ব্যবহারের বিষয়ে জন নীতিমালা সুপারিশ করে। যদিও এসিআইপির পরামর্শগুলো বাধ্যতামূলক না, কিন্তু সাধারণভাবে এগুলো গৃহীত হয়ে থাকে। এসিআইপির কমিটিপ্রধান জোসে রোমেরো বলেন, এগুলো কোনো কঠোর সুপারিশ হবে না। আমাদের কিছু নমনীয়তা প্রয়োজন।

এর কারণ হচ্ছে হেলথকেয়ার নিয়ন্ত্রকরা কিছু বিপজ্জনক পরিস্থিতি এড়াতে চেয়েছিলেন যখন তারা এইচ১এন১ ফ্লু মহামারীর ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্পেইনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তবে ভ্যাকসিন পৌঁছানোর আগেই রোগের হুমকি অন্তর্হিত হয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবে ভ্যাকসিনের সরবরাহ যখন সীমিত থাকে, তখন গণভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম সফলভাবে করা যায় সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকাদের লক্ষ্য করে চালিত করার মাধ্যমে। তবে স্বল্পতা সে সময় অনুমিত ছিল না। এপিডেমিওলজিস্ট জেনিফার নুযো বলেন, প্রতিটি রাজ্য শুরুতে মাত্র কয়েক হাজার ডোজ পেয়েছিল।

রোমেরো স্বীকার করেন যে প্রতিটি আলাদা রাজ্য কিংবা কাউন্টির দুর্বল জনগোষ্ঠী রয়েছে। যেমন মাংস প্যাকিংয়ের কাজ করা স্থানীয় কর্মীরা। দ্বিতীয় ধাপের শিপমেন্টে ভ্যাকসিন হাতে আসার পর তাদের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

ন্যায্যতা কী?

রোমেরো বলেছেন, এসিআইপি দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব মেডিসিন একত্র হয়েছে তাদের স্বাস্থ্য সমতাকে বেগবান করার জন্য। কিন্তু এসিআইপি চূড়ান্ত নির্দেশনা দেয়ার আগে অপেক্ষা করছে এটা জানার জন্য যে কোন ভ্যাকসিনটি অনুমোদন লাভ করবে।

তিনি বলেন, আমাদের প্রস্তাব সম্ভবত সময়ের সঙ্গে বদলে যাবে। প্রতিটি সংস্করণ সামনে আসার সঙ্গে আমরা এর কার্যকারিতা সম্পর্কেও জানতে পারব। দেখা গেল কোনো একটি ভ্যাকসিন বয়স্কদের মধ্যে ভালো কাজ করছে না। তখন আমাদের তরুণদের ওপর মনোযোগ দিতে হবে।

কভিড-১৯ মহামারীকালে স্বাস্থ্যসেবা সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করার জন্য ন্যায্যতার ব্যবহারের দৃষ্টান্ত এরই মধ্যে রয়েছে। যখন জুন মাসে রেমডিসিভিরের (একটি পরীক্ষামূলক অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ) স্বল্পতা দেখা দিয়েছিল, তখন ইউনিভার্সিটি অব পিটার্সবুর্গ মেডিকেল সেন্টার রোগীদের জন্য একটি লটারি সিস্টেমের ব্যবস্থা করেছিল। হাসপাতালের চারজন রোগীর মধ্যে একজনের জন্য তা পর্যাপ্ত ছিল, যেখানে যাদের অবস্থা আরো খারাপ ছিল তাদের তিনজনের মাঝে একজনের সুযোগ ছিল।

প্রশাসকরা বয়স, বর্ণ, জাতি, অক্ষমতা, খরচ দেয়ার ক্ষমতা, কারো দেখাশোনা করতে হবে এমন সন্তান আছে কিনা, এমন সব বিষয়কে বিবেচনা না করে যে মেট্রিকটি ব্যবহার করেন সেটিকে বলা হচ্ছে, অঞ্চলগত বঞ্চনা সূচক এটি একটি ডাটাবেজ যা তৈরি করেছে ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন।

ইউনিভার্সিটি অব পিটাসবুর্গের প্রোগ্রাম অন এথিকসের ডিরেক্টর ডগলাস হোয়াইট বলেন, যদি আপনি দরিদ্র হন, স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশের ক্ষেত্রে দুর্বল হন এবং কাজের ক্ষেত্র যদি আপনাকে অধিকতর মৃত্যুর ঝুঁকিতে রাখে তবে আমরা কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছি আপনার অসুবিধাকে কমানোর জন্য। তিনি বলেন, মডেল ভবিষ্যতের ওষুধস্বল্পতার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন