কৃষকের জানালা কিংবা ই-বালাইনাশক প্রেসক্রিপশন—কৃষকের জন্য এ ধরনের পরামর্শমূলক নানা ই-কন্টেন্ট পাওয়া যায় ডিজিটাল মাধ্যমে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শিখন-প্রশিক্ষণে চালু রয়েছে মুক্তপাঠ ও শিক্ষক বাতায়নের মতো নানা উদ্যোগ। সরকারের নানা অনুদান-প্রণোদনা পৌঁছার প্রক্রিয়াও ডিজিটালাইজেশনের আওতায় চলে আসছে। যদিও ইন্টারনেট সুবিধা না থাকায় এসব ভালো উদ্যোগের সুফল পাচ্ছে না প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বড় অংশ। গবেষণার তথ্য বলছে, দেশের গ্রামীণ জনপদের ৬৩ শতাংশ পরিবারেরই ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ নেই। আর ইন্টারনেট ব্যবহারের দক্ষতা নেই ৮৭ শতাংশ পরিবারের।
গ্রামাঞ্চলের পরিবারগুলোর ইন্টারনেট ব্যবহার বিষয়ে জানতে গত বছরের শেষের দিকে দেশের পার্বত্য অঞ্চলের বাইরে ৬০টি জেলায় একটি জরিপ চালায় ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)। এজন্য ওই বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর—এ তিন মাসে ৬ হাজার ৫০০ পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করে গবেষক দল। জরিপে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয় ‘ফার্স্ট অ্যান্ড সেকেন্ড লেভেল অব ডিজিটাল ডিভাইড ইন রুরাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের গ্রামীণ জনপদের মাত্র ৩৭ শতাংশ পরিবারের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। সে হিসাবে ৬৩ শতাংশ পরিবারের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ নেই। এছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহারে যে দক্ষতা প্রয়োজন তা রয়েছে মাত্র ১৩ শতাংশ পরিবারের। অর্থাৎ ৮৭ শতাংশ পরিবারের ইন্টারনেট ব্যবহারের দক্ষতাই নেই।
গ্রামে ইন্টারনেট সেবার প্রায় পুরোটাই এখনো সেলফোন ডাটানির্ভর। গ্রামীণ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর বড় অংশের ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তিনি বলেন, গবেষণায় যে তথ্য-উপাত্তের কথা বলা হচ্ছে সেটি অস্বীকারের সুযোগ নেই। যে ডিজিটাল ডিভাইডের কথা বলা হচ্ছে, সেটি নানাভাবে রয়েছে। ইন্টারনেট প্রাপ্যতা ও দক্ষতার ক্ষেত্রে শহর-গ্রাম, নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব বৈষম্য বিদ্যমান রয়েছে। এখন গ্রামাঞ্চলের ইন্টারনেট ব্যবহারের যে বৈষম্যের কথা বলা হচ্ছে, এটি কভিডের কারণে অনেক বেশি অনুভূত হচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষা খাত থেকে নানা ডিমান্ড আসছে আমাদের কাছে। এখন গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেটের যে সংকট সেটির মূল কারণ হচ্ছে অবকাঠামোর অভাব। আসলে গ্রাম পর্যায়ে অপারেটরগুলোর ইন্টারনেট সেবার মান খুবই খারাপ। আর কেবল নেটওয়ার্কও ইউনিয়ন পর্যায়ে ভালোভাবে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তবে এ বিষয়ে নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আরেকটি বড় সংকট হচ্ছে ডিভাইসকে কেন্দ্র করে। এ সমস্যার সমাধানে আমরা দেশীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে ডিভাইস বাজারে আনার চেষ্টা করছি। এছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহারের দক্ষতার ক্ষেত্রেও বেশ ঘাটতি রয়েছে।
বিআইজিডির গবেষণায় খাতভিত্তিক বিভাজনে দেখা গেছে, কৃষি খাতে কর্মরতদের ইন্টারনেট প্রাপ্যতা সবচেয়ে কম। কৃষি জনগোষ্ঠীতে ইন্টারনেট প্রাপ্যতার হার মাত্র ১৭ শতাংশ। আর ইন্টারনেট প্রাপ্যতার দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে শিক্ষার্থীরা, তাদের ৭০ শতাংশই ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। যারা বেকার বা অ-কৃষি খাতে কর্মরত তাদের তুলনায়ও শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট দক্ষতায় এগিয়ে। আর কৃষিতে যুক্তদের দক্ষতা সবচেয়ে কম। সব মিলিয়ে দেখা গেছে, ইন্টারনেট ব্যবহারে শিক্ষার্থীরাই এগিয়ে এবং বেকাররা সবচেয়ে পিছিয়ে।
গ্রামীণ বাংলাদেশে ইন্টারনেটের প্রাপ্তি, ব্যবহার ও দক্ষতার ক্ষেত্রে লৈঙ্গিক ব্যবধান রয়েছে বলেও উঠে এসেছে ওই গবেষণায়। ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ ও অনলাইন দক্ষতা—উভর ক্ষেত্রেই নারীদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন পুরুষরা। আর বিভাগীয় পর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগের দিক থেকে রংপুর সবচেয়ে পিছিয়ে। অন্যদিকে, চট্টগ্রামে এ হার সবচেয়ে বেশি, ঢাকা ও খুলনা রয়েছে তার পরেই। অনলাইন দক্ষতার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা ও রাজশাহীর সঙ্গে রংপুরের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। অনলাইন দক্ষতায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে বরিশাল এবং তার পরেই ময়মনসিংহ। ইন্টারনেট ব্যবহারে খুলনার অবস্থান বেশ ভালো। এক্ষেত্রে সিলেটের অবস্থা খুব খারাপ এবং অনলাইন দক্ষতা ও ব্যবহারেও এ বিভাগ বেশ পিছিয়ে।
বয়স, পরিবারের আকার, আয়, শিক্ষা, পেশা, লিঙ্গ, বসবাসের স্থান ইত্যাদির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে ইন্টারনেট প্রাপ্তি, ব্যবহার ও অনলাইন দক্ষতার ক্ষেত্রে। বিআইজিডির গবেষণায় দেখা গেছে, ১৫-২৪ বছর বয়সীরা অন্যান্য বয়সের ব্যক্তিদের তুলনায় বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং সে ব্যাপারে তারা বেশ দক্ষ। গবেষণায় পরিবারের আকার ও ইন্টারনেট ব্যবহারের মধ্যে একটি ইতিবাচক সম্পর্কও পাওয়া গেছে। ছোট পরিবারে থাকা একজন সদস্যের চেয়ে বড় পরিবারে থাকা একজন সদস্য ইন্টারনেট ব্যবহারে এগিয়ে থাকে।
গবেষণা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন বলেন, গবেষণায় ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক বড় বৈষম্যের একটি চিত্র আমাদের সামনে উঠে এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সেবা ডিজিটাল মাধ্যমে দেয়ার ঘোষণা ও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তবে সেবা যারা গ্রহণ করবে তাদের কতটুকু সক্ষমতা রয়েছে সেটিও ভাবতে হবে। সক্ষমতা না থাকলে ই-লার্নিং, টেলিমেডিসিন, ডিজিটাল ব্যাংকিংসহ এ ধরনের যত উদ্যোগ, তা থেকে গ্রামাঞ্চলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বঞ্চিত হবে। আমাদের মতে, যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করতে হবে। আর সেটা করতে হলে সে আলোকে নীতিমালা গ্রহণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
ইন্টারনেট প্রাপ্তির জন্য সাক্ষরতা ও শিক্ষা উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। অসাক্ষর মানুষের তুলনায় সাক্ষর মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ বেশি। শিক্ষাগত যোগ্যতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন দক্ষতা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের মাত্রাও বৃদ্ধি পায়। অশিক্ষিত লোকজন এবং এসএসসির নিচে যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা তাদের অনলাইন দক্ষতায় ও ইন্টারনেট ব্যবহারে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই। একজন মানুষ অন্তত এসএসসি বা সমমানের ডিগ্রি অর্জন করা ব্যক্তিরা ইন্টারনেট ব্যবহারে ও অনলাইনে তুলনামূলক বেশি দক্ষ।
এ বিষয়ে বিআইজিডির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষা ও সাক্ষরতা একজনের অর্থনৈতিক অবস্থাও তার ইন্টারনেট প্রাপ্তি, ব্যবহার ও অনলাইন দক্ষতায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে যাদের মাসিক আয় ৩০ হাজার টাকা বা তার ওপরে, তারা সবচেয়ে বেশি ইন্টারনেট সুবিধাপ্রাপ্ত। এ ধরনের ব্যক্তিদের ৭৪ শতাংশই ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছে। আবার যাদের আয় ২০ হাজারের ওপরে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের কোনো ধরনের আয়-ব্যবধান নেই। অর্থাৎ গ্রামীণ বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহারের জন্য ২০ হাজারের বেশি টাকা উপার্জন করা প্রয়োজন।
গবেষকদের মতে, গত কয়েক বছরে ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা বিস্তৃতির ক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। তবে ইন্টারনেটের প্রাপ্যতার অভাবে এ সেবাগুলো গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। ইন্টারনেট ব্যবহার ও দক্ষতার দিক থেকে গ্রাম ও শহরাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মাঝে বড় বৈষম্য তৈরি হয়েছে।
বিআইজিডির এ গবেষণা পরিচালনায় গবেষক দলের নেতৃত্ব দেন সংস্থাটির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক ড. মোহাম্মাদ শাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, গবেষণা থেকে আমরা দেখতে পাই, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য সবক’টি খাতেই ব্যাপক হারে ডিজিটালাইজেশন হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনামূলক উদ্যোগের পেমেন্টও হচ্ছে ডিজিটালি। এখন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ যদি ইন্টারনেট ব্যবহারের বাইরে থাকে, তার মানে দাঁড়ায় তারা এ সেবাগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্যবহারের দক্ষতা না থাকায় তারা প্রতারিত হওয়ারও ঝুঁকি রয়েছে।
প্রাপ্তিস্বল্পতা ও অল্প দক্ষতা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ইন্টারনেট ব্যবহারকে সীমিত করে দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেসব বিষয় এ আধুনিক সমস্যা সৃষ্টি করছে তা দূর করতে হবে আর সেটা করতে হলে সতর্কতার সঙ্গে নীতিমালা গ্রহণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। শুরু থেকেই এ দেশের নাগরিকরা নানা বৈষম্যের শিকার হয়েছে। যদি আমরা জনগণের মাঝে যথাযথ ইন্টারনেট সেবা পৌঁছানো ও তা ব্যবহারের দক্ষতা তৈরি করতে না পারি, তাহলে বৈষম্য আরো প্রকট হবে। শুধু তা-ই নয়, নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে আমরা যে সাফল্য অর্জন করেছি, এর ফলে তাও ব্যর্থ হতে পারে। তার মতে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসিটি সুবিধা প্রণয়ন ও অনুশীলন, ইন্টারনেট-সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং লৈঙ্গিক মাত্রার দিকে লক্ষ রাখলে ‘ডিজিটাল বৈষম্য’ দূর করা সম্ভব।