পশুতে উদ্বৃত্ত সত্ত্বেও অব্যাহত রয়েছে মাংস আমদানি

দেশীয় গবাদি পশু খাতের অধিকতর বিকাশে প্রতিবন্ধক

দেশে গবাদি পশু উৎপাদন খাত একটি বর্ধনশীল শিল্প। ২০১৪ সালে ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে আমাদের দেশ গবাদি পশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। সেই থেকে ধারাবাহিকভাবে দেশে মাংসের জন্য পশু উৎপাদন বেড়েই চলেছে। লাভজনক বিবেচনায় সনাতনী খামারিদের সঙ্গে শিক্ষিত অনেক তরুণও বর্তমানে খাতে উদ্যোক্তা হিসেবে নিয়োজিত। বলা চলে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা উদ্যোক্তাদের সম্মিলিত প্রয়াসে পশুতে ভারতনির্ভরতা শূন্যে নেমে এসেছে। কোরবানিতেও এখন চাহিদার শতভাগ পূরণ হচ্ছে দেশের উৎপাদিত পশু দিয়ে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে কভিড-১৯-এর কারণে চলতি বছর চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় উদ্বৃত্ত হতে যাচ্ছে পশুর সংখ্যা। এতে খামারিদের লোকসানে পড়ার শঙ্কাও প্রবল হচ্ছে। অবস্থায় খামারিদের জন্য যেখানে সরকারের নীতি সমর্থন প্রয়োজন, সেখানে উল্টো মাংস আমদানি অব্যাহত রয়েছে। বিশেষত ভারত, ব্রাজিল, প্যারাগুয়েসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে মাংস আমদানি হচ্ছে দেশে। বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, গত মাসে প্রায় ৫৭ লাখ মাংস আমদানি হয়েছে বাংলাদেশে। এটা দীর্ঘ সময় অব্যাহত থাকলে দেশীয় প্রাণিসম্পদ খাতের অধিকতর বিকাশ রুদ্ধ হবে। তাই বিষয়টি আমলে নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা কাম্য।

অতীতে দেখা গেছে, যে খাতটি বিকাশমান, সেটিকে বরাবরই রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেয়া হয়েছে। তৈরি পোশাক খাত, চামড়াসহ বিভিন্ন শিল্পের ক্ষেত্রে সেটি প্রযোজ্য। বলতে গেলে, যেকোনো বর্ধনশীল শিল্পের সুরক্ষা দেয়াই সরকারের ঘোষিত নীতি। কিন্তু গরু-ছাগলসহ গবাদি পশু উৎপাদন এবং তার মাংসে স্বয়ংম্ভর হওয়ার পরও মাংস আমদানি অব্যাহত থাকা কতটা বিবেচনাপ্রসূত, তা আলোচনার দাবি রাখে। এটা পূর্বোক্ত নীতির উল্টো যাত্রা। স্পষ্টতই এতে দেশের খামারিরা আর্থিক ক্ষতির শিকার হবেন এবং তারা পশু উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বেন। এক হিসাবে উঠে এসেছে, খাতে আনুমানিক ৭০ লাখ খামারি নিয়োজিত। পশু উৎপাদন থেকে শুরু করে মাংস ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানো পর্যন্ত আরো বিপুলসংখ্যক মানুষ যুক্ত। সংকুচিত শ্রমবাজারের বাস্তবতা সত্ত্বেও খাতে একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। বড় ব্যাপার হলো, কর্মসংস্থান মূলত সমাজের প্রান্তিক গ্রামীণ পর্যায়ে হয়ে থাকে। তার মানে আমদানি অবারিত রাখলে এসব মানুষের দারিদ্র্যকেও আরো প্রকট করে তুলবে বৈকি। কাজেই জরুরি ভিত্তিতে মাংস আমদানি বন্ধ করা উচিত।

আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো, হিমায়িত মাংস আমদানিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য বাংলাদেশে উন্নত মানের পরীক্ষাগার নেই। ফলে যথাযথভাবে মান যাচাই হচ্ছে না। এতে ভোক্তাদের স্বাস্থ্যও ঝুঁকিতে পড়ছে। যেহেতু পশুতে দেশ উদ্বৃত্ত হতে যাচ্ছে, সেহেতু আমদানিকারক নয়, বাংলাদেশ কীভাবে খাতের রফতানিকারক দেশে পরিণত হতে পারে, সেই লক্ষ্যেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। কৃষিনির্ভর দেশে গবাদি পশুর উৎপাদন বৃদ্ধি এবং খাতের উন্নয়ন বাড়তি সুফল দেবে। কারণ এর সঙ্গে জৈব সার এবং পরিবেশের নির্মলতাও জডিত। সেদিক থেকে গবাদি পশুর অধিকতর উন্নয়ন কৃষিজমিকে যেমন উর্বর করবে, তেমনি দুধের চাহিদা পূরণের একটি বিরাট উৎস হিসেবেও গণ্য হবে। পুষ্টির ঘাটতি মেটানো আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। গবাদি পশু খাতের বিকাশ আমাদের দুগ্ধশিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তদুপরি রয়েছে দেশের অন্যতম রফতানি খাত চামড়া শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব। শিল্পে কাঁচামাল পশুর চামড়ার ওপরই নির্ভরশীল। মাংস আমদানির কারণে পশু উৎপাদন নিরুৎসাহিত হলে তা চামড়া শিল্পে কাঁচামালের সংকটও তৈরি করবে। সুতরাং মাংস আমদানির বৃহত্তর প্রভাব কতটা গভীরতর, তা সহজেই অনুমেয়।

কোরবানি ঈদ আসন্ন। ঈদে বাড়তি পশু বেচা-কেনাকে কেন্দ্র করে খামারিরা কিছুটা লাভে থাকেন। কিন্তু এবার করোনা সংক্রমণের কারণে চাহিদাজনিত মন্দায় পশু বিক্রি কম হচ্ছে। সেক্ষেত্রে অনলাইন হাটের প্রসারে যথাযথ নীতি সহায়তা দিয়ে পশু বেচা-কেনায় সরকারকে পরিপূরক সহযোগিতা করতে হবে। এটি আশু কর্তব্য। তার পরও নিশ্চয়ই বিপুলসংখ্যক পশু অবিক্রীত থেকে যাবে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদেও খাতটির বিকাশে পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হবে মাংস আমদানি বন্ধ করা। কোনো ধরনের হিমায়িত মাংস বা প্রক্রিয়াজাত মাংস আমদানি অনুমোদন না দেয়ার জন্য এরই মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে মত্স্য প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পুরোপুরি নিষিদ্ধ না করলেও আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে উদ্যোগী হচ্ছে বলে জানা গেছে। ধরনের নীতিগত দোটানা কাম্য নয়। প্রত্যাশা করব, দেশীয় শিল্পের সুরক্ষার স্বার্থে মাংস আমদানি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দ্রুত উদ্যোগী হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন