পলিটিক্স পাকা হয় শোডাউনের ছবিতে

নাজমুল হক তপন

শরীরে অ্যাপ্রোন জড়িয়ে হাতে স্টেথস্কোপ নিলেই কি ডাক্তার হওয়া যায়? প্রশ্নটাই অবান্তর। বড় জোর ডাক্তার সাজার একটা ফটোসেশন হয়। হালে অবশ্য ফটোসেশনের জয়জয়কার। এক হাতে ডাস্টার আর অন্য হাতে চক , সুতরাং আমিও মাস্টার। সেলফি তুলে  ফেসবুকে  ছড়িয়ে দিলাম। ব্যাস ওকে। চোখের নিমেষেই ডাক্তার কিংবা মাস্টার বনে গেলাম। এফবিতে লাইক , কমেন্টে সয়লাব। স্তাবকের দলের গুণকীর্তনে সোশাল মিডিয়ায়  ঝড়। শোডাউনে সবাই মুগ্ধ। হামলে পড়ল মিডিয়া। জ্ঞানগর্ভ সাক্ষাৎকার এবং দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নেতা তার জীবনকে কীভাবে উৎসর্গ করছে নাকি সুরে তার আবেগঘন বর্ণনা। 

এই করোনাকালে দেশের মানুষের আশার কেন্দ্রে বোরো ধান। উৎপাদন যথেষ্ট ভাল। করোনাক্রান্তিতে ঘরবন্দী মানুষ। কাজ নাই। ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছে জীবন - জীবিকা। ক্ষুধা সর্বগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে , মানবতার চরম বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে এমন আশঙ্কা সর্বত্র। ঠিক এরকম একটা চরম দুঃসময়ে কৃষক তাদের জীবনীশক্তির সবটুকু ঢেলে দিয়ে ধান ফলিয়েছে মাঠে। এই ধানের দিকে চেয়েই নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে মানুষ। 

বন্যার আশঙ্কা। বৃষ্টির সঙ্গে ঝরছে শিলা। রক্ত - ঘামে পাওয়া ধান ঘরে তুলতে পারবে কিনা এনিয়ে কৃষকের দুঃশ্চিন্তার অন্ত নাই। এরই মধ্যে শিলাবৃষ্টিতে নওগাঁয় বিস্তৃত অঞ্চলের প্রায় পাকা ধান নষ্ট হয়েছে। পরিপূর্ণভাবে পাকার আগেই কোথাও কোথাও ধান আগেই কাটা হয়েছে। এমনি অবস্থায় সমানে চলছে ধান কাটার ফটোসেশন। ধান উৎপাদনের সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্কও নাই, অথচ ধানের ফলানোর কৃতিত্বের ভাগীদার হওয়ার জন্য কতই না আন্তরিক (!) চেষ্টা।  

একজন শ্রমিক দিনে কতটুকু ধান কাটতে পারে,  ধান কাটার শোডাউনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন  তারা কি কখনো নিজেদের এই প্রশ্নটা করেছেন? একজন মজুর এক ঘণ্টায় যে ধান কাটেন তার সমান ধান কাটতে হলে এই ফটোসেশনওয়ালাদের কত জন লাগবে? কিংবা ধান কাটার বিজ্ঞাপনে অংশ একজন পুরো দিনেও প্রকৃত শ্রমিকের এক ঘণ্টার সমান ধান কাটতে পারবেন কি-না? তাহলে এই লোকদেখানো কাজের  অর্থনৈতিক গুরুত্ব কী? মোটরগাড়ি কিংবা মোটরবাইকে করে এসে , আলের পাশে জুতা- মোজা খুলে দু-চার গাছি ধান কাটা , এর প্রয়োজনটাই বা কেন? যারা নিয়মিত ধান কাটে তারা কি কখনো কাটা ধান হাতে নিয়ে সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড দেয়? চোখে সুদৃশ্য সানগ্লাস, গায়ে চকচকে টি -শার্ট, খেতের মাঝে কাটা ধান হাতে দাঁড়িয়ে সেলফিবাজী- কি চমৎকার না দেখা গেল! অতঃপর  ফেসবুকে কমেন্টে ...বস যা মানিয়েছে না! যারা প্রকৃত মজুর তাদের এসবের সময় কোথায়? কেননা যত দ্রুত কাজ শেষ হবে ততই মঙ্গল। ফসল ঘরে উঠবে। 

কৃষকদের প্রণোদনার জন্য এমন উদ্যোগ নেয়া যেতেই পারে , এমন প্রশ্ন করার লোকেরও অভাব নাই। কৃষকের প্রণোদনার জায়গাটাকে আগে চেনাটা সবচেয়ে জরুরি। প্রণোদনার জন্য দু-গাছি ধান কাটার ফটোসেশনের চেয়েও অনেক অনেক কাজ করার আছে কৃষকদের জন্য। গত বছরের কথা মনে আছে? বাম্পার ধানের উৎপাদন করে কি বিপদেই না পড়েছিল আমাদের কৃষকরা! খরচের দুই তৃতীয়াংশও ধান বেচে পাননি দুর্ভাগা এই মানুষগুলো। কেউ কেউ অর্ধেক দামেই বাধ্য হয়েছিলেন ধান বিক্রি করতে। মনের দুঃখে ক্ষেতে ধান পুড়িয়ে দিচ্ছেন, প্রকাশিত হয়েছিল এমন সচিত্র প্রতিবেদনও। এমনই আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনা যে গত বছর , এক মন ধান বেচে ১০ সের চাল কেনার টাকাও পাননি আমাদের ধান চাষীরা। 

আমাদের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের কেমন দাম পান , সেটা বুঝতে বিশেষষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। টমেটো চাষীরা প্রতি কেজি টমেটো বিক্রি করছেন প্রতি ২/৩ টাকায়,  মিডিয়াতে এমন সংবাদ এসেছে কয়েকদিন আগে। ঢাকায় টমেটোর কেজি কত? গ্রাম থেকে উৎপাদিত ফসল কতবার হাত বদল হয়, এনিয়ে নতুন করে আর বলার কিছুই নাই। যত হাত বদল তত বেশি ঠকে চাষীরা। যত সময় যাচ্ছে , এই হাত বদলের সংখ্যাটা কমছে তো নয়ই বরং বাড়ছে। ধানে কৃষকদের অধিকার ওই কাটা পর্যন্তই। এরপর ধান থেকে চাল হওয়ার প্রক্রিয়াতে চাষীরা ব্রাত্য! বাজার ব্যবস্থাপনার জালে পুরোই বন্দী। হাত বদল সংস্কৃতির এই চক্র থেকে কৃষককুলকে বাঁচানোর চেষ্টা কি কখনো দেখা গেছে? 

করোনাকাল বলে এবারের ধানের  গুরুত্ব আলাদা। কেননা বিদেশ থেকে চাল আমদানি করে  ক্ষুধা মেটানোটা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, এই বাস্তবতা বুঝছেন সবাই। স্বভাবতই ধান নিয়ে ফোকাসটাও বেশি। যেহেতু ধান উঠেই গেছে তাই সেই ফোকাসটা নিজের দিকে টেনে নেয়ার চেষ্টা, মন্দ কি? 

ধান কাটার মৌসুমে শ্রমিক পাওয়াটা সবসময়ই চ্যালেঞ্জ। এটা নিয়ে প্রতিবছরই আলোচনা হয়। কিন্তু সমাধান আর হয় না। হাওড়ের বোরো ধানের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা নতুন করে বলার কিছু নাই। এই সঙ্কট নিরসনের জন্য , সরকার ভর্তুকি দিয়ে ধান কাটার জন্য কম্বাইন হার্ভেস্টার ও রিপার মেশিন দিয়েছে। এই যান্ত্রিক সুবিধার সুফল কিন্তু হাওড় অঞ্চলের কৃষকরা পাচ্ছেন না। ৭০ শতাংশ ভর্তুকি দিয়ে এ মাসেই ৪০টি কম্বাইন হার্ভেস্টার মেশিন দেয়া হয়েছে। প্রতিটি মেশিনের বাজারমূল্য ১১ লাখ থেকে ২৭ লাখ টাকা। সঙ্গে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৭টি রিপার মেশিনও। প্রতিটি মেশিনের মূল্য ২/৩ লাখ টাকা। 

আমন ধান কাটার জন্য উপযুক্ত হলেও এগুলো হাওড়ের ধান কাটার জন্য খুব একটা কার্যকর নয়। তবে অল্প জমির ধান এই মেশিনে কাটা যায়। এখানেও বিপত্তি। কেননা এই মেশিন টাকা দিয়ে কেনার মত সামর্থ্য চাষীদের নাই। কৃষকদের হাতে অর্থ আসে ধান ওঠার পরে।  তাছাড়া  করোনাক্রান্তির সময়ে হাত খালি করাটাও ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন চাষীরা। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী , মেশিনগুলো পড়ে আছে সরকারি গুদামগুলোতেই। 

ধান কাটার এই সময়ে রাজনীতিবিদ , কিংবা অন্য পেশার লোকজনদের ধান কাটা নিয়ে উঠছে অনেক কথাই। কাঁচা ধান নাকি পাকা ধান কাটা হয়েছে এনিয়ে বিতর্কও কম হচ্ছে না। কাঁচা - পাকা বিভ্রাটের এই সময়টাতে বাংলা ভাষায়  শিশু সাহিত্যের দিকপাল সুকুমার রায়ের অভাব অনুভূত হচ্ছে তীব্রভাবে। পাকা নিয়ে  বিখ্যাত ছড়া ‘পাকাপাকি’তে সুকুমার রায় লিখেছেন,

লোকে কয় কাঁঠাল সে পাকে নাকি কিলিয়ে? 

এসময় বেঁচে থাকলে সুকুমার রায় বোধকরি লিখতেন , 

পলিটিক্স পাকা হয় শোডাউনের ছবিতে!

লেখক: নাজমুল হক তপন, সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন