অস্বাভাবিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে
দুই দশক আগে দেশে ব্যবসার এক নতুন মডেল নিয়ে হাজির হয়েছিল মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি ‘ডেসটিনি
২০০০’।
এরপর আসে ইউনিপেটুইউ। অল্প সময়ের মধ্যে নেটওয়ার্কিং সম্প্রসারণ করে গ্রাহকের কাছ
থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় এ দুই প্রতিষ্ঠান। গ্রাহক প্রতারণার
বিষয়টি প্রকাশ হতে থাকলে কড়াকড়ি আসে এমএলএম ব্যবসায়। প্রণয়ন হয় মাল্টি লেভেল
মার্কেটিং কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) আইন। এরপর শুরু হয় প্রতারণার নতুন রূপ। কখনো ক্ষুদ্র ঋণ, কখনো
কো-অপারেটিভ
সোসাইটি বা কো-অপারেটিভ ব্যাংক,
আবার কখনো মাল্টিপারপাস সোসাইটি—নানা নামে শুরু
হয় আর্থিক প্রতারণা, যা এখনো চলছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, থানায়
নিবন্ধিত মামলার ভিকটিমদের ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশই আর্থিক প্রতারণার শিকার। যাদের বড়
অংশই অস্বাভাবিক লাভের প্রলোভনে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন।
ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউর
মতো প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের পর এমএলএম নিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে চরম আস্থার সংকট
তৈরি হলেও নানা কৌশলে কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে অন্তত দুই ডজন প্রতিষ্ঠান।
এমন একটি প্রতিষ্ঠান লাইফওয়ে বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড। ২০১৬ সালের দিকে চাকরির
প্রলোভন দেখিয়ে নতুন ধারার এমএলএম ব্যবসা ফেঁদেছে প্রতিষ্ঠানটি। বেকার যুবকদের
সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের পর আকর্ষণীয় বেতনের চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় তারা।
এজন্য জামানত হিসেবে প্রত্যেকের কাছ থেকে নেয়া হয় ৫০ হাজার টাকা করে। জামানতের বিপরীতে
যে নিয়োগপত্র দেয়া হয়, সেখানে অবশ্য উল্লেখ থাকে যে এই টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রী ক্রয় করেছেন
গ্রাহক।
গ্রাহকরা জানান, প্রশিক্ষণে
মূলত কীভাবে আরো সদস্য সংগ্রহ করে কমিশন পাওয়া যাবে এবং কীভাবে তাদের মোটিভেট করতে
হবে, সে
বিষয়ে জানানো হয়। প্রশিক্ষণ শেষে যারা সদস্য সংগ্রহ করতে পারেন, তাদের
২০ শতাংশ হারে কমিশন দেয়া হয়। আর যারা সদস্য সংগ্রহ করতে পারেন না, তাদের
কিছু ইলেকট্রনিক পণ্য দিয়ে সেগুলো বিক্রি করে টাকা আনতে বলা হয়।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে
র্যাবের পক্ষ থেকে বেশ কয়েক দফা লাইফওয়ে বাংলাদেশের গাজীপুরের কয়েকটি কার্যালয়েও
অভিযান চালানো হয়। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি চাকরির জামানতের কথা বলে গ্রাহকের কাছ
দেড় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধন নিয়ে ২০১০
সালে দক্ষিণাঞ্চলের তিনটি এলাকায় কার্যক্রম শুরু করে প্রাইম মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ
সোসাইটি লিমিটেড। ২০১১ সালে যশোর আরএন রোডে প্রধান কার্যালয় স্থাপনের মধ্য দিয়ে
সঞ্চয়পত্র ও স্থায়ী আমানত গ্রহণ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে ৩০
শতাংশ লভ্যাংশ, স্থায়ী আমানতের ক্ষেত্রে চার বছরে দ্বিগুণ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে
যশোর, সাতক্ষীরা ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের প্রায় আড়াই হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে ১৫
মোটি টাকা নেয় প্রাইম মাল্টিপারপাস।
প্রাইম মাল্টিপারপাসে বিনিয়োগ করে
প্রতারিত হয়েছেন এমন একজন রেহানা পারভিন। প্রতিষ্ঠানটিতে ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন
কুষ্টিয়ার এই নারী। তাকে বলা হয়েছিল,
চার বছর পর দ্বিগুণ অর্থাৎ ২০ লাখ টাকা পাবেন
তিনি। কিন্তু লাভ দূরের কথা,
আসল টাকাও ফিরে পাননি এ বিনিয়োগকারী।
তিনি জানান, আর্থিক
লাভের আশায় ব্যাংক থেকে ১৪ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে প্রাইম মাল্টিপারপাসে ১০ লাখ টাকা
বিনিয়োগ করি। চার বছর পর আমানতের দ্বিগুণ অর্থ ফেরত পাওয়ার কথা থাকলেও তিন বছরের
মাথায় লাপাত্তা হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর টাকা উদ্ধারে থানায় মামলা করেন বলে
জানান এই নারী।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির
অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মো. ফারুক
হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, স্বল্প সময়ে অধিক লাভের প্রলোভন দেখিয়ে অনেক গ্রাহকের কাছ থেকে মোটা
অংকের অর্থ হাতিয়ে নেন প্রাইম মাল্টিপারপাসের শীর্ষ কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠানটির
চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলামকে গ্রেফতারের পর এ চক্রে আরো সাতজনের জড়িয়ে থাকার তথ্য
পাওয়া যায়। এ প্রতারক চক্রের অন্য সহযোগীরা বর্তমানে বিভিন্ন জেলায় স্থানীয় নিবন্ধন
নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। সিআইডি প্রতারক চক্রটির মূল উৎপাটনের লক্ষ্যে
মামলাটির তদন্ত অব্যাহত রেখেছে।
প্রতারণার নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছে দি
ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড। মূলত তারা কো-অপারেটিভ সোসাইটির নিবন্ধন নিয়ে
অবৈধভাবে নামের শেষে ব্যাংক শব্দটি ব্যবহার করছে। গ্রাহকের আস্থা লাভ করতেই
প্রতিষ্ঠানটি এমন কৌশল নিয়েছে বলে দাবি আর্থিক খাতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর। তাদের
তথ্যমতে, এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের কাছ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে
নিয়েছে।
বাড়তি আয়ের আশায় চলন্তিকা যুব সোসাইটি
নামের খুলনা অঞ্চলের এক প্রতিষ্ঠানে ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন নড়াইলের দেবীপুর
গ্রামের আক্তার হোসেন। এক মাস পর লভ্যাংশ আনতে গিয়ে দেখেন কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়ে
লাপাত্তা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। প্রবাসী আয়ের সবটাই খুইয়ে পুলিশের শরণাপন্ন
হয়েছেন তিনি।
আক্তার হোসেনের মতোই চলন্তিকা যুব
সোসাইটিতে বিনিয়োগ করে পথে বসেছেন নড়াইলের কালিয়া উপজেলার চম্পা দাশ। স্বামীর
মৃত্যুর পর তিনি পরিবারের হাল ধরার চেষ্টা করেন। এমন সময় চলন্তিকা যুব সোসাইটির
স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি আমানত রাখার প্রস্তাব পান এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে। তাকে বলা
হয়, মাসিক
ভিত্তিতে স্বল্পমেয়াদি আমানতের বিপরীতে ৩০ শতাংশ আর দীর্ঘমেয়াদি আমানতের বিপরীতে
৫০ শতাংশ লভ্যাংশ দেবে সমবায় প্রতিষ্ঠানটি।
প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে চলন্তিকায় ৫
লাখ টাকা স্বল্পমেয়াদি আমানত রাখেন চম্পা দাশ। পরপর তিন মাস লভ্যাংশের টাকা সঠিক
সময়ে পেয়ে তার বিশ্বাসের দেয়াল আরো মজবুত হয়। এরপর তিনি আরো ১০ লাখ টাকা
দীর্ঘমেয়াদি আমানত হিসেবে রাখেন চলন্তিকায়। এরপর চম্পা দাশও আক্তার হোসেনের মতো
আর্থিক অপরাধের শিকার হয়ে শরণাপন্ন হন পুলিশের।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক অলোক চন্দ্র জানান, কর্মসংস্থানের দিক থেকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে অতিরিক্ত মুনাফা দেয়ার লোভ দেখায় চলন্তিকা যুব সোসাইটি। গ্রাহকের বিশ্বাস অর্জনের জন্য তারা প্রথম কয়েক মাস নির্ধারিত সময়েই লভ্যাংশ দেয়। এভাবে তিন বছর কার্যক্রম পরিচালনার পর গ্রাহকের ৯৬ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয় প্রতিষ্ঠানটি। এ ঘটনায় সহযোগীসহ চলন্তিকা যুব সোসাইটির চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
একইভাবে গ্রাহককে অতিরিক্ত লভ্যাংশ
দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঠকিয়েছে রূপসা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ
সোসাইটি। বন্দর নগরী চট্টগ্রামে ২০০৬ সালে কার্যালয় খুলে গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত
সংগ্রহ শুরু করে রূপসা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি ঢাকার মতিঝিলেও কার্যালয়
খোলে। নয় বছরে রূপসা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি ১১ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে ৯৩ কোটি টাকা আমানত
হিসেবে নিয়ে আত্মসাৎ করেছে।